সাহিদ আফ্রিদি
অন্ধকার হাইওয়ে ধরে ছুটন্ত বাসের মধ্যেই বাবার কোলে নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিল ক্যানসার-ধ্বস্ত ছেলেটি। ছেলে মারা গিয়েছে বুঝতে পেরেও আব্দুল করিম রা কাড়েননি, পাছে বাস থেকে নামিয়ে দেয়। রবিবার, বাকি রাতটা কান্না চেপে ন’বছরের সাহিদ আফ্রিদির হাড় জিরজিরে শরীরটা আঁকড়ে ধরে শেষতক ভোরবেলায় নেমে পড়েছিলেন ধুলিয়ানে। তার পর, কলকাতার হাসপাতালে চার দিন ধরে শয্যার জন্য হা-পিত্যেশ করে বসে থেকে ছেলের দেহ নিয়ে ফিরে আসা বাবা হাউহাউ করে কাঁদতে থাকেন খোলা আকাশের নীচে।
সোমবার সকালে ধুলিয়ানের কাছে অন্তর্দীপা গ্রামে এক চিলতে উঠোনে বসে আব্দুল করিম বলছিলেন, ‘‘হাসপাতালে দু’টো দিন চিকিৎসা পেলেও শান্তি পেতাম। আধ-মরা ছেলেটার বাসেই এন্তেকাল হয়ে গেল!’’ ছেলেকে নিয়ে কলকাতার হাসপাতালে কম ঘোরেননি আব্দুল। তাঁর দাবি, সেপ্টেম্বর মাস থেকে বার আটকে গিয়েছেন চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালে। কখনও অ্যানেসথেটিস্ট কখনও বা শয্যার অভাবে বার বার নিস্তেজ
ফিরে যেতে হয়েছে। দিন কয়েক আগে নাক-মুখ দিয়ে অনর্গল রক্তক্ষরণ শুরু হওয়ায় মরিয়া হয়ে ফের ছুটেছিলেন সেই হাসপাতালে। আব্দুল বলছেন, ‘‘অচেনা শহরে কোথায় যাব, শেষ চারটে দিন বেড পাওয়ার আশায় তাই হাসপাতালের সামনে ফুটপাতেই পড়ে থেকেছি। শেষটায় আর টানতে পারছিল না সাহিদ। ভাবলাম যা হওয়ার ঘরেই হবে। কিন্তু ঘর পর্যন্ত আর ছেলেটাকে টেনে আনতে পারলাম কই!’’
আরও পডুন: লোকাল ট্রেন চালু হলেও এখনই কপাল ফিরছে না হকারদের
চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যানসার হাসপাতালের সুপার শঙ্কর সেনগুপ্ত বলছেন, ‘‘ক্যানসার আক্রান্ত শিশুদের জন্য সাকুল্যে ৯টা শয্যা। সব ভর্তি। কোথায় জায়গা দেব বলুন তো!’’ তাঁর পাল্টা অভিযোগ, ‘‘মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শয্যা-সংখ্যা বাড়াতে পারে তো রাজ্য। তাতে গাঁ-গঞ্জের রোগীদের এতটা পথ ছুটতে হয় না!’’
আব্দুল ধুলিয়ান শহরে পাড়ায় পাড়ায় মাছ ফেরি করেন। তাঁর স্ত্রী সেরিনা বিবি বিড়ি শ্রমিক। তাঁদের ছোট ছেলে সাহিদ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল লকডাউন শুরুর মুখেই। শরীরে নানা জায়গার গ্রন্থি বা গ্ল্যান্ড ফুলে উঠতে শুরু করেছিল তার। নুন আনতে পান্তা ফুরানো সংসারে ছেলের চিকিৎসার কসুর করেননি তবু। কখনও মালদহ কখনও বা বহরমপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ছেলেকে নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন সাড়ে চার মাস ধরে। গত সেপ্টেম্বরে বহরমপুর মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসকেরা শেষ পর্যন্ত বায়োপসি করানোর জন্য সাহিদকে কলকাতা পাঠানোর পরামর্শ দেন।
কিন্তু কলকাতায় কোনও দিন পা রাখেননি আব্দুল। এই অবস্থায় নিতান্ত ছাপোষা মানুষটি পাশে পেয়ে গিয়েছিলেন পড়শি গ্রামের এক যুবক মোতাহার আলিকে। কাজের সূত্রে কলকাতা যাতায়াত রয়েছে মোতাহারের। আব্দুল-সেরিনা আর তাঁদের রুগ্ণ ছেলেকে নিয়ে ১০ সেপ্টেম্বর তিনি যান কলকাতার চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালে। সেরিনা বলছেন, ‘‘সরু একটা সোনার হার ছিল, সেটা বেচেই ছেলেকে নিয়ে কলকাতা গেলাম।’’ চিকিৎসকেরা সাহিদকে দেখেই বায়োপসি করার কথা বলেন। আব্দুলের কথায়, ‘‘কিন্তু হাসপাতালে অজ্ঞানের ডাক্তার (অ্যানেসথেটিস্ট) না থাকায় আমাদের ১৪ সেপ্টেম্বর আসতে বলা হয়।’’ পিতার দাবি, এর পরেই কখনও চিকিৎসক বা অ্যানেসথেটিস্ট নেই, কখনও নেই ‘বেড’— তারিখ বদলে যেতে থাকে, কিন্তু সাহিদের চিকিৎসা আর শুরু হয় না।
আব্দুল বলেন, ‘‘১৪ সেপ্টেম্বরের পরে ১৮, তার পর ২২, তার পর ২৫— বার বার অসুস্থ ছেলেকে কাঁধে করে হাসপাতালে আসতে থাকি। শেষ পর্যন্ত অক্টোবরে সাহিদকে ভর্তি করানো যায় হাসপাতালে। দু’সপ্তাহ পরে চিকিৎসকেরা জানান, ছেলের ক্যানসার হয়েছে, কেমোথেরাপি শুরু করতে হবে।’’ কিন্তু সেই চিকিৎসা আর শুরু হয়নি সাহিদের। ‘ডেট’ পেতে ছেলেকে নিয়ে কলকাতা এসে তাঁকে শুনতে হয়—বেড নেই! ছেলের কবরের দিকে তাকিয়ে আব্দুল বলেন, ‘‘শেষে যখন রক্তবমি শুরু হল তখন বুধবার তাকে নিয়ে ফের দৌড়েছিলাম হাসপাতালে। কিন্তু চার দিন ফুটপাতে পড়ে থাকলেও একটা বেড আর জুটল না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy