Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Covid-19

কোভিডের ঘোলা জলে অ্যাম্বুল্যান্সেও কালোবাজারি! প্রশাসন কী করছে?

অমিতাভ বচ্চনের কোভিড আক্রান্ত হওয়ার পর পরই হাসপাতাল যাত্রার সুযোগের সঙ্গে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের চিকিৎসা পাওয়ার আকুতি তুলনা করি, তা হলে বোধহয় অধিকার বৈষম্যের চিত্রটা পরিষ্কার হতে থাকে।

বাংলায় একটা শব্দ রয়েছে— দাঁও। আর রয়েছে ‘ঝোপ বুঝে কোপ’। পরিস্থিতির শিকারিরা কোভিডকালেও তত্‌পর। ফাইল চিত্র।

বাংলায় একটা শব্দ রয়েছে— দাঁও। আর রয়েছে ‘ঝোপ বুঝে কোপ’। পরিস্থিতির শিকারিরা কোভিডকালেও তত্‌পর। ফাইল চিত্র।

সুপর্ণ পাঠক
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০২০ ১৯:৪৯
Share: Save:

একটু অক্সিজেন! এই আকুতি, আর তা না পেয়ে মৃত্যুর গল্প এখন প্রায় প্রতিটি স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম। কিন্তু, অক্সিজেন পাওয়ার সুযোগ থাকলেও তার কাছে পৌঁছনোর জন্য যে অ্যাম্বুল্যান্স দরকার মিলছে না তাও। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হাসপাতালের খরচের চাপ। কতজন রোগী এই খরচের চাপ নিতে পারেন সেই হিসাব এখনও পরিষ্কার নয়। পরিষ্কার নয় যাঁদের এই ক্ষমতা নেই তাঁরা সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার সুযোগ না পেলে কী করছেন। বাড়তে থাকা এই মৃত্যুর মিছিল তাই কতটা রোগের জন্য আর কতটা পকেটের জন্য, সেই হিসাব নেওয়ার তথ্য-সম্বৃদ্ধি আমাদের দেশে আশা করাটাও ভুল। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলছে, বাজারের চাহিদা জোগানের সাধারণ অঙ্কে এই সমীকরণ মেলার নয়।

তবে যদি অমিতাভ বচ্চনের কোভিড আক্রান্ত হওয়ার পর পরই হাসপাতাল যাত্রার সুযোগের সঙ্গে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের চিকিৎসা পাওয়ার আকুতি তুলনা করি, তা হলে বোধহয় অধিকার বৈষম্যের চিত্রটা পরিষ্কার হতে থাকে। আর এই অধিকার বৈষম্যই বলে দেয়— চাহিদা-জোগানের অঙ্কটাই শেষ কথা নয়। সামাজিক ওজন আর গ্যাঁটের জোর এই সমীকরণকে ভোঁতা করে মৃত্যুর মিছিলে মানুষ জুগিয়ে চলার জন্য অনেকটাই দায়ী। রোগের সঙ্গে হাত মিলিয়েই।

বাজারের অঙ্কটা কিন্তু সাধারণ বুদ্ধির বোঝার বাইরে নয়। বাংলায় এর জন্য একটা জুতসই শব্দ রয়েছে। দাঁও। আর রয়েছে ‘ঝোপ বুঝে কোপ’। এক পা, এক পা করে এগোন যাক। কয়েক দিন আগেই আমরা কাগজে পড়েছি একটি বাচ্চাকে স্থানান্তরে নিয়ে যেতে অ্যাম্বুল্যান্সের আকাশচুম্বী চাহিদার জেরে হেনস্থার কথা। আর সম্প্রতি শোনা গেল বাইপাসের একটি বেসরকারি হাসপাতালের গল্প। দু’কিলোমিটার দুরে কোভিড আক্রান্ত রোগীকে পরীক্ষার জন্য আনা নেওয়া করতে পাঁচ হাজার টাকার দাবি তারা, যা নাকি অন্য সময়ে দু’হাজার টাকা, ট্রিপ প্রতি হাজার টাকা ধরে। হাজার টাকাটা রয়েছে, কিন্তু তার সঙ্গে যোগ হয়েছে পিপিই-র নাম করে আরও কিছু আদায় করে নেওয়া। এটাই তো ঝোপ বুঝে কোপ মারার গল্প।

ফেরা যাক চাহিদা-জোগানের গল্পে। লকডাউনের প্রথম দিকে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়েছে পিপিই-র নাম করে। আর আজ তাই সরকার বাধ্য হয়েছে এর সীমা বেঁধে দিতে। এখন পিপিই-র জোগানে কোনও চাপ নেই। আর তার দামও কি রোগীর ঘাড়ে এতটা চাপানো যায়? যদি ধরি পিপিই কিনতে ৭০০ টাকা লাগে, আর রোগীকে তার জন্য ১০০০ টাকা দিতে হচ্ছে তা হলে কিন্তু লাভের অঙ্ক ছাড়াচ্ছে ২৩ শতাংশ। লাভের অঙ্ক কিন্তু আদতে আরও বেশি। কারণ, হাসপাতালগুলি এক লপ্তে অনেক কিনে থাকে। ফলে বাজার দর থেকে অনেক কম দামেই পেয়ে থাকে পিপিই।

আরও পড়ুন: বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন, টিকা না আসা পর্যন্ত সতর্ক থাকুন: মোদী

বাজার কি সব নির্ধারণ করতে পারে? বাজারের হাতেই বা আমরা সব কিছু ছেড়ে দিতে পারি কি? প্রবল বাজারমুখী অর্থনীতিবিদও কিন্তু তাঁর গুরুর দিব্যি দিয়ে উত্তরটা ‘হ্যাঁ’ বলতে পারবেন না। কেন? অ্যাম্বুল্যান্সের অঙ্কেই ফেরা যাক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে জনসংখ্যার প্রতি লক্ষে একটি অ্যাম্বুল্যান্স থাকা প্রয়োজন। ন্যাশন্যাল হেলথ মিশনের হিসাব অনুযায়ী আমাদের রাজ্যে রয়েছে ৩,৬১৬টি অ্যাম্বুল্যান্স। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মানলে যা ৩৬ কোটি জনসংখ্যার জন্য যথেষ্ট। তা হলে?

আরও পড়ুন: কোভিডের বাহক হয়ে সংক্রমিত কর ভারতকে, আইএসের নির্দেশ সমর্থকদের

আসলে জোগানই বাজার অর্থনীতিতে যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন দাম যাচাইয়ে সুযোগও। আপনি যদি দাম যাচাই করে যেখানে দাম কম সেই বাজারে যাওয়ার সুযোগ না পান, তা হলে জোগান যাই হোক না কেন, যা খুশি দাম হাঁকার সুযোগ বাজারের অঙ্কেই তৈরি হয়ে যায়। ধরা যাক সেই বাচ্চাটির কথাই। সামনে একটাই অ্যাম্বুল্যান্স, আর প্রয়োজন দ্রুত অন্য হাসপাতালে রোগীকে নিয়ে যাওয়ার। তখন আর দরদাম করে অন্য জায়গা থেকে আয়ত্তের মধ্যে অ্যাম্বুল্যান্স পাওয়ার সুযোগ নেই। আর এটাই ঝোপ বুঝে কোপ মারার সুযোগ হয়ে দাঁড়াচ্ছে স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যবসায়।

জোগান যাই হোক, অবস্থাই কিন্তু তৈরি করে দিচ্ছে একচেটিয়া ব্যবসার। অ্যাম্বুল্যান্সের জোগান বহুল হলেও তার দাম নিয়ে কিন্তু বিপদে পড়ে যাওয়া পরিস্থিতিতে দর করার সুযোগ থাকছে না। আর এইখানেই ভেঙে পড়ছে বর্তমানের স্বাস্থ্য পরিষেবা। যতটা আছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেকটা বলে সরকারের দাবি। কিন্তু সাধারণের কাছে চাহিদার মুহূর্তে তা সহজে মিলছে না। তৈরি হচ্ছে একচেটিয়া বাজার, জোগান যাই হোক না কেন। আর হাসপাতাল থেকে শুরু করে অ্যাম্বুল্যান্সের মতো সংশ্লিষ্ট পরিষেবা— সবাই একে ব্যবহার করে চলেছে প্রায় এক অনিয়ন্ত্রিত বাজার পরিকাঠামো গড়ে তুলতে।

সহজ করে জটিল যুক্তিকে উপস্থাপন করার ঝুঁকি হল, তার ভাঁজের অন্য সুক্ষ্ম যুক্তিকে এড়িয়ে যাওয়ার দায়। কিন্তু, আজ রাজ্যের কোভিড আক্রান্তদের চিকিৎসার চাপ তৈরি হয়েছে এই কারণেই। আমাদের কাছে কোনও তথ্য নেই যাতে আমরা বলতে পারি, ঠিক কতজন মানুষ খরচের এই চাপ এড়াতেই একদম শেষ মুহূর্তে চিকিৎসার সুযোগ নিতে যাচ্ছেন, বা মাঝ পথেই হাল ছেড়ে মৃত্যুর মিছিলে সামিল হচ্ছেন। এটা সত্যি যে অমিতাভ বচ্চনদের পক্ষে যা সহজ, তা তাঁর অগণিত ভক্তের পক্ষে ঠিক ততটাই কঠিন। আর এইখানেই বোধহয় আমাদের মতো দেশে চিকিৎসার খরচে দক্ষ আইনি নজরদারি জরুরি। অন্তত অর্থনীতির যুক্তি তাই বলে। আমরা যদি এখনও এই দিকে নজর না দিতে পারি, তা হলে অনেক বেশি মানুষকে হারাব কোভিডের কোপে। অযথা গ্যাঁটের উপর চাপেই।

অন্য বিষয়গুলি:

Covid-19 Pandemic Health Care Ambulance
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy