—প্রতীকী চিত্র।
বছর প্রায় ঘুরতে চললেও প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার (গ্রামীণ) কেন্দ্রীয় বরাদ্দের দেখা নেই। যা ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক তরজার কেন্দ্রবিন্দুতে এসে গিয়েছে। বরাদ্দ না দেওয়ার প্রশ্নে রাজ্যকেই দায়ী করছে কেন্দ্র। রাজ্যের পাল্টা অভিযোগ, গরিবের মাথার ছাদ দেওয়ার বদলে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার চেষ্টা করছে কেন্দ্র। সামগ্রিক বকেয়া নিয়ে আগামী সপ্তাহের গোড়ায় তৃণমূলের প্রতিবাদের আঁচও পড়তে চলেছে দিল্লির রাজপথে। কিন্তু কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, রাজ্যের হাতে থেকে গিয়েছে ওই প্রকল্পের প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা! সেটাই নতুন বরাদ্দের সামনে বাধা তৈরি করছে কি না, তা নিয়ে জল্পনা তৈরি হয়েছে প্রশাসনের অন্দরে।
প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার (গ্রামীণ) তথ্য অনুযায়ী, চলতি আর্থিক বছরে (২০২৩-২৪) পশ্চিমবঙ্গের ‘ওপেনিং ব্যালেন্স’-এ অর্থাৎ রাজ্যের হাতে খরচ না হওয়া অর্থ হিসেবে রয়েছে প্রায় ২৪৭১ কোটি টাকা। এই টাকাই ‘অ্যাভেলেবল ফান্ড’ ব্যবহারযোগ্য তহবিল হিসেবে কেন্দ্রীয় নথিতে দেখানো হয়েছে। রাজ্যের আধিকারিকদের একাংশের দাবি, হাতে থাকা টাকা আগে খরচের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে বলেই সম্ভবত নতুন বরাদ্দের দেখা মিলছে না। বিভিন্ন বৈঠকে সেই বার্তা ঠারেঠোরে রাজ্যকে দিয়েছে কেন্দ্র। এক কর্তার কথায়, “এক-একটি কিস্তির টাকা পেয়ে প্রযুক্তির প্রমাণ-সহ বাড়ি তৈরির অগ্রগতি নথিবদ্ধ করাতে হয়। ২০১৬-১৭ থেকে ২১-২২ পর্যন্ত চলা আবাস প্রকল্পে খরচ হয়নি, এমন অর্থও রয়েছে। ২০২২ থেকে শুরু হয়েছে প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপ আবাস (প্লাস), সেই টাকা কেন্দ্রের থেকে পাওয়া যায়নি এখনও।”
পঞ্চায়েতমন্ত্রী প্রদীপ মজুমদারের দাবি, “যে টাকা ওপেনিং ব্যালেন্স হিসেবে রয়েছে, তার মধ্যে ১৪০০ কোটি টাকা রাজ্যেরই অংশীদারির টাকা। বাকি টাকা আগের খরচ না হওয়া টাকা।” কিন্তু পর্যবেক্ষকদের অনেকের বক্তব্য, টাকাটা খরচ হয়নি কেন? সেটাই তো মূল প্রশ্ন।
প্রশাসনিক তথ্য বলছে, আবাস (প্লাস) শুরুর আগে পর্যন্ত বহু উপভোক্তা বাড়ি তৈরিই করেননি। গত মাসের ২৩ অগস্ট পর্যন্ত রাজ্যেরই তথ্যে, প্রথম কিস্তির অর্থ প্রায় আড়াই হাজার উপভোক্তা ব্যবহারই (প্রশাসনিক পরিভাষায় বকেয়া) করেননি। দ্বিতীয় কিস্তি বকেয়া প্রায় ৪৫ হাজার জনের এবং তৃতীয় কিস্তি বকেয়া রয়েছে প্রায় ২৬ হাজার উপভোক্তার (সবিস্তার সারণীতে)। আবার রাজ্যের তথ্যে, অনিচ্ছুক উপভোক্তার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে বেশি। তা ছাড়া আরও নানা কারণে বাড়ি তৈরি করেননি বহু উপভোক্তা (সবিস্তার সারণীতে)। এই সব কারণে যে অর্থ খরচ হয়নি, তার প্রতিফলন কেন্দ্রের নথিতে পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকদের অনেকে। শুক্রবার পঞ্চায়েতমন্ত্রী বলেন, “কোভিডের সময়ে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে। অনেকে অন্যত্র চলে গিয়েছেন, আবার অনেকে হাতে থাকা টাকা খরচ করে ফেলেছেন। ফলে পরবর্তী কিস্তির টাকা অনেকেরই পড়ে রয়েছে। তাঁরা আর বাড়ি তৈরিতে আগ্রহ দেখাননি।”
প্রশাসনের একাংশ এ-ও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, দুর্নীতি ধরা পড়ে যাওয়ার জেরেও টাকা পড়ে রয়েছে। উপযুক্ত উপভোক্তার হাতে সেই টাকা পৌঁছনো যায়নি। ঘটনাচক্রে, ২০২১ সালের নভেম্বরে হাওড়ার প্রশাসনিক বৈঠকে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সতর্ক করে বলেছিলেন, “প্রকল্পের কাজ সরাসরি করবে, যাতে কেউ এখান থেকে টাকা-পয়সা নিতে না পারে। যার প্রয়োজন রয়েছে, একমাত্র সে-ই পাবে। যার চার তলা বাড়ি রয়েছে, সে বাড়ি পেল, আর যার কিছু নেই, সে পেল না, এটা চলবে না।” তার পরে ‘অযোগ্য’ উপভোক্তাদের থেকে টাকা ফেরাতে এফআইআর করাও শুরু করে প্রশাসন। তবে খরচ না হওয়া টাকা কী ভাবে ব্যবহার করা হবে, তার স্পষ্ট ইঙ্গিত মেলেনি দফতরের তরফে।
তবে অভিজ্ঞ আমলাদের অনেকে জানাচ্ছেন, যাঁদের বাড়ি তৈরি হয়নি, তাঁদের দিয়ে বাড়ি তৈরি করানোই সমস্যার সমাধান। আর যাঁদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বা অনিচ্ছুক, তাঁদের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কেন্দ্রকেই। সেই এক্তিয়ার রাজ্যের হাতে নেই।
রাজ্যের অবশ্য পাল্টা যুক্তি, চলতি আর্থিক বছরে শুধু পশ্চিমবঙ্গ কেন, অনেক বড় বড় রাজ্যের খরচ না হওয়া বিপুল অর্থ তাদের ‘ওপেনিং ব্যালেন্স’-এ ধরা পড়েছে। তাদের কেউ কেউ কেন্দ্রের অনুমোদনও পেয়েছে। সে জায়গায় এ রাজ্য কী দোষ করল? প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “তাৎপর্যপূর্ণ এটাই, চলতি আর্থিক বছরে অসম, হিমাচল প্রদেশ, জম্মু ও কাশ্মীর, মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখন্ড, আন্দামান-নিকোবর, দাদরা ও নগর হাভেলি, দমন ও দিউ এবং লাদাখ ছাড়া আর কোনও রাজ্য এখনও প্রকল্পের অনুমোদন পায়নি।” পঞ্চায়েতমন্ত্রীর কথায়, “অনেক রাজ্যই আগের আবাসে বহু টাকা খরচ করতেই পারেনি।”
প্রশাসনিক কর্তাদের অনেকে জানাচ্ছেন, গত বছর বরাদ্দের জট কাটাতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সে বছরই ৭ নভেম্বর কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়নমন্ত্রী গিরিরাজ সিংহের সঙ্গে বৈঠক করেন রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী প্রদীপ মজুমদার। তার পরে ওই মাসেই (নির্ধারিত সময়ের থেকে প্রায় আট মাস পরে) আবাসের (প্লাস) কাজ শুরুর ছাড়পত্র পেয়েছিল রাজ্য। তাতে প্রায় আট হাজার কোটি টাকা পাওয়ার কথা ছিল রাজ্যের। তার পরে কেন্দ্রের নিয়ম মানতে গিয়ে কার্যত ঘড়ি ধরে ২৬ নভেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে উপভোক্তাতালিকায় ব্যাপক সংশোধন করতে হয়। বাদ যায় বেশ কয়েক লক্ষ ‘অযোগ্য’ উপভোক্তার নাম। চূড়ান্ত তালিকা পায় অনুমোদন। দফায় দফায় রাজ্যে ঘুরে যায় কেন্দ্রীয় অনুসন্ধানকারী দল। কিন্তু তার পরে এখনও আটকে রয়েছে কেন্দ্রের বরাদ্দ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy