Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

বসন্তে কীর্তন

চৈতি হাওয়া বলছে, দুয়ারে দোল। ধু ধু পূর্ণিমায় চরাচর জুড়ে খোল, এস্রাজে রাগ বসন্ত— শুনলেন দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়। বসন্তোৎসবের আগের রাত। দুধসাদা চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। নবদ্বীপে সমাজবাড়ির আকাশছোঁয়া মন্দির চূড়া বেয়ে গড়িয়ে পড়া ফাল্গুনি জ্যোৎস্নায় রাধারমণ বাগ যেন থইথই করছে। শতাব্দী প্রাচীন সে মন্দির থেকে একই সঙ্গে ভেসে আসছে সুগন্ধ আর সুর। আবির কুমকুম গোলাপজলের সঙ্গে ধূপের গন্ধে বসন্ত ম ম করছে।

রঙ্গ তহি নব অনুরাগ...।’ কৃষ্ণনগরে বসন্ত উৎসবে সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।

রঙ্গ তহি নব অনুরাগ...।’ কৃষ্ণনগরে বসন্ত উৎসবে সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।

শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০১৬ ০১:৫২
Share: Save:

বসন্তোৎসবের আগের রাত। দুধসাদা চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। নবদ্বীপে সমাজবাড়ির আকাশছোঁয়া মন্দির চূড়া বেয়ে গড়িয়ে পড়া ফাল্গুনি জ্যোৎস্নায় রাধারমণ বাগ যেন থইথই করছে। শতাব্দী প্রাচীন সে মন্দির থেকে একই সঙ্গে ভেসে আসছে সুগন্ধ আর সুর। আবির কুমকুম গোলাপজলের সঙ্গে ধূপের গন্ধে বসন্ত ম ম করছে।

ভিতরের কীর্তনের আসর থেকে সুর ভেসে বেড়াচ্ছে মন্দির চত্বর জুড়ে। সাদা মার্বেল মোড়া বিরাট নাটমন্দিরে একদিকের উঁচু বেদিতে রূপোর সিংহাসনে রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি গোলাপে গোলাপে গিয়েছে ঢেকে।

তার সামনে কীর্তনিয়া সুরেলা কন্ঠে গাইছেন, “নিরখত বয়ান নয়ন পিচকারি, প্রেম গুলাব মন হি মন লাগ। দুহুঁ অঙ্গ পরিমল চুয়া চন্দন ফাগু। রঙ্গ তহি নব অনুরাগ।” ওই অংশটি বার বার গাইতে গাইতে কীর্তনিয়া এ বার তাতে আখর জুড়লেন, “তখন নয়ন পিচকারি হল। অনুরাগের রঙে ভরা নয়ন পিচকারি হল।” দোহারের দল গলা ছেড়ে গেয়ে উঠলেন, ‘কানুর নয়ন পিচকারি হল’। মৃদঙ্গ দ্বিগুণ থেকে চৌগুণে।

আপ্লুত শ্রোতারা আনন্দে উথালপাথাল। টানা উলুধ্বনিতে ডুবে গেল কীর্তনের সুর। বিগ্রহের সামনে রাখা পাত্র থেকে মুঠো মুঠো আবির উড়তে লাগল। সুগন্ধি আবিরে গোলাপি বাতাসে বসন্ত আওল রে।


এই মাতাল সমীরণে...। বগুলাতে সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।

বৈষ্ণব মন্দিরে এমন ভাবেই বসন্ত আসে। শ্রীপঞ্চমীর সন্ধ্যা থেকেই বসন্তোৎসবের সূচনা হয় নবদ্বীপের বৈষ্ণব ভজনকুঠিতে। তারপর ফাল্গুনি পূর্ণিমা পেরিয়ে সেই চৈত্র পূর্ণিমার রাতে বসন্ত রাসে তার পরিসমাপ্তি। প্রায় দু’মাস ধরে বিস্তৃত এই বসন্তে অন্যরকম উৎসবে মাতে গৌড়ীয় বৈষ্ণবজন। যে বসন্তোৎসবের মূল উদ্দেশ্য হল ভক্তের সঙ্গে ভগবানকে মিলিয়ে দেওয়া। আবির, গুলাল, কুমকুম, রঙের আড়ালে ভক্ত এবং ভগবানের মধ্যে এক সেতুবন্ধ গড়ে তোলে ঋতু বসন্ত। বসন্তকীর্তন বিছিয়ে দেয় তার সুরের মায়াজাল। আর ভক্ত নিজের হৃদয়ে পথ কেটে প্রতীক্ষা করে। কখন সেই গভীর নির্জন পথে তাঁর চরণধূলা পড়ে। কেবলই মনে হয় ‘ওই বুঝি বাঁশি বাজে’।

এই উৎসবের সুরটি বাঁধা থাকে ঋতুর সঙ্গে মানানসই ‘বসন্ত’ রাগে। পরিচিত ধরন থেকে বেশ কিঞ্চিৎ আলাদা এই কীর্তন ‘বসন্ত-কীর্তন’ নামেই পরিচিত। যে বসন্ত-কীর্তনের সুর ছাড়া এই বসন্তোৎসব কল্পনাই করা যায় না। পণ্ডিতেরা জানাচ্ছেন, আদিতে রাধাকৃষ্ণের বসন্তকালীন লীলা এবং উপাসনা অঙ্গের বিভিন্ন গান ছিল বসন্ত-কীর্তনের মূল বিষয়বস্তু। কিন্তু চৈতন্যদেবের সময় থেকে বসন্ত কীর্তনের পরিধি অনেক বিস্তৃত হয়ে গেল। ফাল্গুনি পূর্ণিমা তিথিতে চৈতন্যদেবের জন্ম। আবার তিনি সন্ন্যাসও নিলেন এমনই এক বসন্তে। তাই একসময় এগুলিও বসন্ত-কীর্তনের অন্যতম উপজীব্য হয়ে উঠল।

নামী কীর্তনিয়া সরস্বতী দাস বলেন, “কীর্তনের নানা রকমফের আছে। তার মধ্যে কোনও বিশেষ পার্বণ উপলক্ষে যে কীর্তন গাওয়া হয় তাকে বলে পরব কীর্তন। যেমন রাস, ঝুলন, জন্মাষ্টমীর কীর্তন। বসন্ত-কীর্তনও হল তেমনি এক ধরনের পরব কীর্তন। এই কীর্তন প্রধানত বসন্ত রাগে গাওয়া হয় এবং অবশ্যই বসন্ত কালে। দোলের আগে পরে।” নবদ্বীপের বিভিন্ন মন্দিরে তিথি নক্ষত্র পঞ্জিকা মেনে, ঋতু অনুযায়ী রাধাকৃষ্ণের নিত্যসেবা হয়। যেমন— শীতকাল জুড়ে গরম জলে বিগ্রহের সেবা হয়। কিন্তু শ্রীপঞ্চমীর বা বসন্তপঞ্চমীর দিন থেকে শীতের বিদায় ধরে নিয়ে শুরু হয় বিগ্রহকে চামর দিয়ে বাতাস করা। এবং আরতি কীর্তনে গাওয়া শুরু হয় ‘চামর দুলায় নরহরি’।

প্রবীণ ভাগবত পাঠক গোরাচাঁদ ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘বৈষ্ণবদের কাছে বসন্ত মানে এক দিকে যেমন শ্রীকৃষ্ণের হোরি বা দোল-লীলা। অন্যদিকে তেমনি চৈতন্যদেবের জন্মোৎসবও বটে। দু’টি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব একই সময়ে উদ্‌যাপন করা হয়। আর বৈষ্ণব উৎসব মানেই সুর ও বাণীর যুগলবন্দি। বৈষ্ণব পদকর্তারা সুপ্রাচীন কাল থেকে বসন্তোৎসবের জন্য রচনা করেছেন অসামান্য সব পদাবলি। পাশাপাশি চৈতন্য পরবর্তী যুগে মূলত নরোত্তম দাস ঠাকুরের হাত ধরে এল চৈতন্য বিষয়ক পদ। যেগুলি হোরি কীর্তনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে উঠল।”

পড়শি দেশ, বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার গরানহাট পরগনার খেতুরি গ্রামে ষোড়শ শতকের শেষে নরোত্তম দাস একটি মহোৎসব করেন। সেখান থেকে কীর্তনের নতুন একটি ধারার জন্ম হয়। যা গরানহাটি ধারা নামে পরিচিত। সেখানে তিনি বসন্ত-কীর্তন বা হোরি কীর্তনের জন্য যেমন বসন্ত, জয়জয়ন্তী, শ্রী, গুর্জরী বা কেদারের মত ঋতু প্রধান রাগের ব্যবহার করেছেন। তেমনই তালের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন ছন্দ প্রধান চটুল তাল যাতে একটা মাতন বা দোলন আছে।

তিনি বলেন, “সাত মাত্রার চঞ্চুপুট তালের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োগ করেছেন হোরি তাল, ধামার তাল প্রভৃতি। আর এ সবই করা হয়েছে বসন্ত-কীর্তনকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে।”

কীর্তন নিয়ে দেশ বিদেশ চষে বেড়ানো কীর্তনিয়া সুমন ভট্টাচার্য জানান, গোবিন্দদাস থেকে জয়দেব হয়ে বাসুদেব ঘোষ— সব পদকর্তাদের পদে বসন্ত একটা আলাদা মর্যাদা পেয়েছে। ফলে বসন্ত-কীর্তন খুবই সমৃদ্ধ। কথা এবং সুরের আশ্চর্য মেলবন্ধন ঘটেছে এখানে। ‘শিশিরক অন্তে আওয়ে বসন্ত। ফুলল কুসুমসব কানন অন্ত’— গোবিন্দদাসের এই পদটিকে বসন্তের আগমনী ধরা হয়। অন্যদিকে ‘আওত রে ঋতুরাজ বসন্ত। খেলত রাই কানু গুনবন্ত। তরুকুল মুকুলিত অলিকুল ধাব। মদনোমহোৎসবে পিককুল রাব’। জ্ঞানদাস রচিত এই পদটি নিশ্চিত ভাবেই রাধাকৃষ্ণের বসন্তোৎসবের উদ্বোধনী। এইসব পদ ছাড়া বসন্তকীর্তন ভাবাই যায় না। জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ পুরোটাই বসন্তকেন্দ্রিক। সেখানে মোট ২৪টি গান আছে বারোটি ভিন্ন ভিন্ন রাগে। বসন্ত রাগে আছে তিনটি গান।

সুমনবাবু বলেন, “আমাদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে বসন্ত রাগ একাধিক। তবে কীর্তনে যে বসন্ত রাগ গাওয়া হয় সেটি শুদ্ধ বসন্ত। পরজ বসন্তের প্রয়োগ সাধারণত কীর্তনে হয় না। তাছাড়া হিন্দোল বা সকালের দিকে গুর্জরী, বিকেলের দিকে গৌরী, দেশবরাড়ি রাগেও গাওয়া হয়। এমনকী অবিরল রঙের ধারাস্নান বর্ষার আবেশ আনে বলে বসন্ত-কীর্তনে মল্লারও ব্যবহার হয়।”


দোলের পরিক্রমায় বিদেশি ভক্তেরা। মায়াপুরে সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।

বৈষ্ণবেরা এ ব্যাপারে আরও সতর্ক। বহু কীর্তন আছে যার সুর ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে বদলে যায়। অথচ পদটা একই থেকে যায়। যেমন মহাপ্রভুর আরতি কীর্তনের বিখ্যাত পদ ‘ভালি গোরাচাঁদের আরতি বনি’ শ্রীপঞ্চমী থেকে চৈত্রপূর্ণিমা পর্যন্ত বসন্ত রাগে গাওয়া হয়। বসন্ত বিদায় নিলেই সুরও যায় বদলে। শুদ্ধবসন্ত রাগে গাওয়া বসন্ত-কীর্তনের সঙ্গে হবহু মিলে যায় ‘মঞ্জরী অপেরা’ সিনেমায় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে জনপ্রিয় বাংলা গান— ‘আজ হোলি খেলব শ্যাম তোমার সনে, একলা পেয়েছি তোমায় নিধু বনে’।

নবদ্বীপের গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের সভাপতি তথা চৈতন্য জন্মস্থান আশ্রমের প্রধান অদ্বৈত দাস বলেন, “এখনও সমাজবাড়িতে পুরো সময় ধরে নিখুঁত ভাবে বসন্তোৎসব পালন করা হয়। অন্যত্র একাদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত উদ্‌যাপন হয়। একাদশীর দিন অভিসার, দ্বাদশীর দিন আবির খেলা, ত্রয়োদশীর দিন গোলাপজলে রঙ খেলা, চতুর্দশীর দিনও রঙ খেলা সঙ্গে নানা রসপ্রসঙ্গ এবং পূর্ণিমার দিন হোরিখেলা শেষ হয় রাস নৃত্যে। প্রতিদিনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ধরনের কীর্তন। ”

দোলপূর্ণিমার আগের সন্ধ্যায় গঙ্গার তীর ঘেঁষা সরস্বতী দাসের ছোট ভজনকুঠির নিকনো উঠোনে বসেছে বসন্ত-কীর্তনের অপূর্ব আসর। হাতে গোনা কয়েকজন রসিক শ্রোতার সেখানে আমন্ত্রণ। আড়বাঁশির সুরে শ্রীখোল বাজছে ‘দোঠুকি’ তালে। কীর্তন রসভারতী সরস্বতীদেবী ধরলেন— ‘গাওত কত রস প্রসঙ্গ বাওত কত বীণ। মৃদঙ্গ থৈয়া থৈয়া মৃদঙ্গিয়া’ তারপর আখর দিলেন ‘মৃদঙ্গ বাজছে তা তা থুইয়া, তা তা থুইয়া।’ সরস্বতীদেবী বলেন “পূর্ববঙ্গে থুইয়া শব্দের অর্থ রেখে দেওয়া। কৃষ্ণসেবায় অপ্রয়োজনীয় যে সব জিনিস তা রেখে দিয়ে বা ত্যাগ করে হোরি খেলতে এস। নিজের অন্তর-বাহির কৃষ্ণভক্তির চিরস্থায়ী রঙে রাঙিয়ে নাও। তারপর ভক্তের সঙ্গে ভগবানের নিরন্তর হোরিখেলা। ’’

প্রবীণ কীর্তনিয়ার কন্ঠ ততক্ষণে মহাজন পদাবলী ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে রবিঠাকুরে। গেয়ে উঠলেন, ‘আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা। প্রিয় আমার ওগো প্রিয়...”

অন্য বিষয়গুলি:

SpringFestival Mayapur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy