Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
TMC infighting

শ্যামের বাঁশি-অর্জুনের বাণ! তৃণমূল বনাম তৃণমূল বিবৃতির লড়াইয়ে সরগরম ব্যারাকপুরের শিল্প এলাকা

জগদ্দলে দলীয় কর্মী খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাংসদ-বিধায়কের এই ভাবে প্রকাশ্যে বাগ্‌বিতণ্ডায় বেজায় অস্বস্তিতে পড়েছেন শাসকদলের জেলা নেতৃত্ব।

অর্জুন সিংহ।

অর্জুন সিংহ। —ফাইল চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
ব্যারাকপুর শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২৩ ১২:৪৬
Share: Save:

উত্তর ২৪ পরগনার জগদ্দলে দলীয় কর্মী খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাংসদ-বিধায়কের মধ্যে বিবাদ চলছেই তৃণমূলের অন্দরে। খুনের ঘটনায় বৃহস্পতিবার ব্যারাকপুরের সাংসদ অর্জুন সিংহের ভাইপো পাপ্পু সিংহকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সাংসদের দাবি, জগদ্দলের বিধায়ক সোমনাথ শ্যামের কথাতেই গ্রেফতার করা হয়েছে পাপ্পুকে। এর প্রেক্ষিতে বিধায়ক পাল্টা দাবি করেছেন যে, খুনের ঘটনায় সাংসদের হাত থাকলেও থাকতে পারে। দলের দুই নেতার এই ভাবে প্রকাশ্যে বাগ্‌বিতণ্ডায় বেজায় অস্বস্তিতে পড়েছেন শাসকদলের জেলা নেতৃত্ব।

গত ২১ নভেম্বর ভাটপাড়া পুরসভার ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে পুরানি তালাও সংলগ্ন এলাকায় নিজের বাড়ির উঠোনে গুলি করে খুন করা হয় ভিকিকে। অভিযোগ, তিন জন বাইকে করে এসে এলোপাথাড়ি গুলি চালান। রক্তাক্ত অবস্থায় ভিকিকে প্রথমে স্টেট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। পরে শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে মৃত্যু হয় তাঁর। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক চাপানউতর তুঙ্গে ওঠে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে। প্রকাশ্যে চলে আসে সোমনাথের সঙ্গে অর্জুনের দ্বন্দ্ব। তৃণমূল নেতৃত্ব দু’পক্ষের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন বটে। কিন্তু পাপ্পুর গ্রেফতারিতে তা আবার জোরালো হল। বিধায়কের কথাতেই সাংসদের ভাইপো গ্রেফতার হয়েছেন বলে মনে করছেন দলের একাংশ। তাঁদের বক্তব্য, এলাকায় অর্জুনের যে ‘দাপট’ কমেছে, এই ঘটনাই তার প্রমাণ। এক জেলা নেতার কথায়, ‘‘বিধায়কের কথায় অর্জুন সিংহের ভাইপো গ্রেফতার হচ্ছে, এটা ভাবা যায় না। সাংসদ-বিধায়কের এই লড়াইয়ে প্রথম ল্যাপে পিছিয়ে পড়লেন সাংসদ!’’ সাংসদের ঘনিষ্ঠ মহলও পুলিশের উপর প্রভাব খাটানোর অভিযোগ তুলেছেন। যদিও পুলিশের দাবি, ভিকির খুনে জড়িত পাপ্পু। শুক্রবার তাঁকে আদালতে হাজির করানো হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

পাপ্পুর পরিবারের দাবি, বৃহস্পতিবার পাপ্পুকে ব্যারাকপুর কমিশনারেটের গোয়েন্দা দফতর অন্য একটি মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠিয়েছিল। এর পরেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। দলীয় সূত্রেও জানা গিয়েছে, বছরখানেক আগে রাজেন পাণ্ডে নামে এক জনকে লক্ষ্য করে গুলি চালানোর ঘটনাতেও নাম জড়িয়েছিল পাপ্পুর। সেই ঘটনার তদন্তেই তাঁকে তলব করেছিল গোয়েন্দা দফতর। সেই মতো আইনজীবী রাকেশ সিংহ-সহ কয়েক জন অনুগামীকে নিয়ে যান পাপ্পু। জিজ্ঞাসাবাদ-পর্ব শেষে বেরিয়ে আসার সময়েই তাঁকে ধরে পুলিশ। ঘটনার পরে পাপ্পুর আইনজীবীদের সঙ্গে পুলিশ আধিকারিকদের বচসাও বাধে। পরিস্থিতি সামাল দিতে বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করতে হয়।

ঘটনাচক্রে, ভিকি খুন হওয়ার পর থেকেই পাপ্পুর দিকে আঙুল তুলছিলেন সোমনাথ। সরাসরিই বলেছিলেন, ‘‘খুনের মূল চক্রী পাপ্পু। তাঁকে গ্রেফতার করলেই ঘটনার কিনারা হবে।’’ ভাইপো গ্রেফতার হওয়ার পর বিধায়ককে নিশানা করেন অর্জুন। বলেন, ধৃত মূল অভিযুক্ত পঙ্কজ ওরফে ইমরান জন্মদিনে সোমনাথের পাশে দাঁড়িয়ে কেক কাটছে। আর বিধায়ক নাম করছেন আমার ভাইপোর?’’ পাল্টা সোমনাথের দাবি, ‘‘পাপ্পু বলত, কাকার কথা ছাড়া কোনও কাজ করি না। তা হলে কি এই খুনে পরোক্ষে অর্জুন সিংহও জড়িত?’’

দলীয় কর্মী খুনে প্রথম থেকেই সাংসদ-যোগের কথা বলে এসেছেন সোমনাথ। বিধায়ক দাবি করেছিলেন, ভিকি খুনের ঘটনায় দেখা গিয়েছে, মেঘনা জুটমিলের পুরাতন লাইন থেকে বেরিয়ে ‘খুনি’রা খুন করে আবার সেখানে ঢুকে যান। এ থেকেই বিধায়কের অনুমান, কোথাও না কোথাও সাংসদ বা তাঁর পরিবারের কেউ জড়িত। সেই সময়েই পাপ্পুর নাম করতে শোনা গিয়েছিল বিধায়ককে। এর জবাবও দিয়েছিলেন অর্জুন। তিনি বলেছিলেন, ‘‘যিনি খুনের ঘটনায় আমার নাম নিচ্ছেন, তিনিই আবার বিকাশ বসু (দু’দশক আগে যুব তৃণমূলের নেতা) খুনের ঘটনায় এক অভিযুক্তকে সঙ্গে নিয়ে ঘোরেন, আর এক জন দুষ্কৃতীকে দলের ‘অ্যাসেট’ বলে উল্লেখ করছেন। পরিবার নিয়ে আঙুল তোলা হচ্ছে। আমার এক ভাইপোর কথা বলা হচ্ছে। আমার এক ভাইপো তো ওঁর সঙ্গেও আছে। উনি ভুলে গিয়েছেন, ওঁর মায়ের চাকরি হয়েছিল আমার বাবার দৌলতে!’’

ব্যারাকপুরে দলের একাংশের দাবি, অর্জুন বিজেপিতে চলে যাওয়ার পরেই দলে সোমনাথের উত্থান হয়। ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলেও ‘দাপট’ বা়ড়তে থাকে তাঁর। ২০২১ সালে অর্জুনের দলে প্রত্যাবর্তনের পর সেই গতি খানিকটা হলেও থমকে গিয়েছে। এর ফলে দুই নেতার বিবাদ অবশ্যম্ভাবীই ছিল। কিন্তু এত দিন তা দলের অন্দরেই সীমিত ছিল। প্রকাশ্যে কেউ কোনও মন্তব্য করতেন না। বা করলেও কেউ কারও নাম নিতেন না। কিন্তু ভিকি খুনের পর সেই বিবাদকে আর ধামাচাপা দিয়ে রাখা গেল না!

প্রকাশ্যে অর্জুনকে ‘ডিভোর্সি নেতা’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন সোমনাথ। বলেছিলেন, ‘‘সংসার ভেঙে অন্যের ঘর করতে গিয়েছিলেন। সেখানে হালে পানি না পেয়ে ফিরে এসেছেন। এখন ওঁকে কে আগের মতো মানবে!’’ মুখ্যমন্ত্রী তথা দলের সর্বময়নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই তাঁকে তৃণমূলে ফিরতে বলেছিলেন বলে পাল্টা দাবি করেছিলেন অর্জুন। তাঁর জবাব ছিল, ‘‘কিছু ছিঁচকে চোরকে দলীয় পতাকার তলায় এনে দলের মর্যাদা নষ্ট করছেন যাঁরা, তাঁরা ভুলে গিয়েছেন, আমার পতাকা লাগে না! মানুষ দীর্ঘ দিন ধরে আমাকে পাশে পাচ্ছেন। আমাকে এখানকার মানুষ চেনেন, জানেন।’’

এই দ্বন্দ্বে স্বাভাবিক ভাবেই বেকায়দায় পড়েছেন জেলা নেতৃত্ব। বিরোধীরাও কটাক্ষ করতে শুরু করেছেন। অর্জুনের ভাইপোর গ্রেফতারি নিয়ে তারা বলেন, ‘‘ঘর-ওয়াপসির পুরস্কার!’’ পাল্টা, জেলার দলের কোর কমিটির সদস্য নারায়ণ গোস্বামী বলেন, ‘‘তৃণমূল বড় পরিবার। সমস্যা যখন আছে, তার সমাধানও থাকবে। বিষয়টি খতিয়ে দেখব আমরা।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Arjun Singh TMC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy