চলছে কড়া পুলিশি প্রহরা। ছবি: এএফপি।
রাজ্যে কোথাও কোথাও গোষ্ঠী-সংক্রমণ শুরু হয়েছে বলে জানিয়ে দিল রাজ্য সরকার। এই পরিস্থিতিতে সোমবার নবান্নে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে স্থির হয়েছে, সংক্রমণের শৃঙ্খল ভাঙতে আগের মতো সম্পূর্ণ লকডাউন-বিধি কার্যকর করবে সরকার। তবে আপাতত সপ্তাহে দু’দিন করে গোটা রাজ্যে সম্পূর্ণ লকডাউন থাকবে। সরকারের ইঙ্গিত, অগস্ট মাসেও এই পদ্ধতি কার্যকর থাকবে। বিভিন্ন জেলা থেকে পাওয়া সংক্রমণ-তথ্য, স্বাস্থ্য দফতরের রিপোর্ট, বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য—এই সব কিছু নিয়ে এ দিন বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখ্যসচিব রাজীব সিংহ, স্বরাষ্ট্রসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজ্য পুলিশের ডিজি বীরেন্দ্র, কলকাতার পুলিশ কমিশনার অনুজ শর্মা এবং এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) জ্ঞানবন্ত সিংহ।
বৈঠকের পরে স্বরাষ্ট্রসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “পশ্চিমবঙ্গ সরকার মনে করছে, সংক্রমণের যে শৃঙ্খল তৈরি হয়ে যাচ্ছে, তা ভাঙা দরকার। শৃঙ্খল ভাঙার সেই কাজ আরও কঠোর ভাবে করতে হবে। কোভিড-১৯ ছড়াচ্ছে। ক্রমশ মনে করা হচ্ছে, গোষ্ঠীতেও সংক্রমণ ছড়ানো শুরু হয়েছে। বিভিন্ন স্তরের বিজ্ঞানী, বিশেষজ্ঞ, সব সংশ্লিষ্ট মহলের সঙ্গে আলোচনা করে ধারণা করা হচ্ছে, কিছু কিছু গোষ্ঠী সংক্রমণ হচ্ছে। স্বাস্থ্য দফতরের রিপোর্ট নিয়ে চর্চা হয়েছে।’’ শনিবার অবশ্য মুখ্যসচিব রাজীব সিংহ জানিয়েছিলেন, সংখ্যা বাড়লেও সম্পূর্ণ লকডাউনের পথে হাঁটছে না রাজ্য।
এই পরিস্থিতিতে সরকারের সিদ্ধান্ত, চলতি সপ্তাহে বৃহস্পতি এবং শনিবার গোটা রাজ্যে লকডাউন কার্যকর করা হবে। আগামী সপ্তাহে বুধবার গোটা রাজ্যে লকডাউন হবে। ওই সপ্তাহে দ্বিতীয় কোন দিনটিতে পূর্ণ লকডাউন থাকবে, তা আগামী সোমবার ঘোষণা করবে সরকার। এই ভাবে প্রতি সপ্তাহের সোমবার বৈঠক করে সেই সপ্তাহের লকডাউন-দিনগুলি ঘোষণা করা হবে। চলতি মাস প্রায় শেষের পথে। নতুন তথা সার্বিক লকডাউন ব্যবস্থা কত দিন চলবে, তা এখনই স্পষ্ট করেনি রাজ্য। তবে স্বরাষ্ট্রসচিব জানিয়েছেন, অগস্ট মাসেও সপ্তাহভিত্তিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার প্রক্রিয়া চলবে। তার থেকেই প্রশাসনিক মহলের অনুমান, অগস্ট মাসেও এই ব্যবস্থা কার্যকর থাকতে পারে।
সাপ্তাহিক লকডাউন
• চলতি সপ্তাহে রাজ্য জুড়ে সম্পূর্ণ লকডাউন বৃহস্পতিবার, শনিবার।
• আগামী সপ্তাহে বুধবার। অন্য দিনটি সোমবার জানানো হবে।
• প্রতি সোমবার সপ্তাহের লকডাউনের দিন ঘোষণা।
• অফিস-কাছারি, পরিবহণ বন্ধ থাকবে পুরোপুরি।
আরও পড়ুন: মমতার মাস্টারস্ট্রোক, রোগ ছড়ানো কমবে, মত বিশেষজ্ঞদের
আরও পড়ুন: করোনা সংক্রমণ সামলাতে প্রতি শনি, রবি বন্ধ ব্যাঙ্ক
স্বরাষ্ট্রসচিবের কথায়, “এ রাজ্যই সংক্রমণের শৃঙ্খল ভাঙতে প্রথমাবধি যে ধরনের কর্মসূচি নিয়েছিল, তাতে এখানেই প্রথম লকডাউন, আন্তর্জাতিক উড়ান বন্ধ এবং ট্রেন চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ বা বন্ধ হয়েছিল। ফলে প্রয়োজন মতো কাজের গতিতে সপ্তাহে দু’এক দিন আচমকা বিরতি দিলে এবং লকডাউনের মতো অন্যান্য কাজ একেবারে বন্ধ করলে তার সুফল পাওয়া যেতে পারে। সকলের সঙ্গে পরামর্শ করে মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এখন থেকে প্রতি দিন আলোচনা হবে। সপ্তাহে দু’দিন করে সম্পূর্ণ লকডাউন নিশ্চিত করা হবে। অফিস-কাছারি, পরিবহণ বন্ধ থাকবে পুরোপুরি। আগের লকডাউন পর্বের মতোই তা কার্যকর হবে। অগ্রিম ঘোষণা হলে সব অফিস, প্রতিষ্ঠান, পরিবহণ ইত্যাদি ক্ষেত্র আগাম প্রস্তুতি নিতে পারে। অগস্টে এ ভাবেই বৈঠক হতে থাকবে। আপাতত ২৯ জুলাই পর্যন্ত জানানো হল।” প্রশাসনিক মহল মনে করছে, এই ব্যবস্থায় আগের মতোই জরুরি পরিষেবা বাদে সব ধরনের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের আওতায় আসবে।
নিয়ম মানাই জরুরি
আমার মতে, লকডাউন একটানা হওয়া উচিত। ওড়িশা যে পথে চলছে সেটাও মন্দ নয়। সেখানে সপ্তাহের কাজের দিনগুলিতে সব কিছু ৩-৪ ঘণ্টা খোলা থাকছে। শনি-রবিবার পুরো বন্ধ। অর্থনীতির কথা মাথায় রেখে কাজের দিনগুলিতে যে সময় খোলা থাকছে, তখনও শারীরিক দূরত্ববিধি মেনে চলতে হচ্ছে। তাতে ওড়িশায় সংক্রমণের হার কমেছে। মোদ্দা কথা হল, লকডাউন যেমনই হোক, তা কড়া ভাবে মানতে হবে। নইলে কোনও লাভ নেই।
দীপিকা শূর
প্রাক্তন সেক্রেটারি-জেনারেল, ইন্ডিয়ান পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন
প্রতি সপ্তাহে দু’দিন লকডাউনে কতটা সাফল্য মিলেছে, তার কোনও নজিরের কথা জানা নেই ঠিকই। তবে সংক্রমণ রোধে সকল পদক্ষেপেই একটা ধারণায় আস্থা রেখে করা হচ্ছে। সপ্তাহে দু’দিন লকডাউন করার মধ্যেও নিশ্চয় একটা ভাবনা রয়েছে। কিন্তু লকডাউন ক’দিন, তার চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, নিয়ম মেনে চলা। এই ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষমতা কয়েক গুণ বেশি। মাস্ক ছাড়া একজন সংক্রমিত ব্যক্তি কথা বললে বা তাঁর কাশি থেকে অসংখ্য পরিমাণে ভাইরাস বেরোয়। উপসর্গের সংখ্যা যেখানে বেশি, তখন কে সংক্রমিত বুঝবেন কী করে? সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ভাইরাস ছড়ানোর পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে হবে। লকডাউন তার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
শুভজিৎ বিশ্বাস, ভাইরোলজিস্ট
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব কেমিক্যাল বায়োলজি
খুবই ভাল সিদ্ধান্ত। পূর্ণ লকডাউন এবং কোনও লকডাউন নয়, এই দুটো ধারণার মধ্যে ভারসাম্য থাকবে এ ক্ষেত্রে। তবে এই লকডাউন পুরোপুরি মেনে চলার দায়িত্ব সম্পূর্ণ জনগণের। ৯০ শতাংশ মানুষও নিয়মবিধি কঠোর ভাবে মেনে চললে সংক্রমণ লক্ষ্যণীয় ভাবে কমবে। লকডাউন ছাড়া বাকি দিনগুলোতেও দূরত্ববিধি-সহ বাকি সব নিয়ম জনগণকে মেনে চলতেই হবে। তাঁদের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি।
দীপক সুব্রামণি
অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, আইআইএসসি, বেঙ্গালুরু
আনলক পর্বের শুরুতে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, গোটা রাজ্যে ৩১ জুলাই পর্যন্ত লকডাউন থাকবে। সংক্রমণের হার বাড়তে থাকায় গত ৯ জুলাই থেকে কন্টেনমেন্টের চরিত্র এবং পরিধি বাড়িয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলিতে লকডাউন-নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করেছে রাজ্য। ১৫ জুলাই থেকে শহরভিত্তিক লকডাউনও চলছে একাধিক জেলায়। রাজ্য সরকারের এ দিনের ঘোষণায় এই দু’টি পদ্ধতি পাল্টাচ্ছে না। বরং সপ্তাহের দু’দিন গোটা রাজ্যে সম্পূর্ণ লকডাউনের পাশাপাশি কন্টেনমেন্ট
জ়োন এবং শহরভিত্তিক লকডাউন ব্যবস্থাও কার্যকর থাকবে। স্বরাষ্ট্রসচিবের কথায়, “এখন যেমন কন্টেনমেন্টভিত্তিক পদক্ষেপ হচ্ছে, তার পাশাপাশি, সপ্তাহে দু’দিন সম্পূর্ণ লকডাউন করা হবে।”
সম্প্রতি বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের দুই গবেষক অধ্যাপক শশিকুমার গণেশন ও দীপক সুব্রামণি গত ২৩ মার্চ থেকে ১৮ জুন—তিন মাসের সংক্রমণের হারকে গণিতিক মডেলে ব্যবহার করে আগামী ছয় মাসে দেশের সংক্রমণের চিত্রটি কেমন হবে, তা বিশ্লেষণ করেন। তাতে তাঁরা দেখিয়েছেন, অন্তত সপ্তাহের মাঝে ও শেষে এক দিন করে লকডাউন করা হলে সংক্রমণের শৃঙ্খল অনেকটাই ভাঙতে পারে। কমবে পারে আক্রান্তের সংখ্যা। গবেষকদের মতে, সপ্তাহের মাঝে বা সপ্তাহান্তে এক বা দু’দিনের ওই লকডাউন সংক্রমণের শৃঙ্খল (চেন)-কে ভাঙতে সক্ষম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy