গুলিতে মারা গিয়েছেন সালাউদ্দি শেখ (১৭) এবং সানারুল বিশ্বাস (৬০)। —নিজস্ব চিত্র।
সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি)-র প্রতিবাদে ডাকা স্থানীয় বন্ধকে কেন্দ্র করে বুধবার কার্যত রণক্ষেত্রের চেহারা নিল মুর্শিদাবাদের জলঙ্গি। তৃণমূল এবং বন্ধ সমর্থনকারীদের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হল দু’জনের। আহত হয়েছেন বেশ কয়েক জন। অভিযোগ, শাসক দলের স্থানীয় নেতৃত্বের উপস্থিতিতে বন্ধ সমর্থনকারীদের উপর এলোপাথাড়ি গুলি চালায় কিছু দুষ্কৃতী। দু’জনের মৃত্যুর পাশাপাশি আরও কয়েক জন গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি বলে দাবি স্থানীয় বাসিন্দাদের।
তৃণমূল এই ঘটনার সঙ্গে তাদের কোনও যোগ নেই বলে দাবি করলেও, গোটা ঘটনায় উত্তাল রাজ্যের রাজনৈতিক মহল। সিপিএম এবং কংগ্রেসের তরফে ঘটনার তীব্র নিন্দা করে অভিযুক্তদের কঠোর শাস্তির দাবি জানানো হয়েছে। বিজেপি রাজ্যে ক্ষমতায় এলে সরকারি সম্পত্তি ধ্বংসকারীদের গুলি করে মারবে বলে হুমকি দিয়েছিলেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। দিন পনেরো আগের সেই মন্তব্যকে এ দিন তুলে ধরেছে সিপিএম। তাদের বক্তব্য, দিলীপ ঘোষ যা বলেছিলেন, সেটাই করে দেখাচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।
ঘটনার সূত্রপাত এ দিন সকালে। ‘নবজাগরণ’ নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন এ দিন জলঙ্গি থানা এলাকার সাহেবনগরে সিএএ বাতিলের দাবির পাশাপাশি এনআরসি-র বিরুদ্ধে বন্ধের ডাক দেয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, ওই সংগঠনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীরা থাকলেও তাঁরা মূলত অরাজনৈতিক একটি আন্দোলন তৈরির চেষ্টা করেছিলেন। নুর ইসলাম নামে এক প্রত্যক্ষদর্শীর দাবি, এ দিন সকাল ৭টা থেকে সাহেবনগর বাজারে অবস্থানে বসেন বন্ধ সমর্থনকারীরা। তাঁর অভিযোগ, সাড়ে আটটা নাগাদ তিন-চারটি গাড়ি এসে থামে বাজারের সামনে। ওই গাড়িগুলোতে ছিলেন তৃণমূলের স্থানীয় নেতা ও কর্মীরা।
সালাউদ্দিন শেখ নামে অন্য এক প্রত্যক্ষদর্শীর দাবি, ওই তৃণমূল কর্মী-সমর্থকরা লাঠিসোটা হাতে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে বন্ধ সমর্থনকারীদের সরে যেতে বলেন। এর পরেই তৃণমূল কর্মী-সমর্থক এবং বন্ধ সমর্থকদের মধ্যে শুরু হয়ে যায় বচসা এবং তা গড়ায় হাতাহাতিতে। অভিযোগ, অল্প সময়ের মধ্যেই সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায় দু’পক্ষের মধ্যে। ইমদাদুল হক নামে অন্য এক স্থানীয় বাসিন্দার অভিযোগ, ‘‘তৃণমূলের ব্লক সভাপতি তহিরুদ্দিন মণ্ডল নিজে ঘটনাস্থলে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান। ওঁদের নির্দেশেই সঙ্গে থাকা তৃণমূলের লোকজন বাজারে থাকা জমায়েত লক্ষ্য করে বোমা মারতে থাকে। এলাকার মানুষ প্রতিরোধ করতেই তাঁরা ফিরে যাওয়ার পথে এলোপাথাড়ি গুলি চালায়। সেই গুলিতে মারা যান সানারুল বিশ্বাস ওরফে আনারুল বিশ্বাস (৬০) এবং সালাউদ্দি শেখ (১৭)।” এলাকাবাসীর দাবি, আরও অন্তত তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
ঘটনার পরেই সাহেবনগরে পৌঁছয় বিশাল পুলিশ বাহিনী। পুলিশকে ঘিরে বিক্ষোভও দেখান এলাকার বাসিন্দাদের একাংশ। রাস্তা অবরোধ করেন করেন বিক্ষোভকারীরা। ভাঙচুর করা হয় একাধিক গাড়িতে। আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় একটি বাইকেও।
তৃণমূলের মুর্শিদাবাদ জেলা সভাপতি আবু তাহের খান এ দিনের ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘শারজিল ইমামের গ্রেফতারের প্রতিবাদে বন্ধের ডাক দিয়েছিল একটি অরাজনৈতিক মঞ্চ। কিন্তু সেখানে সিপিএম-কংগ্রেসের সঙ্গে মিম-পিএফআই-এর মতো মৌলবাদী শক্তি ঢুকে পড়ে অশান্তি পাকানোর চেষ্টা করছে।” তাঁর দাবি, ‘‘আমার দলের নেতৃত্ব কেন গুলি চালাতে যাবে? এ সব মিথ্যে অভিযোগ। পুলিশ তদন্ত করুক। কিছু দুষ্কৃতী গুলি চালিয়ে এলাকায় অশান্তি পাকাচ্ছে।’’
আরও পড়ুন: সাঙ্গ সমাবর্তন, টিএমসিপি-র বিক্ষোভে ফিরতে হল ধনখড়কে
আরও পড়ুন: হতাশেরাই ছবি আঁকে, গান গায়, তত্ত্ব দিলীপের
অশান্তিতে জ্বলছে বাইক। —নিজস্ব চিত্র।
এ দিনের গুলিচালনার ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছে সিপিএম এবং কংগ্রেস। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র বলেন, ‘‘যে ভাবে তৃণমূলের নেতৃত্বে বোমা-গুলি চালিয়ে সিএএ বিরোধীদের প্রাণে মেরে ফেলা হল, তাতে প্রমাণ হয়, উত্তরপ্রদেশের যোগী সরকারের সঙ্গে এ রাজ্যের দিদির সরকারের কোনও ফারাক নেই।’’
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রও ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘রাজ্য সরকার এবং রাজ্যের শাসকদল মুখে সিএএ বিরোধিতার কথা বললেও বারেবারে এরাজ্যে সিএএ বিরোধী আন্দোলনের বিরুদ্ধে মোদী সরকারের হয়েই দমনমূলক ভূমিকা নিয়েছে। প্রতিবাদের কণ্ঠরোধ করতে বিজেপির হয়ে মাঠে নেমেছে তারাই। এদিন তৃণমূল নেতার উপস্থিতিতে তাদের দুষ্কৃতীবাহিনীর গুলিতে যে ভাবে দু’জনের প্রাণহানি ঘটেছে আমরা তার তীব্র নিন্দা করছি।’’ সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘‘কয়েক দিন আগে দিলীপ ঘোষ আন্দোলনকারীদের গুলি চালিয়ে মারার কথা বলেছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সেটাই করে দেখাল।’’
অন্য দিকে, অভিযুক্ত তৃণমূল ব্লক সভাপতি তহিরুদ্দিন বন্ধ সমর্থনকারীদের উপর হামলার কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘আমরা সিএএ-র বিরোধী। তা হলে আমরা কেন ওই আন্দোলনে বাধা দেব?” তিনি গুলি চালানোর অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন। তহিরুদ্দিন বলেন, ‘‘যদি আমরাই গুলি চালিয়ে থাকি, তা হলে আমার ভাইপো মন্টু শেখকে গুলি করল কে?” পায়ে গুলি লেগেছে মন্টুর। তিনিও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
এ দিন ঘটনাস্থলে যান মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার অজিত সিংহ যাদব এবং ডিআইজি (মুর্শিদাবাদ) মুকেশ কুমার। তাঁরা গোটা বিষয় নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে পুলিশ সূত্রের খবর, এখনও পর্যন্ত ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্য দিকে নবান্নে রাজ্য পুলিশের অতিরিক্ত ডিজি (আইনশৃঙ্খলা) জ্ঞানবন্ত সিংহ জানিয়েছেন, যে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে তাঁদের শরীরে বোমার স্প্লিন্টারের আঘাত পাওয়া গিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy