রাজ্য বিজেপির ফেসবুক পেজে বিশ্বকর্মার প্রবীণ রূপ।
বিশ্বকর্মা নবীন না প্রবীণ?
বুধবার রাজ্য বিজেপির তরফে বিশ্বকর্মা পুজোর শুভেচ্ছা জানিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট করা হয়েছিল। তাতে বিশ্বকর্মার মুখে সাদা গোঁফ-দাড়ি, বাহন হাঁস। বাঙালির বিশ্বকর্মার এমন রূপ বদলে প্রতিবাদ শুরু হওয়ার পর ছবি বদলে দেয় বিজেপি। শুভেচ্ছাবার্তায় ফিরে আসেন বাঙালির নবীন বিশ্বকর্মা। তবে খড়্গপুরে রেল কারখানার ‘এয়ার কন্ডিশনার শপ’-এ পূজিত হয়েছেন বৃদ্ধ বিশ্বকর্মা।
ইতিহাসবিদদের একাংশ কিন্তু বলছেন, বিশ্বকর্মার ‘আদি রূপে’ সাদা গোঁফ, দাড়ি ছিল। বাহন রাজহাঁস। উত্তর ও পশ্চিম ভারতে সেই রূপেই পূজিত হন বিশ্বকর্মা। হিমাচল প্রদেশের মান্ডিতে বিশ্বকর্মার মন্দিরে সেই বৃদ্ধবেশের সন্ধান মেলে। বাংলায় এসে তাঁর রূপ বদলেছে। রাজহাঁসও লুপ্ত হয়েছে। বঙ্গভূমিতে তিনি হস্তীবাহন। খড়্গপুরের প্রবীণ নাগরিকেরা বলছেন, রেল শহরে বিভিন্ন প্রদেশের মানুষের বসবাস। তাই মাঝেমধ্যে বৃদ্ধ বেশে হাজির হন ‘দেবশিল্পী’।
আমেরিকার ইতিহাসবিদ জে গর্ডন মেল্টন তাঁর ‘রিলিজিয়াস সেলিব্রেশন: অ্যান এনসাইক্লোপিডিয়া অব হলিডেজ়, ফেস্টিভ্যাল..’ গ্রন্থে লিখেছেন, বিশ্বকর্মার প্রথম উল্লেখ মেলে বৈদিক সাহিত্যে। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে উল্লিখিত বিশ্বকর্মা আদতে বিশ্বের স্রষ্টা। অনেক ক্ষেত্রে ব্রহ্মার সঙ্গেও তাঁর মিল রয়েছে। সেই সূত্র ধরে বিশ্বকর্মার আদি রূপ বৃদ্ধ এবং তাঁর মুখ সাদা গোঁফ-দাড়িতে ঢাকা। রেল কারখানার পুজোর কর্মকর্তা জয়প্রকাশ নরেশের কথায়, ‘‘ইন্টারনেটে ছবি দেখেই বিশ্বকর্মার এই রূপ তৈরির অর্ডার দিয়েছিলাম শিল্পীকে।’’
রাজ্য বিজেপির ফেসবুক পেজে নবীন রূপেও দেখা গেল বিশ্বকর্মার ছবি।
ব্রিটিশ সংস্কৃত পণ্ডিত এবং ইতিহাসবিদ আর্থার অ্যান্টনি ম্যাকডোনেল তাঁর ‘বেদিক মাইথলজি’ বইয়ে বিশ্বকর্মাকে বিমূর্ত দেবতার মধ্যে ফেলেছেন। তাঁর মতে, আদি বৈদিক সাহিত্যে ‘বিশ্বকর্মন’ উপাধি হিসেবে ব্যবহৃত হত। তবে কয়েকটি ক্ষেত্রে বিশ্বকর্মা নাম-ও মিলেছে। তিনি এ-ও লিখেছেন, বৈদিক সাহিত্যে বিশ্বকর্মার চারটি মুখ দেখা যায়। আবার ধর্মীয় ইতিহাসের অধ্যাপক মারিয়াসুসাই ধবমনি তাঁর ‘ক্ল্যাসিকাল হিন্দুইজ়ম’ বইয়ে লিখেছেন, বৈদিক সাহিত্যে চারটি মুখের সঙ্গে বিশ্বকর্মার ডানারও উল্লেখ রয়েছে।
তবে বৈদিক যুগের পরে বিশ্বকর্মা হয়ে ওঠেন দেব-কারিগর। লঙ্কাপুরী, দ্বারকা নির্মাণের কারিগর তিনি। কথিত আছে, পুরীর জগন্নাথ মন্দির এবং মূর্তিও বিশ্বকর্মার তৈরি। দ্বাদশ শতকে বিশ্বকর্মা সেখানে দেবতার নির্মাতা।
বাংলায় কিন্তু ঔপনিবেশিক যুগের আগে বিশ্বকর্মার প্রভাব সে ভাবে দেখা যায় না। মনসামঙ্গল কাব্যে লখীন্দরের বাসরঘর নির্মাণে বিশ্বকর্মার ডাক পড়েছিল বটে, কিন্তু মহিমান্বিত দেবতার পদ তিনি পাননি। কৃষ্ণচন্দ্র স্মৃতিতীর্থ সম্পাদিত পুরোহিত দর্পণে বিশ্বকর্মার যে দু’পংক্তির ধ্যানমন্ত্র মেলে, সেখানে বিশ্বকর্মাকে ‘সুচিত্র কর্মকার’ তকমা দেওয়া হয়েছে। এই সূত্র ধরেই ইতিহাসের গবেষক জহর সরকারের মতে, বাঙালির বিশ্বকর্মা উত্তর-ঔপনিবেশিক সময়ের ফলাফল। ঊনবিংশ শতক থেকে এ রাজ্যে কলকারখানা তৈরির সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বকর্মাকে শ্রমিকদের দেবতা হিসেবে নিয়ে আসা হয়। সৌর বা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার মেনে পুজোর রীতিও সেই কারণেই, যেখানে দক্ষিণ ভারতে বিশ্বকর্মার পুজো হয় তিথি মেনে, মহানবমীর দিন এবং উত্তর ও পশ্চিম ভারতে দেওয়ালির পরের দিন। জহরবাবুর কথায়, ‘‘বহু দেবতার ক্ষেত্রেই আদি ও পরিবর্তিত রূপ দেখা যায়। বাঙালির বিশ্বকর্মা সেই পরিবর্তিত রূপ।’’
হাতি কী ভাবে বিশ্বকর্মার বাহন হল, তা নিয়ে অবশ্য নির্দিষ্ট মত নেই। তবে ইতিহাসবিদদের অনেকের মতে, হাতি কিছু ক্ষেত্রে জ্ঞান, রাজকীয় শক্তির প্রতীক বহন করে। আবার জহরবাবু হাতিকে নিম্নবর্গের প্রতীক হিসেবে দেখছেন। হাতিকে অবশ্য বৌদ্ধ ধর্মের প্রতীক হিসেবেও দেখা হয়। আদি-মধ্যযুগীয় শিল্পে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির দ্বন্দ্বকে সিংহ এবং হাতির লড়াই হিসেবে চিত্রিত হতে দেখা যায়।
এখন কথা হল, হিন্দুত্বের ধারক-বাহক হিসেবে নিজেদের তুলে ধরে যে দল, সেই বিজেপির রাজ্য শাখা বৃদ্ধ বিশ্বকর্মার ছবি চটজলদি বদলে না দিয়ে এ সব ব্যাখ্যা দিল না কেন?
বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘ব্রহ্মা বা বিশ্বকর্মাকে কি কেউ দেখেছে? দুটোই মানুষের কল্পনা। মূর্তি মনকে একাগ্র করে। কেউ বিশ্বকর্মার একটা রূপ কল্পনা করেছে, কেউ আবার ব্রহ্মার রূপকে বিশ্বকর্মা ধরে নিয়েছেন। রাজ্য বিজেপি দুটো রূপের ছবি দেওয়ায় ভালই হয়েছে। কোনও পক্ষের মনেই কোনও কষ্ট রইল না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy