মৃত বাবা-মায়ের সরকারি চাকরি পেতে পারেন বিবাহিত মহিলারা, জানাল কলকাতা হাই কোর্ট। — নিজস্ব চিত্র।
ছেলে ‘বিবাহিত’ হলে অসুবিধা নেই! কিন্তু মেয়ের ক্ষেত্রে ‘বিবাহিত’ হলে চলবে না! মেয়ে যদি অবিবাহিত হন তবে বিবেচনা করা যেতে পারে, নইলে একেবারেই নয়! গত প্রায় ১ দশক ধরে বার বার এই কথাগুলি যেন ‘বোঝা’ হয়ে গিয়েছে তিন ‘কন্যা’র। যদিও তিন জনই একে অপরের অপরিচিত। তবুও এক জনের সঙ্গে অন্য জনের মিল রয়েছে। যেন এক সুতোয় ঝুলছে তিন জনের ভাগ্য। কারণ, তাঁদের আইনি লড়াইটা একই। তাঁদের লড়াই বিবাহিত এবং অবিবাহিতের ‘সম্পর্কগত’ পার্থক্য মুছে ফেলার। লড়াই ঘরের মেয়ের অধিকার ফিরে পাওয়ার। এখন কলকাতা হাই কোর্টের রায়ে লড়াই জয়ের আশায় পূর্ণিমা দাস, অর্পিতা সরকার এবং কাকলি চক্রবর্তী — তিন কন্যা। কারণ, তাঁদের আবেদনের ভিত্তিতেই কর্মরত অবস্থায় মৃত বাবা-মায়ের চাকরি বিবাহিত মেয়েদের পাওয়ার ব্যাপারে পদক্ষেপ করল হাই কোর্ট।
বীরভূমের নলহাটির প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে পূর্ণিমা। পরিবারের সদস্য বাবা, মা-সহ তিন বোন। তিন জনেরই বিয়ে হয়ে গিয়েছে। পূর্ণিমা তাঁদের মধ্যে ছোট। বাবা হারুচন্দ্র দাস নিকটস্থ গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসে চৌকিদারের কাজ করতেন। ২০১১ সালের ১১ মে কর্মরত অবস্থায় মৃত্যু হয় হারুর। ক্ষতিপূরণ হিসেবে ‘মানবিকতা’র কারণে পরিবারের এক সদস্যের চাকরি পাওয়ার অধিকার রয়েছে। সেই মতো ২০১২ সালে চাকরির জন্য আবেদন করেন পূর্ণিমা। তাঁর দাবি, মা অসুস্থ এবং তাঁর কোনও শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। তাই মায়ের পরিবর্তে চাকরিটা তাঁকে দেওয়া হোক। চাকরি পেলে তিনি মায়ের দেখাশোনা করবেন। কিন্তু সেই আবেদনে সাড়া দেয়নি রাজ্যের পঞ্চায়েত দফতর। তাদের যুক্তি, রাজ্যে এমন কোনও আইন নেই যেখানে বলা হয়েছে, বিবাহিত মেয়েরা কর্মরত অবস্থায় মৃত বাবা-মায়ের সরকারি চাকরি পাবেন। অধিকাংশ জায়গায় পুরুষদের ক্ষেত্রে মৃতের স্ত্রী বা ছেলে এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে মৃতের ছেলে সরকারি চাকরির জন্য বিবেচিত হতে পারেন, কিন্তু বিবাহিত মেয়ে চাকরির জন্য উপযুক্ত নন। এই যুক্তির বিরুদ্ধে হাই কোর্টের দ্বারস্থ হন পূর্ণিমা।
অন্য দিকে, রাজ্য পুলিশের কনস্টেবল পদে চাকরি করতেন নদিয়ার অমিত সরকার। তিনি ওই জেলার পুলিশ সুপারের গাড়ি চালাতেন। ২০০৯ সালের ১৯ জুলাই মৃত্যু হয় অমিতের। রেখে যান বৃদ্ধা মা, স্ত্রী এবং একমাত্র কন্যা অর্পিতাকে। বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে অর্পিতা এখন বাপের বাড়িতেই থাকেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে অর্পিতার মা চাকরি করতে অপারগ। তাই বাবার জায়গায় যে কোনও পদে তিনি চাকরিটা পেলে সংসার চালাতে সুবিধা হয়। অর্পিতার ক্ষেত্রেও সরকার জানায়, যে হেতু তিনি বিবাহিত, তাই তাঁকে চাকরি দেওয়া সম্ভব নয়। তাঁর মাকে চাকরি দেওয়া যেতে পারে। উপায় না দেখে আদালতের কড়া নাড়েন অর্পিতা।
মা, নিভারানি চক্রবর্তী পূর্ত দফতরে পিওন পদে কাজ করতেন। একমাত্র মেয়ে কাকলির সংসার চলত মায়ের সরকারি চাকরির উপর নির্ভর করে। কারণ, তাঁর স্বামী প্রতিবন্ধী। কাজ করতে পারেন না। কাকলির ছেলেও শারীরিক এবং মানসিক ভাবে দুর্বল। তাঁদের মাসিক আয় মেরেকেটে ৬০০ টাকা, তা স্বীকার করেছে উত্তর ২৪ পরগনার হাবরা পুরসভা। ওই পুর এলাকারই বাসিন্দা কাকলিরা। ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর হঠাৎ কর্মরত অবস্থায় মৃত্যু হয় নিভারানির। অসহায় হয়ে পড়েন কাকলি। মায়ের পরিবর্তে একটি চাকরি পাওয়ার জন্য পূর্ত দফতরে আবেদনে করেন তিনি। বিবাহিত হওয়ার জন্য তাঁর আবেদনও খারিজ হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে হাই কোর্টে আসেন কাকলি।
একে একে এই তিন ‘কন্যা’র মামলাই ওঠে হাই কোর্টে। আদালত প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে মনে করে, তিন জনের সমস্যাই অভিন্ন। তাঁরা বিবাহিত হওয়ার জন্য কর্মরত অবস্থায় মৃত বাবা-মায়ের সরকারি চাকরি পাননি। মামলাগুলির শুনানির জন্য তিন বিচারপতির বিশেষ বেঞ্চ গঠন করে হাই কোর্ট। ২০১৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি নিশীথা মাত্রে, বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত এবং বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তীর বিশেষ বেঞ্চ রায় দেয়, এই তিন বিবাহিত মেয়েকে চাকরি দিতে হবে। মামলাকারীদের এক আইনজীবী অঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘সে সময় উচ্চ আদালত তিন জনকে চাকরি দেওয়ার নির্দেশ দেয়। ২০০৮ সালের ২ এপ্রিল শ্রম দফতরের বিজ্ঞপ্তি থেকে অবিবাহিত শব্দটিও মুছে দিতে বলে আদালত। এমনকি অবিবাহিত মেয়েরাই যে মৃত বাবা মা’র চাকরি পাবেন রাজ্যের সেই বক্তব্য খারিজ হয়ে যায়। এই রায় আগামিদিনে অনেক বিবাহিত মেয়েকে চাকরি পাওয়ার অধিকার দিয়েছে।’’
হাই কোর্টের এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে যায় রাজ্য। তাদের যুক্তি, সাধারণ সরকারি চাকরির সঙ্গে এই চাকরির পার্থক্য রয়েছে। এ ক্ষেত্রে মানবিক কারণে পরিবারের কোনও এক সদস্যকে চাকরি দেওয়া হয়ে থাকে। ফলে কোনও মেয়ে বিবাহিত হলে তখন ধরে নেওয়া হয় যে, সে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। তিনি তখন অন্য পরিবারের সদস্য। তাই বিবাহিত মেয়েদের চাকরির ক্ষেত্রে সমস্যা এবং অসুবিধা— দুই-ই রয়েছে। শীর্ষ আদালত অবশ্য হাই কোর্টের রায়ই বহাল রাখে। তবে সেই রায়ের পাঁচ বছর পরেও তিন জন চাকরি পাননি বলে অভিযোগ।
এখনও চাকরি না পাওয়ার কারণে গত মাসে পূর্ণিমারা আদালত অবমাননার মামলা দায়ের করেন। ২৮ সেপ্টেম্বর বিচারপতি সৌমেন সেন, বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী এবং বিচারপতি সৌগত ভট্টাচার্যের বিশেষ বেঞ্চ শ্রম দফতর-সহ রাজ্যের তিনটি দফতরের আধিকারিকের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননায় ‘রুল’ জারি করে। আগামী ১০ নভেম্বর এই মামলার পরবর্তী শুনানি। ওই দিন তিন দফতরের আধিকারিককে জানাতে হবে তাঁরা কেন এত দিনেও আদালতের নির্দেশ কার্যকর করেননি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy