সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগ উড়িয়ে এ বার বিধানসভায় দাঁড়িয়ে নিজের ‘হিন্দু, ব্রাহ্মণ’ পরিচয় তুলে ধরলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সঙ্গেই সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সঙ্গে যোগসাজশ সংক্রান্ত যে অভিযোগ বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী তুলেছিলেন, তাকে চ্যালেঞ্জ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে পাল্টা অভিযোগ জানানোর কথা বললেন তিনি। মমতার মন্তব্য, “সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে আমার যোগাযোগের কথা বলছেন! প্রমাণ দিতে পারলে মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেব!” এই নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখবেন জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “প্রধানমন্ত্রী বলুন, আমার যোগাযোগ আছে কি না। তার থেকে মৃত্যুও ভাল!”
বিধানসভার অধিবেশন থেকে নিলম্বিত (সাসপেন্ড) হওয়ার পরে সোমবার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার ও মুখ্যমন্ত্রীকে ‘হিন্দু-বিরোধী’ বলে তীব্র আক্রমণ করেছিলেন। শাসকের বিরুদ্ধে ‘তোষণে’র অভিযোগ তুলে সরকারকে ‘মোল্লাদের সরকার, মুসলিম লিগের সরকার, আনসারুল্লার (বাংলাদেশি জঙ্গি সংগঠন) মদতদাতা সরকার’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। রাজ্যপালের ভাষণের উপরে বিতর্কে জবাবি বক্তৃতায় মঙ্গলবার বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা পাল্টা বলেছেন, “এত কুৎসা করছেন! আমি মুসলিম লিগ! আপনারা মুসলিম লিগের সাহায্য নিয়েছেন। কত বার? ফাঁস করব সে সব?” এই প্রসঙ্গেই মমতার অভিযোগ, বাংলাদেশের অস্থিরতার সময়ে রাজ্যের সীমান্তে অশান্তির জন্য উস্কানি দিয়েছিল বিজেপি।
বিজেপিকে তোপ দেগে বিধানসভায় এ দিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগাগোড়া বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে তিনিও হিন্দু এবং তাঁর সরকার হিন্দুদের উন্নয়নেও কাজ করেছে। তাঁর সরকার ধর্মীয় বৈষম্য করেনি। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “আপনারা একটা ধর্ম বিক্রি করে খাচ্ছেন! আমি ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান আমাকে হিন্দুত্ব শেখাবেন না।” সেই সঙ্গেই রাজ্যের ৩০-৩৩% সংখ্যালঘু সম্পর্কে বিজেপির নেতিবাচক মানসকিতার অভিযোগ এনে মমতার প্রশ্ন, “তারা খাবে না? তারা শিক্ষা পাবে না? তাদের মারা হবে?”
অধিবেশনে সরাসরি সম্প্রচারের জন্য টিভি ক্যামেরার উপস্থিতিতে টানা ১ ঘণ্টা ২৭ মিনিটের বক্তৃতার অর্ধেকের বেশি সময় মুখ্যমন্ত্রী বিজেপির ‘হিন্দুত্বের রাজনীতি’র সমালোচনা করেছেন। বিরোধীদের উদ্দেশে তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘এত কুৎসা করছেন যাঁদের নামে, তাঁরা একটা আন্দোলনের ডাক দিলে নিজেকে সামলে রাখতে পারবেন তো?’’ কুম্ভে দুর্ঘটনায় মৃত্যু নিয়েও বিজেপি সরকারকে তোপ দেগেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
এ বারের অধিবেশনে ধর্ম নিয়ে এই তরজার শুরু হয়েছিল সোমবারই। রাজ্যপালের বক্তৃতায় রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার যে উল্লেখ রয়েছে, তার সূত্রে সরস্বতী পুজোয় বাধা দেওয়ার প্রসঙ্গ তুলেছিলেন বিজেপি বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল। বিজেপি বিধায়কদের বিক্ষোভের জেরে ৩০ দিনের জন্য নিলম্বিত করা হয় বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু ও অগ্নিমিত্রা-সহ চার বিজেপি বিধায়ককে। তার পরেই শুভেন্দু অভিযোগ করেন, এই সরকার হিন্দুদের কথা বলতে দিতে চায় না। তার জবাবে এ দিন মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘কবে থেকে উনি (শুভেন্দু) হিন্দু ধর্মের নেতা হয়ে গেলেন! এত সস্তা!’’ সেই সঙ্গেই পুজোয় বাধার অভিযোগ নস্যাৎ করে মমতা বলেন, ‘‘স্কুল, কলেজ, বাড়ি মিলিয়ে রাজ্যে তিন-চার কোটি সরস্বতী পুজো হয়েছে। একটা ঘটনা নিয়ে আমাকে আর বাংলাকে কলঙ্কিত করে দিলেন!’’ দক্ষিণ কলকাতার কলেজে পুজো নিয়ে ওঠা অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে দু’টি ছবিও জমা দিয়েছেন তিনি।
বিধানসভার ভিতরের এই ধর্ম-সংঘাত চালিয়ে রাজ্যের জরুরি প্রশ্ন থেকে তৃণমূল ও বিজেপি নজর ঘুরিয়ে দিচ্ছে বলে সরব হয়েছে সিপিএম ও কংগ্রেস। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর মন্তব্য, ‘‘দিদিভাই শুভেন্দুর নামে অভিযোগ জানাবেন মোদাভাইয়ের কাছে। তাঁর ভরসা আছে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে শুভেন্দুর চেয়ে ওঁর কথার গুরুত্ব বেশি। দিল্লির বিজেপির ভরসায় যে তৃণমূল চলে, মুখ্যমন্ত্রী তা বুঝিয়ে দিয়েছেন!’’ প্রদেশ কংগ্রেসের মুখপাত্র সৌম্য আইচ রায়ের মতে, ‘‘বিরোধী দলনেতা ধর্মীয় প্ররোচনামূলক কথা বলছেন, মুখ্যমন্ত্রীও সেই পথে হাঁটছেন। বিধানসভায় ওঁরা ধর্মীয় উন্মাদনার প্রতিযোগিতা চালাচ্ছেন। রুটি-রুজি, কর্মসংস্থান নিয়ে কারও ভাবনা নেই!’’
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)