Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
Upanayan

১০ বছরের কন্যার পৈতে দিলেন বীরভূমের দম্পতি! বললেন, ‘বৈদিক রীতি ফেরালাম’

বৈদিক যুগে নাকি মেয়েদের ‘দ্বিজা’ হওয়ার রেওয়াজ ছিল! সেই ‘রীতি’ ফেরাতে কন্যাসন্তানের পৈতের আয়োজন করলেন বীরভূমের সিউড়ির চিকিৎসক দম্পতি বসন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কৌশানী চট্টোপাধ্যায়।

কৈরভী বন্দ্যোপাধ্যায়।

কৈরভী বন্দ্যোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
সিউড়ি শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০২৪ ১৯:৪৯
Share: Save:

বৈদিক যুগে নাকি মেয়েদের ‘দ্বিজা’ হওয়ার রেওয়াজ ছিল! সেই ‘রীতি’ ফেরাতে কন্যাসন্তানের পৈতের আয়োজন করলেন বীরভূমের সিউড়ির চিকিৎসক দম্পতি বসন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কৌশানী বন্দ্যোপাধ্যায়।

‘বামুন চিনি পৈতে প্রমাণ, বামনি চিনি কী প্রকারে?’ লালনের গানের সেই চিরকালীন প্রশ্নের জবাবই যেন মেয়ে কৈরভীর পৈতের অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণপত্রে দিয়েছেন দম্পতি। যে পত্রে স্থান-কালের উল্লেখ ও সনির্বন্ধ আমন্ত্রণের সঙ্গে রয়েছে পাতাজোড়া ব্যাখ্যা— কেন মেয়েদেরও উপনয়ন সম্ভব। কর্মসূত্রে ভিন্‌জেলায় থাকেন বসন্ত এবং কৌশানী। বুধবার সিউড়ির রামকৃষ্ণপল্লির বাড়িতে মেয়ের উপনয়নের আয়োজন করেছেন তাঁরা। বাবা বসন্তের কোলে হলুদ শাড়ি আর রংবেরঙের গয়না পরা কৈরভীকে দেখতে দুপুরে সেই বাড়ির সামনে পড়শিদের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেল। এত দিন তুতো দাদাদের উপনয়ন দেখেছে কৈরভী। কিন্তু এ বার তার পৈতে! বছর দশেকের কৈরভীর কথায়, ‘‘মা বলেছে, আজ আমার আবার জন্ম হল। দ্বিতীয় জন্ম!’’

বসন্ত জানান, হঠাৎ ইচ্ছে থেকে নয়, তথ্য-প্রমাণের উপরে ভিত্তি করেই তাঁদের কন্যার ‘দ্বিজত্ব’ প্রাপ্তির অনুষ্ঠান করেছেন তাঁরা। মেয়েদের হৃত অধিকার ফিরে পাওয়া উচিত— এই ধারণা থেকেই তাঁদের এই সিদ্ধান্ত। কৌশানী বলেন, ‘‘সন্তান পুত্র হোক বা কন্যা, মা-বাবার কাছে তারা সমান। সমান তাদের অধিকার। তাই মেয়ের পৈতে দিচ্ছি।’’

সম্প্রতি কলকাতার এনআরএস হাসপাতাল থেকে মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে শল্য চিকিৎসক পদে বদলি হয়েছেন বসন্ত। স্ত্রী কৌশানী শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ। কলকাতায় বিসি রায় চাইল্ড হাসপাতালে কর্মরত। থাকেন কলকাতার যাদবপুরে। মেয়ে কৈরভী কলকাতার একটি সিবিএসই অনুমোদিত স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। কৈরভীর ডাকনাম জ্যোৎস্না। মা কৌশানী জানান, মেয়ের পৈতের অনুষ্ঠানের জন্য লোকজনকে নিমন্ত্রণ করতে গিয়ে বহু প্রশ্নের সামনে পড়তে হয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘ব্রাহ্মণ পরিবারে তো ছেলেদের পৈতে হয়ই। কিন্তু মেয়ের পৈতে! কত জনকে যে জবাব দিতে হয়েছে! বোঝাতে হয়েছে, কেন আমরা মেয়ের পৈতে দিচ্ছি।’’

দম্পতি জানান, ২০১৪ সালে কৈরভীর অন্নপ্রাশনের অনুষ্ঠান হয়েছিল। সেই সময়েও যজ্ঞ করতে রাজি ছিলেন না পুরোহিত। তাঁর মত ছিল, কেবল পুত্রসন্তানের অন্নপ্রাশনের ক্ষেত্রেই যজ্ঞ হয়ে থাকে। শুধু মেয়েদের বিয়ের সময় যজ্ঞ করা যায়। তখন এর তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন বসন্তের বাবা বাঁশরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। বসন্ত বলেন, ‘‘বাবা মানতেন, ধর্মেকর্মে এ রকম বিধিনিষেধ থাকা উচিত নয়। পরে পঞ্জিকা ঘেঁটে বাবা দেখিয়ে দিয়েছিলেন, মেয়ের অন্নপ্রাশনের অনুষ্ঠানে যজ্ঞে কোনও বাধা নেই। আমরা তখন থেকেই ঠিক করেছিলাম যে, মেয়ের পৈতেও দেব।’’ সেই মতো বই ঘেঁটে, ইস্কন ও বারাণসীর পাণিনি কন্যা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে কলকাতার আর্য সমাজ মন্দির, রবিশঙ্করের বৈদিক ধর্মসংস্থান—সব জায়গা থেকে খোঁজখবর নিয়েই দম্পতি নিশ্চিত হন যে, কন্যারও উপনয়ন দেওয়া সম্ভব।

যদিও আধুনিক সময়ে দাঁড়িয়ে উপনয়নের প্রাসঙ্গিকতা নিয়েই প্রশ্ন তুলে থাকেন অনেকে। বিশ্বভারতীর প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য সবুজকলি সেন বলেন, ‘‘উপনয়ন ছেলেরই হোক বা মেয়ের, আধুনিক মুক্তমনা সমাজে এই প্রথার কোনও গুরুত্ব থাকা উচিত নয়। উপনয়ন নিলেই যে সে সমাজে উঁচু হয়ে যাবে— এই মানসিকতার পরিবর্তন হয়েছে। জাত, ধর্ম, লিঙ্গ, বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের সমান অধিকারই আধুনিক সমাজের মূল কথা।’’ বৈদিক যুগের রীতি-রেওয়াজ বর্তমান সময়ে মানার কোনও অর্থ আছে বলে মনে করেন না নবদ্বীপের সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত শুভেন্দুকুমার সিদ্ধান্তও।

অন্য বিষয়গুলি:

Birbhum
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE