দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনের ফলকে সামনে রেখে রাজ্যে রাজ্যে নিজেদের রাজনৈতিক জমি শক্ত করার দিকে নজর দিচ্ছে কংগ্রেস। আবার অন্য দিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল কার্যত ঘোষণা করে দিয়েছে, বঙ্গে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে তারা একাই লড়বে। এই পরিস্থিতিতে রাজ্যে নিজেদের দৃশ্যমানতা বাড়ানো ও শক্তি সঞ্চয়ের পথেই কংগ্রেস এগোতে চাইছে। একই ভাবে নিজেদের শক্তি বাড়ানোয় জোর দেওয়ার পাশাপাশিই কংগ্রেসের সঙ্গে বোঝাপড়ার জন্য তৈরি থাকা, এই জোড়া আপৎকালীন পরিকল্পনা তৈরি রাখছে সিপিএম।
সর্বভারতীয় স্তরে ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের শরিক হলেও দিল্লির বিধানসভা ভোটে অরবিন্দ কেজরীওয়ালের দল আপের সঙ্গে কংগ্রেসের সমঝোতা হয়নি। কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের বড় অংশের মত, আঞ্চলিক দলগুলিকে সর্বত্র জায়গা ছেড়ে দিয়ে দলের কোনও লাভ হচ্ছে না, বিজেপিকেও হারানো যাচ্ছে না। তার চেয়ে কংগ্রেস তার শক্তি বাড়ানোর দিকে মন দিক। আঞ্চলিক দলগুলি মূলত কংগ্রেসের রাজনৈতিক জমি কেড়েই উঠে এসেছে। তার কিছুটা পুনরুদ্ধার করতে পারলেও কংগ্রেসের লাভ। দলীয় সূত্রের খবর, বাংলায় সংক্ষিপ্ত সফরে এসে এআইসিসি-র সাধারণ সম্পাদক এবং এ রাজ্যের পর্যবেক্ষক গুলাম আহমেদ মীর প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্বকে সেই রকম বার্তাই দিয়ে গিয়েছেন।
প্রাক্তন সাংসদ ও প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের পুত্র অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়ের কংগ্রেসে ফেরার অনুষ্ঠান উপলক্ষে কলকাতায় এসেছিলেন মীর। সেই অবসরে প্রদেশ কংগ্রেসের বর্ষীয়ান নেতাদের সঙ্গে তাঁর মত বিনিময় হয়েছে। রাজ্যে কংগ্রেসের অধিকাংশ নেতাই শাসক তৃণমূলের হাত ধরার পক্ষপাতী নন। তার উপরে তৃণমূল নেতৃত্ব নিজেরাই এখন বলে দিচ্ছেন, তাঁদের কাউকে প্রয়োজন নেই। কংগ্রেস সূত্রের খবর, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের কাজকর্মের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথাই বলেছেন মীর। সংগঠনের শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করতে বলেছেন। প্রদেশ কংগ্রেস সদস্যদের নিয়ে সম্মেলন ও সাংগঠনিক পুনর্গঠনের জন্য কমিটির প্রসঙ্গও আলোচনায় এসেছে। তবে বামেদের সঙ্গে ফের সমঝোতা হবে কি না, তা নিয়ে এখনই মাথা না-ঘামাতে পরামর্শ দিয়েছেন এআইসিসি-র পর্যবেক্ষক। তাঁর মতে, নির্বাচনী বোঝাপড়ার প্রশ্নে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।
রাজ্যে বিধানসভা ভোটের আর বছরখানেক বাকি। তৃণমূল তাদের অবস্থান বুঝিয়ে দেওয়ার পরে প্রদেশ কংগ্রেসের সামনে এখন একলা চলা অথবা বামেদের সঙ্গে বোঝাপড়া, এই দুই রাস্তাই খোলা রয়েছে। এই সূত্রে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকার বলছেন, ‘‘তৃণমূলের দিকে যেতে হবে, এমন কথা আমরা তো বলিনি। দিল্লির ভোটের পরে তৃণমূলেরই কংগ্রেসের কথা মনে হয়েছে! আসলে দিল্লির এই ভোটে কংগ্রেস যে পথ নিয়েছে, তাতে অনেক দলেরই বুকে কাঁপুনি ধরেছে!’’ তাঁর আরও সংযোজন, ‘‘আরএসএস-বিজেপি যে ভাবে গণতন্ত্র ও সংবিধানকে ধ্বংস করছে, তার মোকাবিলা কংগ্রেসই করতে পারে। বিজেপিকে রুখতে এবং তাদের সহায়ক দলকে আটকাতে কংগ্রেসের শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। তার জন্য নিজেদের পথে লড়াই, আন্দোলন করতে হবে।’’ তবে প্রদেশ সভাপতির বক্তব্য, নির্বাচনী কৌশল শেষ পর্যন্ত কী হবে, তা নিয়ে দলে এখনও আলোচনা হয়নি।
রাজ্যে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের তথ্য অবশ্য বলছে, এক ডজ়ন বিধানসভা আসনে এগিয়ে রয়েছে কংগ্রেস (১১) ও সিপিএম (১)। তৃণমূল ও বিজেপির বাইরে এই ১২ আসনে অন্য দলের এগিয়ে থাকার নেপথ্যে বাম ও কংগ্রেসের ভোট মিশে রয়েছে। কারণ, লোকসভায় দু’দল সমঝোতা করেই লড়েছিল। বিধানসভায় শূন্যের গেরো থেকে বেরোতে গেলে বোঝাপড়া ছাড়া উপায় নেই বলে মনে করে দু’পক্ষেরই বড় অংশ। এমতাবস্থায় সিপিএম কী করবে? দলের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের কথায়, ‘‘বাম দলগুলির শক্তি বাড়ানোর উপরে আমরা জোর দিচ্ছি। আবার কংগ্রেস সঙ্গে থাকলে কী করণীয়, সেই পরিকল্পনাও থাকছে। কংগ্রেস তাদের অবস্থান স্পষ্ট করলে উপযুক্ত সময়ে নির্বাচনী কৌশলের ব্যাপারে কথা হবে।’’ তবে সিপিএম সূত্রের ইঙ্গিত, বামেরা নিজস্ব আন্দোলনে থাকলেও বিষয় ভিত্তিতে কিছু কর্মসূচিতে কংগ্রেসকেও আমন্ত্রণ জানানো হতে পারে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)