Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Covid 19

ওয়েবসাইটে নাম, অথচ কোভিড কেয়ার সেন্টারে চিকিৎসা অমিল!

শনিবার সকালে সাড়ে ১০টায় পরিস্থিতি যাচাইয়ে যাত্রা শুরু।  সঙ্গে ৬৮ বছরের বৃদ্ধার কোভিড পজিটিভ রিপোর্ট, যাঁর অক্সিজেনের মাত্রা ছিল ৮৮।

শয্যা নেই, জানিয়ে বিজ্ঞপ্তি হাতিবাগানের নবজীবন হাসপাতালের প্রবেশ পথে। নিজস্ব চিত্র

শয্যা নেই, জানিয়ে বিজ্ঞপ্তি হাতিবাগানের নবজীবন হাসপাতালের প্রবেশ পথে। নিজস্ব চিত্র

সৌরভ দত্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০২০ ০৫:১২
Share: Save:

কোভিড রোগীর (যাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করা জরুরি) ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ভবনের কন্ট্রোল রুমে ফোন করলে শয্যার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, শয্যা ফাঁকা হলেই। তবে কন্ট্রোল রুমে ফোন করা এবং শয্যা পাওয়ার মধ্যে সময় অনেকটাই লাগছে, অনেক ক্ষেত্রে। তাই অনেক রোগীর পরিবারই বাধ্য হয়ে বেরিয়ে পড়ছেন বেসরকারি হাসপাতালে শয্যার খোঁজে। তাঁদের কী অভিজ্ঞতা হচ্ছে? শনিবার সকালে সাড়ে ১০টায় পরিস্থিতি যাচাইয়ে যাত্রা শুরু। সঙ্গে ৬৮ বছরের বৃদ্ধার কোভিড পজিটিভ রিপোর্ট, যাঁর অক্সিজেনের মাত্রা ছিল ৮৮। সাড়ে চার ঘণ্টায় ৪৪ কিলোমিটার যাত্রাপথে, স্বাস্থ্য দফতরের ওয়েবসাইটে কোভিড কেয়ার সেন্টার হিসেবে নথিভুক্ত ১০টি বেসরকারি হাসপাতাল-নার্সিংহোমে শয্যা খোঁজার অভিজ্ঞতা।

স্পন্দন: স্বাস্থ্য দফতরের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, তেঘরিয়ার কোভিড কেয়ার সেন্টারে ১৫টি শয্যা রয়েছে। কিন্তু আগমনের কারণ শোনা মাত্র হাসপাতালের এক কর্মী জানান, সেখানে চিকিৎসাধীন রোগীর করোনা ধরা পড়লে তাঁদের জন্য কোভিড শয্যা রয়েছে। তা-ও সব ভর্তি। ‘বহিরাগত’ রোগীর চিকিৎসার সুযোগ নেই। তা স্বাস্থ্য দফতরের ওয়েবসাইটে লেখা নেই কেন? সদুত্তর মেলেনি।

অ্যাপেক্স আইএমএ: তেঘরিয়া থেকে ইএম বাইপাসে পরবর্তী হাসপাতালে পৌঁছনোর মধ্যে স্বাস্থ্য দফতরের তালিকা দেখে সন্তোষপুরের বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হয়। এক মহিলা কর্মী ফোন ধরে বললেন, ‘‘এখানে কোভিডের চিকিৎসা হয় না।’’ স্বাস্থ্য দফতরের তালিকায় যে নাম রয়েছে? মহিলা কর্মীর জবাব, ‘‘নাম আছে জানি। কিন্তু আমাদের ম্যানেজমেন্ট থেকে এখনও কোভিড চিকিৎসা শুরু করার ব্যাপারে কিছু বলেনি।’’

অ্যাপোলো গ্লেনেগলস: অ্যাডমিশন ডেস্কের কর্মীর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন হাসপাতালের রক্ষী। ঘনঘন ফোনে ব্যতিব্যস্ত কর্মী কাউকে বাড়িতে থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন তো কারও কাছে রিপোর্ট আছে কিনা জানতে চাইছেন। এরই মধ্যে বৃদ্ধার শারীরিক উপসর্গের কথা শুনে বললেন, ‘‘বেড নেই! ইমার্জেন্সিতে পাঁচ জন কোভিড রোগী আছেন, যাঁরা শয্যা পাবেন কি না জানি না!’’ অপেক্ষার তালিকায় থাকা রোগীরা অন্য অসুখ নিয়ে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি হাসপাতালেই ছিলেন। পরে তাঁদের কোভিড ধরা পড়ে।

আনন্দপুর ফর্টিস: রিসেপশন থেকে জরুরি বিভাগে কথা বলার পরামর্শ দেওয়া হয়। জরুরি বিভাগের বাইরে বোর্ডে লেখা রয়েছে, ‘নো কোভিড বেড ভেকেন্ট’! তা-ও জরুরি বিভাগের ভিতরে প্রবেশ করা গেল। এক স্বাস্থ্যকর্মী বোর্ডে লেখা কথাগুলোরই পুনরাবৃত্তি করলেন।

আরও পড়ুন: অগস্টে আক্রান্ত ও মৃত্যুর ‘রেকর্ড’ সংখ্যা দিয়েই যাত্রা শুরু সংক্রমণের

আরও পড়ুন: মেডিক্লেম নাকি ‘চলবে না’, দেড় লক্ষ কোভিড রোগী ভর্তি হতেই?

আনন্দপুর ফর্টিসের জরুরি বিভাগের বাইরে।

ডিসান: শ্বাসকষ্টের উপসর্গযুক্ত বয়স্ক কোভিড রোগীর শয্যা চাই শুনে হাসপাতালের একতলায় পনেরো নম্বর ঘরে দেখা করার জন্য বলা হল। সব শুনে ভারপ্রাপ্ত কর্মী বললেন, ‘‘এই মুহূর্তে আমাদের বেডের ক্রাইসিস আছে। আপনি চাইলে বেড বুক করে যেতে পারেন। বেড খালি হলে ফোন করে ডেকে নেব।’’ কী করতে হবে? কর্মীর জবাব, ‘‘চিকিৎসা নগদে না কি স্বাস্থ্যবিমা?’’ জানানো হল, স্বাস্থ্যবিমা নেই। পনেরো নম্বর ঘরে প্লাস্টিকের পর্দার ওপারে উপবিষ্ট কর্মী বলেন, ‘‘নগদে চিকিৎসা হলে অন্তত তিন লক্ষ টাকা জমা করার পরে রোগীর নাম, ফোন নম্বর দিয়ে যাবেন। বেড ফাঁকা হয়ে গেলে আমরা কল করে নেব! তবে ওই তিন লক্ষ টাকা কোনও প্যাকেজ নয়!’’

এ ভাবে কোনও রোগীর পরিজনের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা চাওয়া যায় না। রোগী ভর্তি না হলে কিসের টাকা! হাসপাতালের কোনও কর্মী এ কথা বলে থাকলে ঠিক বলেননি। ওই কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তাপস মুখোপাধ্যায়, ডেপুটি ম্যানেজার, ডিসান

গুরুতর অসুস্থ কোনও রোগীকে যাতে ফেরাতে না হয় সে জন্য আমরা সকলে চেষ্টা করছি। একেবারেই
বেড না থাকলে তো কিছু করার নেই।

অ্যাপোলো কর্তৃপক্ষ

কোভিড রোগীর ক্ষেত্রে অগ্রিম হিসেবে একসঙ্গে অনেকটা টাকা নেওয়ার কারণ আক্রান্তদের অনেকে কোয়রান্টিনে থাকছেন। ফলে অনেক সময় রোগীর বাড়ির লোকজন প্রতিদিন হাসপাতালে আসতে পারছেন না। সংক্রমণের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে হাসপাতালগুলির উপরে শয্যার চাপ রয়েছে। শয্যার সংখ্যা বাড়িয়ে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। বয়স্ক মানুষের শ্বাসকষ্টের উপসর্গ থাকলে নিশ্চয় হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু যাঁদের হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন নেই তাঁরাও কোভিড হাসপাতালে ভর্তি হওয়ায় কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি হচ্ছে। উপসর্গহীন, মৃদু উপসর্গযুক্ত আক্রান্তদের বুঝতে হবে তাঁরা হোম আইসোলেশন, সেফ হোম, স্যাটেলাইট সেন্টার বা হোটেলে থাকলে গুরুতর আক্রান্তেরা উপকৃত হন।

রূপক বড়ুয়া, সভাপতি, অ্যাসোসিয়েশন অব হসপিটালস অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়া

বেসরকারি হাসপাতালের পরিকাঠামো সীমিত। সরকারি হাসপাতালে পর্যাপ্ত শয্যা রয়েছে। স্বাস্থ্য দফতরের কন্ট্রোল রুমে ফোন করলে শয্যার ব্যবস্থা করে দেওয়া হচ্ছে। সংক্রমণ যখন রয়েছে, তখন শয্যার চাহিদাও থাকবে। কিন্তু উপসর্গহীন, মৃদু উপসর্গেরা যদি শয্যা আটকে রাখেন, তা হলে সমস্যা।

স্বাস্থ্য দফতরের শীর্ষ কর্তা

মেডিকা: প্রবেশ পথে রক্ষীর দিকনির্দেশ হল, ভর্তির জন্য সোজা জরুরি বিভাগ। সেখানে কর্তব্যরত এক মহিলা কর্মী ফোনে মেডিকার ডিউটি ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। ডিউটি ম্যানেজারের জবাব, ‘‘সোম-মঙ্গলবারের আগে কোনও বেড খালি হওয়ার আশা নেই!’’

আর এন টেগোর: এখানেও গন্তব্য জরুরি বিভাগ। দরজার বাঁ দিকে কোভিড শয্যার পরিসংখ্যান লেখা রয়েছে। জুলাইয়ের শেষ দিনের পরিসংখ্যান অগস্টের দুপুরেও মোছা হয়নি। যোগবিয়োগের পরে বোর্ডের পরিসংখ্যানের সারমর্ম হল, শুক্রবার ১০টি কোভিড বেড খালি ছিল। কিন্তু রিসেপশনে কর্তব্যরত কর্মী জানান, এখন একটিও বেড নেই। হাওড়ায় ওই হাসপাতালের আর একটি শাখায় জরুরি বিভাগের কর্মী যোগাযোগ করেন। মিনিট দশ অপেক্ষা করার পরে জানানো হয়, হাওড়ায় একটি বেড খালি হয়েছে। প্রাথমিক ভাবে ৫০ হাজার টাকা জমা করতে হবে। শয্যার যে হেতু অভাব রয়েছে তাই দমদম থেকে যত দ্রুত সম্ভব হাওড়ার হাসপাতালে পৌঁছনোর জন্য বলা হয়। নইলে শয্যা হাতছাড়া হওয়ার সম্ভাবনা।

(এখানে অভিযানে ইতি টানা যেত। কিন্তু শয্যাপ্রাপ্তি যে হেতু শর্তসাপেক্ষ, তাই আরও খোঁজ চলল। তুলনায় ছোট হাসপাতাল-নার্সিংহোমে)

অল এশিয়া মেডিক্যাল ইনস্টিটিউট: গড়চা ফার্স্ট লেনের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানটি স্বাস্থ্য দফতরের ওয়েবসাইটে বেসরকারি কোভিড হাসপাতালের উপরের তালিকায় রয়েছে। করোনার শয্যা হবে? ম্যানেজার সুরেন্দ্র প্রসাদ নিজের ঘরে ডেকে বললেন, দু’টি কেবিন আছে। সিসিইউ-এইচডিইউ সব রয়েছে। ম্যানেজারের কথায়, ‘‘প্রাথমিক ভাবে ৫০ হাজার টাকা জমা করতে হবে। আর প্রতিদিন ৩০-৩৫ হাজার খরচ হবে কিন্তু!’’

হেলথ পয়েন্ট: পদ্মপুকুর রোডের স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে সাতটি শয্যা রয়েছে। সেখানকার ভারপ্রাপ্ত চিকিৎসক অঙ্কিত কুমার জানান, কোনও শয্যা নেই। কিন্তু তপসিয়ার একটি নার্সিংহোমে শয্যা খালি রয়েছে বলে জানান তিনি। খরচ কত? বৃদ্ধার উপসর্গ জেনে চিকিৎসক বলেন, ‘‘দেড় লক্ষ টাকা প্রথমে জমা করতে হবে। প্রতিদিন শয্যার ভাড়া ১৩ হাজার টাকা। ওষুধের খরচ আলাদা।’’

নবজীবন: হাতিবাগান এলাকার হাসপাতালে রিসেপশন পর্যন্তও যেতে হল না। সদর দরজায় তিন ধরনের পোস্টার— ‘রিগ্রেট নো বেড। বেড নট অ্যাভেলেবল। নো বেড!’’ শুক্রবার সন্ধ্যাতেও উত্তর কলকাতার যে হাসপাতালের নামের পাশে ২৩টি শয্যা খালি রয়েছে বলে স্বাস্থ্য দফতরের ওয়েবসাইটে জানানো হয়েছে।

ড্রিমল্যান্ড: শ্যামবাজার এলাকার এই নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষও জানিয়ে দেন যে, ১৬টি বেডের একটিও খালি নেই!

(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।

• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)

অন্য বিষয়গুলি:

Covid 19 Hospitals
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy