Advertisement
E-Paper

‘ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়ে সারা জীবন তো আর চলতে পারে না’

অ্যাসিড হামলার শীর্ষে এই রাজ্য, তবু আক্রান্তদের জন্য না আছে সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা, না আছে সরকারি চাকরির আশ্বাস। অন্য দিকে, অপরাধীরাও ঘুরে বেড়ায় অবাধে।রিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ সালে এ রাজ্যে অ্যাসিড হামলার ৫০টি ঘটনা ঘটে। তাতে জখম হন মোট ৫৩ জন।

অসহায়: ঋতা পাল এবং সুনীতি কর্মকার। নিজস্ব চিত্র

অসহায়: ঋতা পাল এবং সুনীতি কর্মকার। নিজস্ব চিত্র

দীক্ষা ভুঁইয়া

শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২০ ০৩:২৭
Share
Save

সরকারি অফিসে চাকরি দিয়ে সামাজিক সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছে দিল্লি। মহারাষ্ট্র আবার আইনি ভাবে কঠোর হওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে অ্যাসিড হামলার ঘটনায় শীর্ষে থাকা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গ এখনও পর্যন্ত কোনও কঠোর আইন চালু তো দূর, খোলা বাজারে অ্যাসিড বিক্রি বন্ধ পর্যন্ত করতে পারেনি। অ্যাসিড আক্রান্তদের কোনও রকম সামাজিক সুরক্ষা দেওয়ারও ব্যবস্থা হয়নি এই রাজ্যে। ক্ষতিপূরণ যাঁরা পেয়েছিলেন, তাঁদের অধিকাংশেরই সেই টাকা ফুরিয়ে গিয়েছে। এমন অবস্থায় অ্যাসিড আক্রান্তদের দাবি, যোগ্যতা অনুযায়ী সরকার তাঁদের কোনও চাকরি দিক, যেমন দিল্লির মহিলা কমিশন বা লিগাল সার্ভিসেস অথরিটির বিভিন্ন অফিসে চাকরি পেয়েছেন সেখানকার আক্রান্তেরা।

পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ সালে এ রাজ্যে অ্যাসিড হামলার ৫০টি ঘটনা ঘটে। তাতে জখম হন মোট ৫৩ জন। ২০১৯-এর আগে পাঁচ বছর ধরেই এ রাজ্য দেশের মধ্যে অ্যাসিড ছোড়ার ঘটনায় শীর্ষে থেকেছে। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তন হয়নি। উল্টে আক্রান্তদের বেশির ভাগই নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। অনেকেই অভাবের তাড়নায় কোনও রকমে দিন গুজরান করছেন। থমকে গিয়েছে তাঁদের জীবন।

যেমন সোদপুরের সুনীতি কর্মকার। বিয়ের বছর আটেক বাদে স্বামীর বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের প্রতিবাদ করেছিলেন। আর সেই ‘অপরাধে’ তাঁর মুখ লক্ষ্য করে অ্যাসিড ছুড়েছিল স্বামী। সুনীতির একটি চোখ পুরো নষ্ট হয়ে যায়। অন্যটির দৃষ্টিশক্তি ৮০ শতাংশ চলে গিয়েছে। মুখের বেশির ভাগ অংশই ঝলসে গিয়েছিল। পর পর চারটি অস্ত্রোপচারের পরেও স্বাভাবিক হয়নি মুখ। এমন অবস্থায় ক্ষতিপূরণ তো পেলেন, কিন্তু সেই ক্ষতিপূরণের ৭৫ শতাংশ টাকাই জেলা লিগাল সার্ভিসেস অথরিটির তরফে ফিক্সড ডিপোজ়িট করে রাখা হয়েছে। বাকি দেড় লক্ষের মতো হাতে পেয়েছেন সুনীতি। সেই টাকারই সুদ বাবদ দু’হাজার মতো পান। আর ভ্যান চালিয়ে বাবার যা আয়। সব মিলিয়ে পাঁচ জনের সংসার চলে ওই টাকাতেই। অর্থাভাবে দুই নাবালক ছেলের পড়াও এখন বন্ধ। সুনীতির কথায়, “আমাদের যোগ্যতা দেখে সরকার কোনও কাজ দিক। না হলে বাঁচব কী করে?”

একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরফে দিব্যালোক রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘টাকা হাতে দিলে খরচ হয়ে যাবে, এই কারণ দেখিয়ে ক্ষতিপূরণের ৭৫ শতাংশ ফিক্সড ডিপোজ়িট করে রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছিল ঠিকই। তবে ওই ক্ষতিপূরণের টাকা ফিক্সড ডিপোজ়িট করে রাখার চেয়ে আক্রান্তদের হাতে দিয়ে দেওয়াই উচিত। অ্যাসিড আক্রান্তদের একাধিক সমস্যার মুখে পড়তে হয়। তাই টাকাটা তাঁরা কী ভাবে খরচ করবেন, সেটা তাঁদের হাতেই ছেড়ে দেওয়া ভাল।’’

যদিও ‘স্টেট লিগাল সার্ভিসেস অথরিটি’র সেক্রেটারি দুর্গা খৈতানের দাবি, ‘‘কোনও ফিক্সড ডিপোজ়িট নয়, মাসিক রোজগার স্কিমে ওই টাকা আক্রান্তের নামেই জমা করা হয়, যাতে তা থেকে মাসিক একটা টাকা আসে।’’ ।

শুধু সুনীতি নন, এ ভাবেই বেঁচে রয়েছেন বিরাটির ঋতা পাল। অভিযোগ, বছর দশেক আগে বিয়ের ছ’মাসের মাথায় স্বামী ও শাশুড়ি মিলে জোর করে অ্যাসিড খাইয়ে দিয়েছিল ঋতাকে। তার পরে চিকিৎসা হলেও গলার ভিতরে অ্যাসিড ঢুকে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে কথা। ঋতার শ্বাসনালি ও খাদ্যনালিও নষ্ট হয়ে গিয়েছে। শ্বাসনালি নষ্ট হওয়ায় টিউব দিয়ে শ্বাস নিতে হয় তাঁকে। কোনও রকমে তরল বা গলানো খাবার খেতে পারেন। হামলার পরে বাধ্য হয়েই বাবা-মায়ের বাড়িতে ফিরে আসতে হয়েছে ঋতাকে। স্বামী আবার বিয়ে করে সংসার করছে। ঋতা ক্ষতিপূরণ বাবদ তিন লক্ষ টাকা পেয়েছিলেন পাঁচ বছর আগে। কিন্তু সে টাকাও শেষ। মা অনুষ্ঠান বাড়ি-সহ বিভিন্ন জায়গায় রান্নার কাজ করতেন। লকডাউনের কারণে সেই কাজও বন্ধ। আপাতত রেশনের চাল যা মিলছে, তাতেই সংসার চালাচ্ছেন ঋতার মা আভারানি পাল। কিন্তু তাঁর অবর্তমানে মেয়ের কী হবে, তা ভেবেই চিন্তায় আভারানি।

রিষড়ার ঝুমা সাঁতরা বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়িতেই অ্যাসিড হামলার শিকার হয়েছিলেন। সেই হামলায় তাঁর একটি চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার পরেও কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকায় এবং কোনও কাজ না জোটায় সেই শ্বশুরবাড়িতেই রয়ে গিয়েছেন তিনি।

আক্রান্তদের এই তালিকায় সুনীতি, ঋতা বা ঝুমাই শুধু নন, রয়েছেন এমন আরও অনেকে, যাঁরা বেশি দূর পড়াশোনা করতে পারেননি।

কিন্তু এঁদের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা জানেন না কেউ-ই। আর এক অ্যাসিড আক্রান্ত, লড়াকু তরুণী মনীষা পৈলানেরও তাই দাবি, “সরকার আমাদের চাকরির ব্যবস্থা করুক। ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়ে সারা জীবন তো আর চলতে পারে না।”

(চলবে)

Acid Attack Victim Compensation

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}