গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
গলদ রেলের সামগ্রিক পরিচালন ব্যবস্থাতেই। কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনা নিয়ে উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের মুখ্য সুরক্ষা কমিশনার (চিফ কমিশনার অফ রেলওয়ে সেফটি) জনককুমার গর্গ রেল বোর্ডের কাছে প্রাথমিক যে রিপোর্ট জমা দিয়েছেন, তার ছত্রে ছত্রে এই ইঙ্গিত রয়েছে। একই সঙ্গে তিনি স্পষ্ট ভাবে জানিয়েছেন, ট্রেন পরিচালন ব্যবস্থায় গলদ থাকার কারণেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।
রেলের ‘অব্যবস্থা’র এই দিকটি ‘বেআব্রু’ করে প্রাথমিক ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালিং ব্যবস্থায় ট্রেন চলাচল পরিচালনা করার মতো উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাব ছিল ট্রেনচালক, ট্রেন ম্যানেজার এবং স্টেশন মাস্টারের। মালগাড়ির চালক নির্দিষ্ট গতিতে গাড়ি ছুটিয়েছিলেন কি না, তা নিয়ে আগেই প্রশ্ন উঠেছিল। রিপোর্টও বলছে, মালগাড়ির চালককে দেওয়া কাগুজে অনুমতিপত্রে (মেমো) নির্দিষ্ট গতির কথা উল্লেখই করা হয়নি। এমনকি, স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা খারাপ থাকলে যে পদ্ধতিতে ট্রেন চলানো উচিত, তা মানা হয়নি। এই ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট যে ফর্মে ট্রেন চালানোর অনুমতি দেওয়া হয় চালক এবং ট্রেন ম্যানেজার (গার্ড)-দের, রাঙাপানির স্টেশন মাস্টার তা দেননি বলেই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। সঠিক নিয়ম না-জানার কারণেই এমনটা হয়েছে বলে সুরক্ষা কমিশনার তাঁর রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন।
গত ১৭ জুন উত্তরবঙ্গের চটেরহাট এবং রাঙাপানি স্টেশনের মাঝে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। যে লাইন দিয়ে ওই এক্সপ্রেস ট্রেনটি চলছিল, একই লাইনে চলার অনুমতি পাওয়া একটি মালগাড়ি পিছন থেকে এসে সজোরে ধাক্কা মারে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসকে। ধাক্কার জেরে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের একাধিক কামরা উঠে পড়ে মালগাড়ির ইঞ্জিনের উপর। লাইনচ্যুত হয় মালগাড়ির কামরাও। কাঞ্চনজঙ্ঘার গার্ড এবং মালগাড়ির চালক-সহ মোট ১০ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন প্রায় ৫০ জন।
এর পরেই রেলের তরফে এই দুর্ঘটনার তদন্তভার দেওয়া হয় উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের মুখ্য সুরক্ষা কমিশনারকে। দুর্ঘটনার পর পরই জানা গিয়েছিল, রাঙাপানি এবং চটেরহাট স্টেশনের মধ্যবর্তী অংশে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল বন্ধ থাকায় ‘কাগুজে সিগন্যাল’ দিয়ে চালানো হচ্ছিল ট্রেন। সুরক্ষা কমিশনারের রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাঙাপানি স্টেশনের স্টেশনমাস্টার দু’টি ট্রেনের চালক এবং গার্ডকে কাগুজে সিগন্যাল হিসাবে ‘টি৩৬৯ (৩বি) এবং ‘টিএ-৯১২’ ফর্ম দিয়েছিলেন। সেখানে চালকদের লাল সিগন্যালকে ‘অন’ হিসাবে মান্যতা দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলেও ট্রেনের সর্বোচ্চ গতিবেগ কত রাখতে হবে, তার কোনও উল্লেখ ছিল না।
রিপোর্টে এ-ও বলা হয়েছে যে, কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসকে সামনে দেখে আপৎকালীন ব্রেক কষেছিলেন তিনি। মালগাড়ির গতিবেগ নামিয়ে এনেছিলেন ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটারে। তার পরেও দুর্ঘটনা এড়ানো হয়নি। কারণ, দু’টি ট্রেনের মধ্যে ব্যবধানিক দূরত্ব একেবারেই কম ছিল। উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের মুখ্য সুরক্ষা কমিশনার তাঁর রিপোর্টে জানিয়েছেন, এ ক্ষেত্রে ‘টিএ-৯১২’ ফর্ম নয়, নিয়ম অনুযায়ী ‘টিডি-৯১২’ ফর্ম দেওয়া উচিত ছিল। স্টেশন মাস্টারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে জনককুমার রিপোর্টে আরও লিখেছেন, ‘টিএ-৯১২’ ফর্মে গার্ডের কোনও স্বাক্ষর ছিল না। তাঁর মতে, স্টেশন মাস্টার ওই স্বাক্ষর সংগ্রহে ব্যর্থ হয়েছেন।
কমিশনার তাঁর রিপোর্টে জানিয়েছেন, ‘কাগুজে অনুমতি’ পেয়ে ঘণ্টায় ১৫ কিলোমিটার বেগে ট্রেন চালিয়েছিলেন কাঞ্চনজঙ্ঘার চালক। লাল সিগন্যালের সামনে ১ মিনিট করে ট্রেন দাঁড়ও করিয়েছিলেন তিনি। তার পর এগোচ্ছিলেন নিয়ম মতো। প্রশ্ন হচ্ছে, একই অনুমতিপত্র পেয়ে মালগাড়ির চালক হঠাৎ কেন অতিরিক্ত গতিতে ট্রেন চালালেন? রিপোর্টে বলা হয়েছে, মালগাড়ির চালক রাঙাপানির স্টার্টার সিগন্যাল ১৫ কিলোমিটার গতিবেগে এবং অ্যাডভান্স স্ট্যার্টার সিগন্যাল ৩৮ কিলোমিটার গতিবেগে পেরিয়েছিলেন। সেই গতিবেগই পরে ৪৭ এবং ৭৮ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায় নিয়ে যান তিনি। দুর্ঘটনা যখন ঘটে, তখন মালগাড়ির গতিবেগ ছিল ৪০ কিলোমিটার। এই জায়গায় এসে সুরক্ষা কমিশনার স্পষ্ট লিখেছেন, স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালিং ব্যবস্থায় কী ভাবে ট্রেন চালানো উচিত, তা নিয়ে কাটিহার বিভাগের এই অংশের রেলকর্মীদের মধ্যে প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। এক এক জন স্টেশন মাস্টার এক এক নিয়মে ট্রেন চলাচল পরিচালনা করেন। সকলে এক নিয়ম মানেন না। তাঁর মতে, ট্রেন চলাচল পরিচালনার ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাব অত্যন্ত স্পষ্ট।
রিপোর্টে রেলের একাধিক গাফিলতির কথা বলা হয়েছে। সেখানেই জনককুমার জানিয়েছেন, মালগাড়ির চালক ও গার্ডের কাছে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করার জন্য কোনও ‘ওয়াকিটকি’র ব্যবস্থা করেনি রেল। তবে রেলের দেওয়া মোবাইল ফোন ছিল। রিপোর্টে কমিশনারের দাবি, মালগাড়ির চালক এবং গার্ডের মধ্যে শেষ কথা হয়েছে দুর্ঘটনার অন্তত আধ ঘণ্টা আগে। সেটাও দু’বার। তবে কী নিয়ে তাঁদের মধ্যে কথা হয়েছিল, সে ব্যাপারে কিছু জানা যায়নি। এমনকি, রাঙাপানি স্টেশনে প্রায় ৩০ মিনিট মালগাড়িটি দাঁড়িয়ে থাকলেও কেন স্টেশন মাস্টারকে ফোন করে দাঁড় করিয়ে রাখার কারণ জিজ্ঞেস করেননি গার্ড, সে প্রশ্নও তুলেছেন সুরক্ষা কমিশনার।
দু’টি ট্রেনের চালকেরা যথাযথ বিশ্রাম পাওয়ার পর সে দিন কাজ শুরু করেছিলেন কি না দুর্ঘটনার পর সে প্রশ্নও উঠেছিল। কিন্তু সুরক্ষা কমিশনারের রিপোর্ট বলছে, কাঞ্চনজঙ্ঘা এবং মালগাড়ি— দুই ট্রেনের চালকই যথেষ্ট বিশ্রাম পেয়েছিলেন। কাঞ্চনজঙ্ঘার চালক ৪০ ঘণ্টার বিশ্রাম পেয়েছিলেন। আর মালগাড়ির চালক পেয়েছিলেন ৩০ ঘণ্টার বিশ্রাম। ‘ব্রেথ অ্যানালাইজ়ার’ এবং রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট বলছে, দুই চালকের কেউই দুর্ঘটনার সময় মত্ত অবস্থায় ছিলেন না।
রেলের বিভাগীয় সকল কার্যালয় এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের আধিকারিকদের দিকেও আঙুল তোলা হয়েছে সুরক্ষা কমিশনারের রিপোর্টে। সেখা বলা হয়েছে, স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালিং ব্যবস্থায় কী ভাবে ট্রেন চালাতে হবে, কী ভাবে সিগন্যাল খারাপ থাকলে ট্রেন চালাতে হবে, তা নিয়ে প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে কর্মীদের। স্টেশন সুপার এবং ম্যানেজারের এই নিয়ে প্রশিক্ষণের অভাব ছিল বলেও প্রাথমিক রিপোর্টে জানিয়েছেন সুরক্ষা কমিশনার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy