Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Crime Cattle Smuggling CBI

অনেক রাঘববোয়ালই গরু পাচারের মুনাফা পেয়েছেন, ইঙ্গিত সিবিআইয়ের

গরু পাচার নিয়ে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই যে প্রাথমিক অনুসন্ধান করেছিল, তার রিপোর্টেই উঠে এসেছিল বিশু শেখের সিন্ডিকেটের কথা।

রাজ্যের গরু পাচার চক্রের পাণ্ডা এনামুল হক (বাঁ দিকে) এবং সল্টলেকে বিএসএফ আধিকারিক সতীশ কুমারের বাড়ি সিল করছেন সিবিআই আধিকারিকরা (ডান দিকে)।  নিজস্ব চিত্র।

রাজ্যের গরু পাচার চক্রের পাণ্ডা এনামুল হক (বাঁ দিকে) এবং সল্টলেকে বিএসএফ আধিকারিক সতীশ কুমারের বাড়ি সিল করছেন সিবিআই আধিকারিকরা (ডান দিকে)। নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২০:১৩
Share: Save:

গরুর আকার অনুসারে পাচারের রেট। ধরা যাক, বাংলার ছোটখাটো গরু। এক জোড়া সেই গরু সীমান্ত পার করে বাংলাদেশে পৌঁছে দিতে বিশু শেখের সিন্ডিকেটের বাঁধা রেট ৩২ হাজার টাকা। আর গরু যদি পঞ্জাব-হরিয়ানার বা চেহারায় বড় হয়, তবে তার রেট ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা।

গরু পাচার নিয়ে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই ২০১৮ সালে যে প্রাথমিক অনুসন্ধান করেছিল, তার রিপোর্টেই উঠে এসেছিল বিশু শেখের সিন্ডিকেটের কথা। ২০১৫ সাল থেকে মালদহ-মুর্শিদাবাদ সীমান্তে গবাদি পশু পাচারের সব সিন্ডিকেটকে ছাপিয়ে কী ভাবে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিল ওই সিন্ডিকেট। আর এই একচেটিয়া কারবার করার সুযোগের পিছনে যে এ রাজ্যের একাধিক প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ‘আশীর্বাদ’ আছে, তা সিবিআই হেফাজতে থাকাকালীন জেরায় স্বীকার করে নিয়েছিলেন বিশু শেখ ওরফে এনামুল হক। এমনটাই দাবি সিবিআইয়ের গোয়েন্দাদের।

২০১৮ সালে কেরলে আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন নগদ প্রায় ৫০ লাখ টাকা নিয়ে সিবিআইয়ের দুর্নীতিদমন শাখার হাতে পাকড়াও হন বিএসএফ কমান্ডান্ট জিবু ডি ম্যাথিউ। তিনি তখন বিএসফের ৮৩ ব্যাটালিয়নের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর ব্যাটালিয়নের সদর দফতর মুর্শিদাবাদের রোশনবাগে। জিবুকে জেরা করেই জানা যায়, ওই টাকার উৎস বিশু শেখ ওরফে এনামুল হক। ওই মামলার তদন্তে যুক্ত থাকা এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘জেরায় জিবু স্বীকার করেন, গবাদি পশু পাচারে বিশু শেখের সিন্ডিকেটকে সুবিধে পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে ওই টাকা পেয়েছিলেন তিনি।” জিবুর মোবাইলের কল রেকর্ড থেকেও হদিশ মেলে বিশু এবং তাঁর শাগরেদদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের প্রমাণ। সেই সূত্র ধরেই পাকড়াও করা হয় এনামুলকেও।

আরও পড়ুন- ছিল গরু, হয়ে যাচ্ছে বাছুর, কোটি কোটি টাকা ঘুষে অভিযুক্ত বিএসএফ-শুল্ক কর্তারা, রাজ্যে সিবিআই

সিবিআইয়ের তদন্তকারীদের দাবি, এনামুলকে জেরা করতে গিয়েই জানা যায়, শুধু জিবু নন, মালদহ-মুর্শিদাবাদে কর্মরত বিএসএফের একাধিক আধিকারিক বিশুর সিন্ডিকেটকে গবাদি পশু পাচারে সাহায্য করেন। তার বিনিময়ে বিশুর সিন্ডিকেট তাদের মোটা অঙ্ক ‘ঘুষ’ দিত। তার পরেই গরু পাচার নিয়ে একটা প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু করেন সিবিআই আধিকারিকরা। ওই অনুসন্ধানের রিপোর্টে উল্লেখ, জেরায় জিবু দাবি করেছিলেন, মালদহে কর্মরত বিএসএফ কমান্ডান্ট সতীশ কুমারের মাধ্যমেই বিশুর সঙ্গে আলাপ তাঁর। গাজিয়াবাদের বাসিন্দা সতীশ ২০১৫ সালে মালদহের ২০ নম্বর ব্যাটালিয়নের কমান্ডান্ট হিসাবে দায়িত্ব পান। পরের বছরই ৮৩ ব্যাটালিয়নের দায়িত্ব পান জিবু। এই দুটি ব্যাটালিয়নই মালদহ এবং মুর্শিদাবাদের ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তের রানিনগর থেকে ধূলিয়ান পর্যন্ত এলাকায় মোতায়েন ছিল এবং সীমান্তের ওই অংশগুলিই ছিল বিশু শেখের সিন্ডিকেটের গবাদি পশু পাচারের রুট। যদিও জেরায় বিশু ওরফে এনামুল দাবি করেন, সতীশ নয়, মুর্শিদাবাদে কাজ করে যাওয়া অন্য এক বিএসএফ আধিকারিকের মাধ্যমে জিবুর সঙ্গে আলাপ হয় তাঁর।

প্রাথমিক তদন্তে সিবিআই আধিকারিকরা জেনেছেন, গবাদি পশু পাচার ওই এলাকার দীর্ঘ দিনের কারবার। একাধিক সিন্ডিকেট যুক্ত ছিল ওই ব্যবসায়। ২০১৫ সালে ব্যবসায় নামে এনামুল। সেই সময়ে মুর্শিদাবাদ জেলার এক ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক নেতা তাঁকে সাহায্য করেন। আর তার জোরেই বাকি সিন্ডিকেটগুলোকে কার্যত ‘গিলে’ নিয়ে পাচারে একচ্ছত্র হয়ে ওঠে বিশুর সিন্ডিকেট। ছোট সিন্ডিকেটগুলো বিশুর সিন্ডিকেটের অধীনে কাজ করা শুরু করে বা মিশে যায় বিশুর চক্রের সঙ্গে।

সিবিআই সূত্রে খবর, প্রাথমিক তদন্তে তাঁরা জানতে পেরেছেন, ভিন্‌ রাজ্য থেকে গবাদি পশু প্রথমে এসে পৌঁছত বীরভূমের ইলামবাজারে বিশুর এক ডেরায়। সেখান থেকে কাঁটাতারের বেড়া পার করে পড়শি দেশে পাঠানো পর্যন্ত দায়িত্ব বিশুর সিন্ডিকেটের। ইলামবাজারেই প্রতিটি গবাদি পশুর গায়ে বিশুর সিন্ডিকেটের চিহ্ন হিসাবে ইংরেজিতে ‘বিএস’ লেখা স্ট্যাম্প মারা হত। যাতে ইলামবাজার থেকে সীমান্ত পর্যন্ত যে কেউ ওই গবাদি পশু দেখলেই বুঝতে পারে, ওগুলি বিশুর সিন্ডিকেটের। এর পর ট্রাকে চাপিয়ে নিয়ে আসা হত সূতি এলাকায়। সেখান থেকেই প্রথম পাচারের রুট খোলে বিশু। পরবর্তীতে জেলার আরও বিভিন্ন জায়গায় নতুন নতুন রুট খোলে সে।

আরও পড়ুন: বিরোধীদের অনুপস্থিতির সুযোগে বিতর্ক ছাড়াই রাজ্যসভায় দু’দিনে ১৫টি বিল পাশ মোদী সরকারের

সিবিআই তদন্তকারীদের ইঙ্গিত, স্ট্যাম্প মেরে রীতিমতো ঘোষণা করে ব্যবসা করত বিশু। তার অর্থ রাজ্য প্রশাসনেরও একটা বড় অংশ বিএসএফ বা শুল্ক দফতরের মতো আর্থিক ভাবে লাভবান হয়েছে বিশুর কাছ থেকে। কারণ জেরায় বিশু ওরফে এনামুল নিজেই জানিয়েছেন, ইলামবাজার থেকে সীমান্ত পর্যন্ত কেউ যাতে তার গবাদি পশু না আটকায় তার জন্যই স্ট্যাম্প মারা হত। এক সিবিআই আধিকারিকের কথায়, ‘‘রাজ্য রাজনীতিতে খুব ভাল রকম প্রতিপত্তি না থাকলে এ ভাবে রমরমিয়ে বেআইনি কারবার চালানো সম্ভব নয়। সীমান্তে না হয় পাচারে সাহায্য করত বিএসএফ এবং কাস্টমস, কিন্তু বাকি পথে বিশুর গবাদি পশু আটকানো হত না কেন?” সূত্রের খবর, বিশু নিজেই সিবিআই আধিকারিকদের জানিয়েছেন, বিএসএফ, কাস্টমস ছাড়াও অনেকেই অর্থনৈতিক লাভবান করেছেন তিনি। তবে বিশুর দাবি কতটা ঠিক, তা খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা।

সিবিআইয়ের প্রাথমিক অনুসন্ধানে ইঙ্গিত, সতীশ ছাড়াও আরও অন্তত পাঁচ জন পদস্থ বিএসএফ এবং কয়েক জন কাস্টমস কর্তা মোটা মাসোহারা পেতেন বিশুর কাছ থেকে। তালিকায় বিএসএফের নিচুতলার আধিকারিকরাও রয়েছেন। কারণ জেরায় বিশুর দাবি, নিলামে কারচুপির পাশাপাশি, প্রতি সপ্তাহে তিন দিন মোটা অর্থের বিনিময়ে সীমান্তের নির্দিষ্ট অংশ প্রহরামুক্ত করে দেওয়া হত ১ থেকে ৩ ঘণ্টার জন্য। তার জন্য গবাদি পশু প্রতি ৫ হাজার টাকা দিতে হত নিকটবর্তী সীমান্ত চৌকি বা বর্ডার আউটপোস্টকে।

আরও পড়ুন: জিও আনল পাঁচ নতুন প্ল্যান, শুরু ৩৯৯ টাকা থেকে

আর এ সমস্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করেই তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সিবিআই। বুধবারের তল্লাশিতে সতীশ কুমারের সল্টলেকের বাড়ি থেকে বেশ কিছু নথি বাজেয়াপ্ত করেছে সিবিআই। তার মধ্যে গাজিয়াবাদ-সহ দেশের আরও বিভিন্ন জায়গায় সতীশের সম্পত্তির নথিও আছে বলে জানা গিয়েছে সিবিআই সূত্রে। অন্য দিকে, জিবু সিবিআইকে আগে জানিয়েছিলেন, সতীশের কথাতেই তিনি গাজিয়াবাদে সম্পত্তি কেনেন। সিবিআইয়ের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘অগস্ট মাসেই আমরা জিবু এবং এনামুলের বিরুদ্ধে চার্জশিট তৈরি করে ফেলেছি। আদালতে তা পেশ করতে গেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সবুজ সঙ্কেত লাগবে কারণ জিবু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে কর্মরত পদস্থ কর্মী।” কিন্তু এখনও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে সবুজ সঙ্কেত না আসায় ওই মামলায় চার্জশিট পেশ করা যায়নি। তবে নতুন মামলার অনুমতি পাওয়া গিয়েছে। তার ভিত্তিতে নতুন মামলা করা হয়েছে গরু পাচার নিয়ে। তবে গোয়েন্দাদের ইঙ্গিত, অনেক রাঘববোয়ালই এই পাচারের মুনাফা পেয়েছেন। আর তাদের মদতেই মুর্শিদাবাদে পাচারের সাম্রাজ্য চালিয়েছে বিশু ওরফে এনামুল।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy