প্রতীকী ছবি।
পঞ্চায়েত ভোটে নিরাপত্তার জন্য রাজ্যের ২২টি জেলায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দিল কলকাতা হাই কোর্ট। বৃহস্পতিবার হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি টি এস শিবজ্ঞানম এবং বিচারপতির উদয় কুমারের বেঞ্চ এই নির্দেশ দিয়েছে। রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে আদালত বলেছে, আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জন্য কেন্দ্রকে জানাতে হবে।
রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন জমা দেওয়া নিয়ে অশান্তির আবহেই কলকাতা হাই কোর্টে কেন্দ্রীয়বাহিনীর সংক্রান্ত পুনর্বিবেচনার আর্জি জানিয়েছিল রাজ্য এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশন। সেই আর্জির শুনানির পর রায় ঘোষণার সময় হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ তাদের পর্যবেক্ষণ এবং নির্দেশ জানায়। যা পড়ে শোনান প্রধান বিচারপতি। তিনি বলেন, ‘‘বুধবার হাই কোর্ট যে রায় দিয়েছিল তা নিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের কোনও পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। আইনশৃঙ্খলার দিক থেকে দেখলে তারা এখনও কোনও স্পর্শকাতর এলাকা চিহ্নিত করতে পারেনি। কমিশন আরও দু'দিন সময় চেয়েছে। আদালত মনে করছে সময় যত গড়াবে পরিস্থিতি তত খারাপ হবে। তাই কমিশনকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, রাজ্যের সমস্ত জেলায় কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়ে আবেদন করবে। আদালতের এই নির্দেশ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কার্যকর করতে হবে। কমিশনের আবেদন মতো বিনা খরচে কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠাতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে। রাজ্য সরকার কোনও খরচ দেবে না।’’
বৃহস্পতিবার রাজ্য আদালতকে জানিয়েছিল, পঞ্চায়েত ভোটের নিরাপত্তায় যাতে পুলিশবাহিনীর ঘাটতি না থাকে, সে জন্য বিভিন্ন পড়শি রাজ্য থেকে পুলিশবাহিনী আনানোর ব্যবস্থা করছে তারা। কিন্তু আদালত বৃহস্পতিবার জানিয়ে দেয় পুলিশ নয়, কেন্দ্রীয়বাহিনীর নজরদারিতেই পঞ্চায়েত ভোট হবে রাজ্যে। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়ে আবেদন করতে হবে কমিশনকে। আর রাজ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের খরচ জোগাবে কেন্দ্র।
আদালতকে রাজ্য জানাল, ‘‘আমরা পুলিশের ব্যবস্থা করছি। সমস্ত পদক্ষেপ করা হচ্ছে। ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, বিহার, পঞ্জাব এবং তামিলনাড়ুর কাছে পুলিশ চাওয়া হয়েছে। তামিলনাড়ুর মুখ্যসচিব আশ্বাস দিয়েছেন। বাইরের রাজ্য থেকে পুলিশ আসছে। শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় বাহিনী দিলেও কি আস্থা ফিরে আসবে? গত ভোটের সময় শীতলখুচিতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে ৫-৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। সিআইএসএফ ১০ বছরের এক শিশুকে আঘাত করেছে। গ্রামে ঢুকে ভয় দেখানোর চেষ্টাও করা হয়েছে।’’
রাজ্যের আইনজীবী আদালতকে বললেন, ‘‘অলঙ্কার চুরি নিয়ে গন্ডগোল। সেটা পঞ্চায়েতের সঙ্গে একটি মামলায় বলা হয়েছে। বিদ্যুৎ না থাকা নিয়ে গন্ডগোল, গরুর লেজ কেটে দেওয়া নিয়ে গোলমাল— সব কিছুই জুড়ে দেওয়া হচ্ছে ভোটের সঙ্গে। অথচ, ১৪৪ ধারা জারি করা সত্ত্বেও পাণ্ডুয়া বিডিও অফিসে সিআরপিএফ নিয়ে ঢোকার চেষ্টা করেছেন লকেট চট্টোপাধ্যায়। সেটা জনস্বার্থ মামলায় বলা হয়নি।’’
আদালতের কাছে কল্যাণের প্রশ্ন, ‘‘সব ঘটনায় পুলিশ পদক্ষেপ করেছে। ভাঙড়ের ঘটনায় ৫২ জন গ্রেফতার হয়েছে। এডিজি আমাকে বলছেন, আমরা কাজ করছি। সকাল থেকে এখানে এক জন এডিজি দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ক্যানিংয়ে ৪টি মামলা দায়ের হয়েছে। সেখানে পুলিশের উচ্চপদস্থ অধিকারিকরা উপস্থিত রয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করছেন। ২৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাঁকুড়ায় ১৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার পরেও বলা হবে পুলিশ কাজ করছে না!’’
রাজ্যের আইনজীবী কল্যাণ বললেন, ‘‘আমার থেকে এখানে কে বেশি জানে রাজনীতি নিয়ে, জনগণের আগ্রহ সম্পর্কে? ২০০৩ সালে পঞ্চায়েত ভোটে অনেককে হত্যা করা হয়েছে। আমি অনেক ঘটনার সাক্ষী। কারা পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতির এমন সংস্কৃতি নিয়ে এসেছে? এখনও অবধি কত মনোনয়ন হয়েছে জানেন? ধর্মাবতার, আমি অনুরোধ করব নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তাই এই অবস্থায় কোনও মন্তব্য বা নির্দেশ দেবেন না যাতে কোনও রাজনৈতিক দল ফায়দা তুলতে পারে।’’
রাজ্যের তরফে আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘কোনও রাজনৈতিক দল মনোনয়ন দিচ্ছে না। মনোনয়ন দেবে প্রার্থীরা। প্রার্থীরা মনোনয়ন জমা দেবেন। এখানে প্রার্থীরা কোথায়? প্রার্থীরা তো আসছেন না। বলা হচ্ছে, বিজেপি কর্মীরা প্রতি দিন আক্রান্ত হচ্ছেন। কোন মামলাকারী আক্রান্ত? সংবাদমাধ্যমের দেওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে মামলা করা হয়েছে। আমিও কি আগামিদিনে সংবাদমাধ্যমে কোনও খবর নিয়ে এসে অভিযোগ করব?’’
কমিশনের আইনজীবী বললেন, ‘‘পদক্ষেপ করা হয়েছে। নিরাপত্তা নিয়ে কমিশন বৈঠক করেছে। দু'এক দিন সময় লাগবে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে বাহিনী চাওয়া হবে। একটি রাজনৈতিক দল অন্য দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে। কোনটা সত্যি জানা নেই। ’’
পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে বিরোধীদের জনস্বার্থ মামলায় হাই কোর্ট যে রায় ঘোষণা করেছিল, তা পুনর্বিবেচনা করার আর্জি জানিয়ে বৃহস্পতিবার আদালতে গিয়েছিলেন রাজ্যের আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে রাজ্য ছাড়াও কমিশন এবং বিরোধী দল বিজেপি এ নিয়ে বৃহস্পতিবার হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির দ্বারস্থ হয়।
প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করে আইনজীবী কল্যাণ বলেন, ‘‘সাতটি স্পর্শকাতর জেলায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। কিন্তু স্পর্শকাতর এলাকাই এখনও চিহ্নিত হয়নি। তাই এই রায় পুনর্বিবেচনা করা হোক।’’ কমিশনও জানিয়ে দেয়, তারা এখনও স্পর্শকাতর বুথ চিহ্নিত করেনি। যা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন প্রধান বিচারপতি।
আইনজীবী প্রিয়ঙ্কা টিবরেওয়াল আদালতকে বললেন, ‘‘ধর্মাবতার, ভোট পরবর্তী হিংসায় কী হয়েছে আশা করি আপনি জানেন। মনোনয়ন জমা দিতে দেওয়া হচ্ছে না। মহিলাদের মারধর করা হয়েছে। আমি উত্তর দিনাজপুরে ছিলাম। এসপি-কে কত বার ফোন করেছি। কিছু হয়নি। কেন এই ভোট? এটা বাংলার শিক্ষা? নির্বাচন করার মতো পরিস্থিতি কি রয়েছে?’’
প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম এবং বিচারপতি উদয় কুমারের ডিভিশন বেঞ্চে শুনানি শুরু হয়েছে। এর আগে বৃহস্পতিবারই এই নিয়ে প্রধান বিচারপতির ভর্ৎসনার মুখে পড়েছিল রাজ্য এবং কমিশন। পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘিরে চলতে থাকা অশান্তি নিয়ে রাজ্য এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন, ‘‘স্পর্শকাতর বুথ নিয়ে যদি কমিশন সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে, তবে আদালত গোটা রাজ্যেই কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দিয়ে দেবে।’’ এমনকি, মনোনয়ন ঘিরে অশান্তির কথা উল্লেখ করে আদালত এ-ও জানিয়েছিল যে, ‘‘পঞ্চায়েত মামলা নিয়ে রায় কার্যকর করার ব্যবস্থা না হলে আদালত নিশ্চুপ দর্শকের মতো বসে থাকবে না।’’
প্রধান বিচারপতি বললেন, ‘‘আপনারা ৯ জুন বৈঠক করেছেন। আজকে ১৫ জুন। কী হচ্ছে এ সব?’’
মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ দিনে অশান্তির প্রশ্নে আদালতকে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী বলেন, ‘‘আমরা নিরাপত্তার বিষয়টি দেখছি। মুখ্যসচিব, পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল, ডিজি-র সঙ্গে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের বৈঠক হয়েছে।’’
বৃহস্পতিবার উত্তর দিনাজপুরের চোপড়ায় বিডিও অফিসে মিছিল করে মনোনয়ন জমা দিতে যাওয়ার পথে গুলি চলে। তাতে গুলিবিদ্ধ হন তিন জন। তাঁদের মধ্যে এক জনের মৃত্যুও হয় বলে জানা গিয়েছে। এ প্রসঙ্গে আদালতে আইনজীবী সুদীপ্ত দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘সব জেলায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হোক। পরিস্থিতি খুবই চিন্তাজনক।’’ আইনজীবী শামিম আহমেদ বলেন, ‘‘প্রতি মুহূর্তে আমরা আতঙ্কিত হয়ে উঠব এমন সব ঘটনা ঘটছে। চোপড়ার ভিডিয়ো আপনাকে দেখাতে পারি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy