কাঠপাটি স্টেশনে ট্রেনে ওঠার পর। ছবি: লেখক।
খড়্গপুর স্টেশন ঢুকছে। কত্ত দিন পর যে নিজেকে মুক্ত লাগছে!
ঠিক ৫৬ দিন আগে এই স্টেশনের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় মেয়েকে নিয়ে মনের ভেতর একটা উদ্বেগ ছিল। তখনও জানা ছিল না, ভিন্রাজ্যে তার পরের দু’মাসের প্রায় বেশির ভাগটাই ঘুমহীন হয়ে কাটাতে হবে! থাকতে হবে একেবারে বন্দি। প্রাণের ভয় টের পাওয়ার চেয়ে খাবারের চিন্তা যে মানুষকে কী ভাবে দুমড়ে দেয়, তা বুঝিয়েছে এই দু’মাস। আর পকেটে পয়সা ফুরিয়ে এলে তা যে প্রাণভয়ের চেয়েও মারাত্মক, এ ক’দিনে হাড়ে হাড়ে বুঝেছি। তবে, এখন আমি মুক্ত! আমরা মুক্ত! খড়্গপুর থেকে আমাদের বাড়ি যদিও অনেকটাই দূর। কখন পৌঁছব জানি না। তবে, নিজের রাজ্যে ফিরে আসার আনন্দ আপাতত ঘিরে রয়েছে আমাদের।
গতকাল দুপুর ১২টা নাগাদ তামিলনাড়ুর কাঠপাটি থেকে যখন ট্রেনটা ছাড়ল, সেই প্রথম মুক্তির স্বাদটা টের পেয়েছিলাম জানলার বাইরের আকাশটাকে দেখে। মাসখানেক হয়ে গিয়েছে, আকাশের দিকে তাকানোই হয়নি। এই কাঠপাটিতেই গত ২০ ফেব্রুয়ারি নেমেছিলাম আমরা চার জন। মাথায় তখন অন্য চিন্তা। মেয়েটার স্পাইনাল কর্ডে একটা টিউমার ধরা পড়েছে। সেটার অপারেশন। টাকাপয়সা যেখানে যা ছিল, নিয়েই এসেছিলাম। ডাক্তাররা বলেছিলেন, দিন পনেরোর মধ্যে সবটা মিটে যেতে পারে। কিন্তু, হঠাৎ করেই মেয়ের সুগার ধরা পড়ল। অতিরিক্ত উদ্বেগ থেকেই সুগার বেড়েছে বলে জানাল হাসপাতাল। সেটা স্বাভাবিক হতেই নতুন করে অপারেশনের ডেট পাওয়া গেল ১৮ মার্চ। ‘মেজর’ সেই অপারেশনের পর ওকে ভেলোরের হাসপাতাল ছেড়ে দিল ২০ তারিখ। পরবর্তী দেখানোর দিন ২৬ মার্চ।
কিন্তু ২৫ তারিখ থেকে হঠাত্ শুরু হয়ে গেল লকডাউন। আর আমরা আটকে পড়লাম লজে। ২৬ মার্চ মেয়েকে দেখে চিকিৎসকেরা জানিয়ে দিলেন আবার ১ বছর পর দেখাতে হবে। কিন্তু বাড়ি ফিরব কী করে! হাতে সামান্য ক’টা টাকা। লজের বিল আর খাওয়াদাওয়া— কী ভাবে যে সে সব হবে, ভেবেই কুল পাচ্ছিলাম না! প্রতি দিন লজের ভাড়া ৩৩০ টাকা। আর চার জনের খাওয়াদাওয়া? খুব কম করে হলেও তো ৪০০ টাকা। সব মিলিয়ে অন্তত হাজারখানেক! মাথায় কিছুই আসছিল না। সকালে এক বার স্থানীয় বাজারে যাই। রেঁধেবেড়ে খাওয়া আর লজবন্দি জীবন। এর মধ্যে স্থানীয় প্রশাসন আমাদের জন্য তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা করল বটে, কিন্তু রোজ সে খাবার জোটে না। আমাদের লজে সব মিলিয়ে ২৫টা পরিবার। সকলেই চিকিৎসা করাতে এসেছেন ভেলোরে। ২৫ পরিবারে অন্তত ৬৫ জন। কিন্তু খাবারের প্যাকেট ১৫টি। একটা প্যাকেট এক জনের জন্য ঠিকঠাক। কাজেই...
ভিন রাজ্য থেকে চিকিৎসা করাতে আসা মানুষদের কাছ থেকে থাকা-খাওয়ার খরচা নেওয়া যাবে না। জেলা প্রশাসনের নোটিস।
প্রথম দফার লকডাউন শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত দাঁতে দাঁত চেপে অপেক্ষা করছিলাম। তার পর সেটা বেড়়ে গেল। আমাদের ফেরানোর কথা কেউ বলে না। লজে টিভি নেই। ভিন্রাজ্যের ভাষা বুঝি না। তাই খবরের কাগজও পড়তে পারতাম না। একটা সময়ের পর কাগজ আসাও বন্ধ হয়ে গেল। দিন-রাত বাড়িতে বসে বসে অস্থির। তার পর ফের বেড়ে গেল লকডাউন। ৩ মে পর্যন্ত। এক দিন বাজারে গিয়ে শুনলাম, কারা যেন হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফেরার প্ল্যান করেছে। ঘরে এসে বললাম। আমার মেয়েটা, যে এখনও বিছানায় একটু সময় বসে থাকলেও পিঠের ব্যথা অনুভব করে, শুয়ে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে, সেই মেয়ে কি না আমাকে বলল, ‘‘বাবা, চলো, আর ভাল লাগছে না। এখানে থাকলে... আমি... হেঁটেই চলো। যেটুকু পারব হাঁটব। তার পর আবার বসে পড়ব। তার পর আবার হাঁটব। বাড়ি যাব, বাবা, বাড়ি যাব।’’ ওর মা, মুখে হাত চাপা দিয়েছিল। কান্না চাপা যে কত কঠিন, সেটা বুঝেছিলাম আমরা।
আরও পড়ুন: কণিকা কপূরের প্লাজমা করোনা গবেষণার জন্য ব্যবহার করা হবে না
এর মধ্যে প্রথম দফার লকডাউনের পর বাড়তি চাপ হয়ে উঠেছিল লজভাড়া। তামিলনাড়ু সরকারের নির্দেশে প্রথম দফায় লজভাড়া দিতে হয়নি আমাদের। কিন্তু দ্বিতীয় দফার লকডাউন থেকে সেটা আর রইল না। সরকার বলল, ৫০ শতাংশ ভাড়া দিতে হবে। কিন্তু লজ মালিকরা শেষ পর্যন্ত পুরো টাকাই আদায় করে ছাড়ল, জোর করেই।
আরও পড়ুন: করোনা লড়াইয়ে চিকিৎসা কর্মীদের জন্য ‘বর্ম’ তৈরি করছে ৯ বছরের স্কুল পড়ুয়া
এক দিন দিন দুপুরে আমরা লজের অনেকে মিলে ভেলোরের জেলাশাসকের অফিসে গেলাম। শুনে এলাম, কোনও খবর নেই। খবর এলে আমাদের জানানো হবে। মাঝে এক দিন প্রতিবাদ বিক্ষোভও দেখালাম জেলাশাসকের দফতরের সামনে। হেঁটে গেলাম হাসপাতাল পর্যন্ত। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙার জোগাড়। কেউ কোনও কিছু জানে না। শাকসব্জি বাদে সব কিছুর দাম বেড়ে যাচ্ছে। আর পকেট একেবারে ফাঁকা। দক্ষিণ ২৪ পরগনার মহেশতলার শিবরামপুরে আমার একটা ছোট স্টেশনারি দোকান। সেখানকার এক পরিচিতকে ফোন করে বললাম, কিছু টাকা পাঠাতে। কিন্তু আমার তো এটিএম কার্ডই নেই। কী করে তুলব? তাই লজেরই অন্য এক ভদ্রলোকের অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠালেন ওই পরিচিত। তিনি আবার আমাকে তুলে দিলেন। চালাতে হবে তো!
চিকিৎসা করাতে গিয়ে ভেলোরে আটকে পড়া মানুষ জন জেলাশাসকের কার্যালয়ে।
এর মধ্যেই গত ৬ মে জেলাশাসকের দফতর থেকে আমাদের লজে লোক এল। একটা ফর্ম ফিলআপ করিয়ে নিয়ে গেলেন তিনি। সকলেরই। এর পর ৯ তারিখ আমাদের একটা পাস এল। সেখানে লেখা ১২ তারিখ সকালে জিনিসপত্র-নথিপত্র নিয়ে চিত্রা হলের সামনে গিয়ে এই পাস ভেরিফাই করাতে হবে। সেই মতো জিনিসপত্র গুছিয়ে আমরা চার জন অটো করে গেলাম চিত্রা লজ। আধারকার্ড-সহ বিভিন্ন নথি দেখে ভেরিফিকেশনের পর আমাদের থার্মাল স্ক্রিনিং করা হল। তার পর তুলে দেওয়া হল একটা বাসে। সামাজিক দূরত্ব বিধি মেনেই বসলাম। তা হলে আমরা কি বাড়ি ফিরছি? বুঝতে পারছিলাম না।
অবশেষে সেই কাঠপাটি স্টেশন পৌঁছল বাস। নামার পর আমাদের আমার থার্মাল স্ক্রিনিং করা হল। তার পর হাতে দেওয়া হল ট্রেনের টিকিট। সেখানে কোনও কোচ নম্বর, সিট নম্বর, বার্থ নম্বর নেই। প্রচুর মানুষ। আমরা একটা কোচে গিয়ে বসলাম। কোনও আসনই খালি নেই। শেষ পর্যন্ত বাড়ি ফিরছি আমরা? ভেবেই যে কি ভাল লাগল। কাঠপাটির আকাশ একেবারে পরিষ্কার। অনেকটা আমাদের মনের মতো।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসকের দফতর থেকে ফোন করে জানানো হয়েছে, আমাদের খড়্গপুর নামতে হবে। সেখানে এক প্রস্থ স্বাস্থ্য পরীক্ষা। তার পর বাসে করে মহেশতলা। এখানেই শেষ নয়, তার পর আরও ১৪ দিন কোয়রান্টিন।
খড়্গপুর স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম ঢুকছে। আমাদের রিসিভ করতে অনেকেই এসেছেন মনে হচ্ছে। স্বাস্থ্য দফতরের লোকজন, সরকারি আধিকারিকরাই হবেন! নামার পর আবার পরীক্ষা। তার পর বাড়িতে গিয়ে কোয়রান্টিন। সে হোক, তা-ও তো নিজের রাজ্যে, নিজের বাড়িতে থাকব! এটা যে কী স্বস্তি দিচ্ছে আমাদের। আর বন্দি নই, মুক্ত। আমি মুক্ত। আমরা মুক্ত এখন।
(লেখক দক্ষিণ ২৪ পরগনার মহেশতলার বাসিন্দা। মেয়েকে চিকিৎসা করাতে নিয়ে গিয়ে ভেলোরে আটকে পড়েছিলেন)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy