প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র
রাজনৈতিক ‘মাইলেজ’ পেতে পশ্চিমবঙ্গকে নিশানা করছে কেন্দ্রীয় সরকার। প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি এ কথাই বললেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ে। সোমবার ভিডিয়ো কনফারেন্সে সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে বৈঠকে বসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কোভিড মোকাবিলার রণনীতি নির্ধারণের সেই বৈঠকে মোদীকে মমতার পরামর্শ— এটা পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার সময়, পরস্পরের দিকে আঙুল তোলার সময় নয়। সংক্রমণ মোকাবিলায় প্রত্যাশিত ফল মেলেনি বলে দায় রাজ্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, ইঙ্গিতে এই অভিযোগও এ দিন তুলে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এ দিনের ভিডিয়ো কনফারেন্সে সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীই যে নিজের নিজের কথা বলবেন, তা আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। এর আগের ভিডিয়ো কনফারেন্সে বলার ইচ্ছা প্রকাশ করেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলার সুযোগ পাননি। ফলে এ দিন যে তিনি অনেক কথাই বলবেন, রাজনৈতিক শিবির তা আন্দাজ করেছিল। করোনা পরিস্থিতির মোকাবিলা, লকডাউন কার্যকর করা, পরিযায়ী শ্রমিকদের ফেরানো-সহ বিভিন্ন ইস্যুতে কেন্দ্রের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চাপানউতোর যে রকম বাড়ছিল, তার প্রেক্ষিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষণের গুরুত্ব আরও বেড়ে গিয়েছিল। কী বলেন মমতা, গোটা বাংলার রাজনৈতিক শিবিরের চোখই ছিল সে দিকে। তবে কেন্দ্রের ভূমিকা এবং আচরণ প্রসঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন যতটা খোলাখুলি মুখ খুলেছেন, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই ততটা আঁচ করতে পারেননি আগে থেকে।
করোনা সংক্রমণের জেরে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে কেন্দ্র ও রাজ্যকে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে হবে, কেন্দ্রের নেতৃত্ব মেনে কাজ করতে রাজ্য প্রস্তুতও, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে সম্মান জানানোর কথা ভুললে চলবে না— এ বার্তা এ দিন খুব জোরের সঙ্গেই দিতে চেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, ‘‘আপনাকে এবং এখানে উপস্থিত অন্য সব অঙ্গরাজ্যকে আমি আশ্বস্ত করতে চাই, বাংলার মানুষ সত্যিকারের যুক্তরাষ্ট্রীয় ভাবনা থেকে এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ ভাবে মানবতার ভাবনা থেকে আপনাদের পাশে রয়েছে।’’ ভাষণের শেষ বাক্যেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফের বলেছেন, ‘‘যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপরে কিছুতেই বুলডোজার চালানো যাবে না।’’
আরও পড়ুন: বাড়ি ফিরতে চাওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু ঠেকাতে হবে সংক্রমণও: মোদী
কোভিডের মোকাবিলায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে ভাবে কাজ করছে, কেন্দ্রীয় সরকার তাতে ‘বাধা’ সৃষ্টি না করে ‘সহযোগিতা’ করুক— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নানা ভাবে এ দিন এই বার্তাই দিতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীকে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার বার বার নানা নির্দেশিকা পাঠিয়ে এবং কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক দল পাঠিয়ে রাজ্যের কাজকে কঠিন করে তুলছে বলে তাঁর অভিযোগ। কেন্দ্রীয় দল পরিদর্শন এবং পর্যবেক্ষণের নামে যা করছে, তাতে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্তাদের অনেকটা সময় নষ্ট হয়েছে বলে মুখ্যমন্ত্রী এ দিন সরাসরি অভিযোগ করেছেন। রাজ্যের কর্মপদ্ধতি নিয়ে কেন্দ্রীয় দল যে সব প্রশ্ন তুলেছে, তাতে যে তিনি মোটেই সন্তুষ্ট নন, মুখ্যমন্ত্রী তা-ও বেশ স্পষ্ট করেই বুঝিয়ে দিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘যে সব রাজ্য থেকে বেশি সংক্রমণের খবর আসবে, তাদের দিকে আঙুল তোলা উচিত নয়, কারণ এটা রাজ্যের বা রাজ্যবাসীর দোষ নয়।’’ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হলে মহারাষ্ট্র, গুজরাত, তামিলনাডু বা খোদ রাজধানী দিল্লির সরকারকে নিয়েও যে প্রশ্ন উঠতে পারে, সে কথা সরাসরি না বলেও ইঙ্গিতে এ দিন বুঝিয়ে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কারও দিকে আঙুল তোলা উচিত নয় বলে মন্তব্য করার পরেই তিনি বলেন, ‘‘মুম্বই, আমদাবাদ, চেন্নাই, দিল্লির মতো শহরের মানুষের প্রতি আমি সহানুভূতিশীল এবং এই অবকাশে আমি তাঁদের বলতে চাই যে, এই সঙ্কটের সময়ে আমরা বাংলার মানুষের পাশে যতটা রয়েছি, ততটাই তাঁদের পাশেও রয়েছি।’’
একটি অঙ্গরাজ্যের সরকারের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট ভাবে আঙুল তোলা এই পরিস্থিতিতে কতটা যুক্তিযুক্ত, সে প্রশ্ন তুলতে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন প্রধানমন্ত্রীকে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, এই রোগ দেশের বাইরে থেকে এসেছে। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা সবাই জানি, এই ভাইরাস ভারতের বাইরে থেকে এসেছে। তার পরেও যখন আমরা অন্য কোনও দেশের দিকে আঙুল তুলছি না, তখন কেন আমরা আমাদের নিজেদের রাজ্যগুলোর দিকেই আঙুল তুলছি?’’
আরও পড়ুন: গুজরাত-সহ বিভিন্ন রাজ্য হিসেব কষছে কো-মর্বিডিটির, পাল্টা আক্রমণে তৃণমূল
সাফল্যের কৃতিত্ব যদি কেন্দ্রের হয়, তা হলে ব্যর্থতার দায়ও কেন্দ্রকেই নিতে হবে, এই বার্তাও এ দিন স্পষ্ট ছিল পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণে। তাঁর কথায়, ‘‘এখনও পর্যন্ত কেন্দ্রই গোটা দেশে কোভিড মোকাবিলা অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং আমরা অনুসরণ করেছি। যখন দেখছেন যে প্রত্যাশিত ফল মেলেনি, তখন আপনারা দায়টা রাজ্যগুলোর ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারেন না।’’
কেন্দ্রের বিরুদ্ধে রাজনীতি করার অভিযোগ তুলেছেন এ দিন মমতা। তিনি ওই বৈঠকে বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে একাধিক আন্তর্জাতিক সীমান্ত এবং কয়েকটি বড় রাজ্যের সীমানা রয়েছে। এত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও করোনাভাইরাসের মোকাবিলায় রাজ্য খুব ভাল কাজ করছে। এ নিয়ে রাজনীতি করা উচিত নয় কেন্দ্রের। এটা রাজনীতি করার সময় নয়।’’ কেন্দ্রকে নিশানা করে মমতা এ দিন আরও বলেন, ‘‘যে কোনও কারণেই হোক, রাজনৈতিক মাইলেজ পেতে পশ্চিমবঙ্গকে নিশানা করেছে কেন্দ্র।’’ এই প্রসঙ্গেই তিনি বলেন, ‘‘আমরা যখন আপনাদের সহযোগিতা করছি, আপনারা কেন আমাদের আক্রমণ করে চলেছেন? কেন সব সময় বেঙ্গল, বেঙ্গল বেঙ্গল? কেন সব সময় সমালোচনা?’’
কয়েক দিন আগেই পরিযায়ী শ্রমিকদের ফেরাতে রাজ্য অনীহা দেখাচ্ছে বলে অভিযোগ তুলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি লেখেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে মমতা সেই অভিযোগ খারিজ করে বলেছেন, ‘‘প্রতিবেশী রাজ্যগুলো থেকে বাসে করে বহু মানুষ এসেছেন। বাংলার মধ্য দিয়ে অন্য রাজ্যেও গিয়েছেন প্রচুর মানুষ। আমরা তাঁদের জন্য অভ্যন্তরীণ পরিবহণ ব্যবস্থা করেছি। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ১ লাখেরও বেশি মানুষ ইতিমধ্যেই এসে গিয়েছেন।’’ একই সঙ্গে রাজ্যের সমস্যার কথাও তুলে ধরে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, ‘‘আপনি নিশ্চয়ই সম্মত হবেন, এঁদের সকলকে গ্রহণ করার কাজটা একটা রাজ্যের পক্ষে কতটা বিপুল। অভ্যর্থনা থেকে শুরু করে নির্দিষ্ট স্বাস্থ্যপরীক্ষা, খাবার থেকে শুরু করে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় তাঁদের বাড়ি বাড়িতে পৌঁছনোর ব্যবস্থা— সবটাই করতে হয়। যে রাজ্য থেকে তাঁরা এসেছেন, সেই সব রাজ্যের সঙ্গে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং তথ্যের আদানপ্রদান না করলে এ কাজটা সম্ভবই নয়। এঁদের আর কোনও কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হোক, এটা আমরা চাই না।’’ কেন্দ্রের আরও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে এগনো উচিত ছিল বলেও মত প্রকাশ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
১৭ মে-র পর থেকে লকডাউন কি আরও শিথিল করা উচিত, এ প্রসঙ্গেও এ দিন মুখ খুলেছেন মমতা। মুখ্যমন্ত্রীদের এ দিনের বৈঠকে তিনি বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকার যখন স্থলসীমান্ত, বিমানবন্দর খোলা থেকে শুরু করে ট্রেন চালানো— প্রায় সমস্ত কিছুই খুলে দিচ্ছে, তখন ফের লকডাউন চালিয়ে যাওয়ার কারণ কী থাকতে পারে। এক দিকে কেন্দ্র সব এক এক করে খুলে দিচ্ছে, আর রাজ্যকে বলা হচ্ছে উদ্ভুত পরিস্থিতি সামাল দিতে। এক হাতে লকডাউনের নির্দেশ, আর অন্য হাতে সব কিছু খুলে দেওয়া হচ্ছে আস্তে আস্তে—এটা স্ববিরোধ। এই পরিস্থিতিতে মারণ ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া নিয়ন্ত্রণের কাজটি আমাদের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন। ভাল হয়, যদি রাজ্য তার বাস্তব পরিস্থিতি দেখে এবং ক্ষমতা অনুযায়ী কী কী বিষয়ে অনুমতি দেওয়া হবে সে সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে।’’ একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘আমরা ইতিমধ্যেই ভুটান এবং বাংলাদেশের মধ্যে পণ্য পরিবহণে অনুমতি দিয়েছি। বাংলাদেশে ট্রেনেও পণ্য পরিবহণ করা যেতে পারে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy