গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
দৃশ্য এক: মর্গের মেঝেতে শোয়ানো এক তরুণীর মৃতদেহ। গলায় কাপড়ের ফাঁস দিয়ে মৃত্যু হয়েছে। সেই ফাঁস এবং দেহের বাইরের বিভিন্ন চিহ্ন পরীক্ষা করছেন দু’জন যুবক। তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করে বিভিন্ন তথ্য নথিভুক্ত করছেন আরও এক জন।
দৃশ্য দুই: মর্গের অফিসে টেবিলের সামনে এপ্রন পরে দাঁড়িয়ে এক জন। সামনে চিরকুট হাতে এক যুবক। তাঁর থেকে ময়না তদন্ত হওয়া এক মৃতের ওজন, মাথায় কোথায় কী আঘাত সমস্ত কিছু শুনে নথিভুক্ত করছেনওই ব্যক্তি। লেখা শেষ হতেই তিনি বেরিয়ে গেলেন।
সম্প্রতি প্রকাশ্যে আসা আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের মর্গের দু’টি ভিডিয়ো (যার সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার) ঘিরে শুরু হয়েছে বিতর্ক। অভিযোগ, দিনের পর দিন এই ভাবে ওই মর্গে তৈরি হয়েছে ময়না তদন্তের রিপোর্ট। কিন্তু প্রকাশিত ভিডিয়োর ওই দু’টি দৃশ্যে যাঁদের দেখা গেল, তাঁরা কারা? খোঁজখবর নিয়ে জানা যাচ্ছে, তরুণীর দেহ পরীক্ষা করা দুই যুবক পেশায় ডোম। তাঁদের থেকে জেনে কাগজে লিখতে থাকা এবং চিরকুট দেখে তথ্য নথিভুক্ত করানো যুবক আর জি কর মর্গের হেড ডোম সন্তোষ মল্লিক বলেই হাসপাতালের কর্মীরা জানাচ্ছেন। আর, ডোমের কথা শুনে যিনি ময়না তদন্তের রিপোর্ট লিখলেন, এপ্রন পরা সেই ব্যক্তি ফরেন্সিক মেডিসিনের বিভাগীয় প্রধান প্রবীর চক্রবর্তী বলেই জানাচ্ছেন হাসপাতালের কর্মীরা। সেই কারণে এই ভিডিয়ো দেখে প্রশ্ন উঠেছে, কী ভাবে এক জন ডোমের উপরে ভরসা করে ময়না তদন্তের রিপোর্ট তৈরি করতে পারেন এক জন সিনিয়র চিকিৎসক? দিনের পর দিন এই অনিয়ম চললেও তার কিছুই কি জানতে পারেননি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ? না কি সব জেনেও চুপ থাকতেন? চিকিৎসক মহলের একাংশের বক্তব্য, ‘বিভাগীয় প্রধান নিজেই যেখানে এমন বেনিয়ম করছেন বলে ভিডিয়োয় দেখা যাচ্ছে, সেখানে কর্তৃপক্ষ জানতেন না বলাটা বোধ হয় ঠিক নয়’।
এক জন ডোম কি ময়না তদন্তে আসা কোনও মৃতদেহের শরীরের বাইরের এবং ভিতরের আঘাত পরীক্ষা করতে পারেন? প্রবীরের দাবি, “না, আমরা শিক্ষকেরা বা পিজিটি-রা ময়না তদন্ত করি। ডোমেরা সহযোগিতা করেন। আমরা পরে দেখে নিই।” কিন্তু প্রকাশ্যে আসা ভিডিয়োয় দেখা যাচ্ছে, সন্তোষ একটি মৃতদেহের শরীরের বাইরের আঘাত দেখে নথিভুক্ত করছেন। আর একটি ভিডিয়োয় দেখা যাচ্ছে, তাঁর কথা শুনে আপনি (প্রবীর) তথ্য নথিভুক্ত করছেন? প্রবীর বলেন, “কী ভাবে এই ভিডিয়ো আপনারা পেতে পারেন? আমাকে আগে জানতে হবে, এই ভিডিয়ো কে তুললেন, বাইরে এল কী ভাবে? কে এক্তিয়ার দিল ওই ছবি তোলার? আমি আর কোনও উত্তর দেব না।” এই বিষয়ে সন্তোষকে বিকেলে ফোন করা হলে তিনি সন্ধ্যা সাতটার পরে ফোন করতে বলেন। কিন্তু প্রবীরকে ফোন করার পরে সন্তোষের সঙ্গে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি, রাত পর্যন্ত মেসেজেরও উত্তর দেননি।
ফরেন্সিক মেডিসিনের চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, নিয়মানুযায়ী যে কোনও মৃতদেহের ব্যবচ্ছেদের আগে তাঁর শরীরের বাইরের আঘাতের চিহ্ন-সহ অন্যান্য বিষয় পরীক্ষা করে লিপিবদ্ধ করতে হয় অটোপ্সি-সার্জনকে। আবার, দেহ ব্যবচ্ছেদ করে শরীরের ভিতরের আঘাত, পরিবর্তন-সহ সমস্ত কিছুই পরীক্ষা করতে হয় ওই চিকিৎসককেই। গোটা প্রক্রিয়ায় দেহ ময়না তদন্তের টেবিলে নিয়ে আসা, ব্যবচ্ছেদ করার যন্ত্রপাতি এগিয়ে দেওয়া, সেলাই করার কাজ করেন মর্গের ডোমেরা।
শহরের এক মেডিক্যাল কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অটোপ্সি সার্জনের কথায়, ‘‘দীর্ঘদিন কাজের ফলে দেখে-শুনে ডোমেদের অভিজ্ঞতা তৈরি হয় ঠিকই। কিন্তু মৃতদেহ পরীক্ষা করে মৃত্যুর কারণ জানার জন্য পড়াশোনা করে ডাক্তার হতে হয়। সেই জায়গায় এক জন ডোম কখনই এই কাজ করতে পারেন না। অনৈতিক এই কাজ সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের দায়িত্বহীনতার প্রমাণ দিচ্ছে।’’ আরও অভিযোগ, ‘‘জেলার যে সমস্ত হাসপাতালে ময়না তদন্ত হয়, সেখানেও একই রকম ভাবে বেনিয়ম চলে। কিন্তু দেখার কেউ নেই।’’
আর জি করে খুন ও ধর্ষণের ঘটনার পরে, সেখানকার মর্গ নিয়ে বিভিন্ন দুর্নীতি ও বেনিয়মের অভিযোগ বার বার সামনে এসেছে। সেই অভিযোগ এতটাই জোরালো যে সিবিআইয়ের আধিকারিকরাও বেশ কয়েক বার আর জি করের মর্গে গিয়ে সব কিছু খতিয়ে দেখেছেন। সংগ্রহ করেছেন সিসি ক্যামেরার বিভিন্ন ফুটেজ। সূত্রের খবর, সেখানেও ডোমের উপরে নির্ভর করে ময়না তদন্তের রিপোর্ট তৈরির মতো ছবি তদন্তকারীদের সামনে এসেছিল। কী ভাবে এক জন ডোম এত ক্ষমতাবান হয়ে উঠল, তা কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাও খতিয়ে দেখছে বলে খবর। জানা যাচ্ছে, সন্দীপ ঘোষ অধ্যক্ষ থাকার সময়ে এই সন্তোষকে উত্তরবঙ্গ থেকে তড়িঘড়ি আর জি করে নিয়ে এসে মর্গের দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
চিকিৎসক মহলের একাংশ বলছেন, দু’টি ভিডিয়োয় ইঙ্গিত স্পষ্ট, আর জি করের মর্গে ময়না তদন্তে বেনিয়ম কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল। প্রকাশ্যে আসা ভিডিয়োর একটিতে দেখা যাচ্ছে, পথ দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে মৃতের মাথার খুলির ভিতরে কতটা রক্ত ও পুঁজ জমে ছিল, কপালে কোথায় কতটা ক্ষত ছিল, ক’টি সেলাই রয়েছে, খুলি খুলে গিয়েছিল কি না, রাইগর মর্টিস কতটা, মর্গের অফিসে এসে প্রবীরকে সেই সম্পর্কে তথ্য দিচ্ছেন সন্তোষ। সেগুলি রিপোর্টে নথিভুক্ত করছেন তিনি। ময়না তদন্ত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ঘটনা থেকে স্পষ্ট, দেহটি ব্যবচ্ছেদের সময়ে সেখানে অটোপ্সি সার্জন নিজে উপস্থিত ছিলেন না।
অভিযোগ, একাধিক ক্ষেত্রে ডোমেরাই ব্যবচ্ছেদ করেন। এই ভিডিয়োয় সেটি স্পষ্ট না থাকলেও, হাসপাতালের চিকিৎসকদের বড় অংশের দাবি, যে ভাবে সন্তোষ ব্যবচ্ছেদ করে পাওয়া তথ্যের বর্ণনা দিচ্ছেন, আর তা শুনে বিভাগীয় প্রধান লিখছেন, তাতে বোঝা যাচ্ছে ব্যবচ্ছেদও ডোমই করেছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ডোমের কথার উপর নির্ভর করে ময়না তদন্তের রিপোর্ট তৈরিতে মারাত্মক ভুল হতে পারে। তাতে খুনের ঘটনা আত্মহত্যা হয়ে যেতে পারে, উল্টোও ঘটতে পারে। আবার, যে নমুনা যতটা সংগ্রহ করা প্রয়োজন, তা না-ও হতে পারে। ফলস্বরূপ পরবর্তী সময়েপুলিশি তদন্ত বিপথে চালিত হওয়ার আশঙ্কাও প্রবল।
এই ‘ক্ষমতাশালী’ ডোম সন্তোষের বিরুদ্ধে অভিযোগ নানা রকমেরই। অভিযোগ, প্রথমে ময়না তদন্ত করানো থেকে ভাল করে সেলাই করা, শববাহী গাড়ি ব্যবস্থা করে বাড়ি পৌঁছনোর জন্য মৃতের পরিবারের থেকে মোটা টাকার প্যাকেজ চালু করেছিল সন্তোষ-বাহিনী। তাঁর কথা মতো কাজ না করলে সরিয়ে দেওয়ার হুমকিও দেন সন্তোষ। রাতে মর্গে নেশার আসর, অন্য ডোমদের পরিজনকে কটূক্তি, অশালীন ইঙ্গিত দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। তবে এই নিয়ে সন্তোষের সঙ্গে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি, রাত পর্যন্ত মেসেজেরও উত্তর দেননি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy