Advertisement
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪
Buddhadeb Bhattacharjee Death

রাজনীতিকদের মধ্যে এই মাধুর্য দেখা যায় না

ওঁর সাহিত্যপ্রীতি, ললিতকলার প্রতি শ্রদ্ধা, সংস্কৃতি-অঙ্গনের জন্য কাজ করার ইচ্ছা— এ-সব কিছুই ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্বের উষ্ণীষ দিয়েছিল বুদ্ধদেবকে। আর-পাঁচজন রাজনীতিকের মধ্যে এই মাধুর্য সহজে দেখা যায় না।

ব্রিগেডের সমাবেশে জ্যোতি বসুর সঙ্গে।

ব্রিগেডের সমাবেশে জ্যোতি বসুর সঙ্গে। —ফাইল ছবি।

রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত (নাট্য ব্যক্তিত্ব)
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০২৪ ০৮:২৭
Share: Save:

আমরা যেখানে থাকতাম, উত্তর কলকাতার সেই পাড়া থেকে শ্যামপুকুরের ভট্টাচার্যবাড়ি মিনিট পাঁচেক হাঁটাদূর। সে-বাড়ি বা সে-পাড়ায় সজীব বামপন্থা প্রবহমান ছিল। সে-বাড়িরই সন্তান বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। এবং-অবশ্য-এবং তিনি সুকান্ত ভট্টাচার্য নামের বিস্ময়কবির উত্তরপ্রজন্ম। ওই পাড়া, শ্যামপুকুর স্ট্রিট, লাহা কলোনির মাঠ, ভট্টাচার্যবাড়ি একটা ব্যাপার ছিল! আমার চেয়ে অনেক ছোট বুদ্ধদেবের সঙ্গে সে সময়ে দেখা হলেও আলাপ হয়েছিল কি না, মনে করতে পারি না। কারণ, তখন ছোটগলি-বড়গলি-রাজপথ সবর্ত্রই বহু-বুদ্ধ, বহু-রুদ্র ছুটে বেড়াচ্ছে। তাই কইয়ের ঝাঁকে তখন আমরা ছোট-বড় সবাই কই। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে আমার ‘ফর্মাল’ পরিচয়, যখন উনি নামী রাজনীতিক, রাইটার্স বিল্ডিংয়ে। ‘ইনফর্মাল’ পরিচয় পথঘাটপ্রান্তরে।

মুগ্ধতা রয়েছে লোকটিকে ঘিরে। মুগ্ধতাই শ্রদ্ধাবোধের সূতিকা। চাপিয়ে দেওয়া নয়। রাজনৈতিক কারণেও নয়। বিষয়টা সার্বিক। ওঁর সাহিত্যপ্রীতি, ললিতকলার প্রতি শ্রদ্ধা, সংস্কৃতি-অঙ্গনের জন্য কাজ করার ইচ্ছা— এ-সব কিছুই ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্বের উষ্ণীষ দিয়েছিল বুদ্ধদেবকে। আর-পাঁচজন রাজনীতিকের মধ্যে এই মাধুর্য সহজে দেখা যায় না।

হেঁটে যাচ্ছি। গাড়ি থামল। ‘‘কোথায় যাচ্ছেন, রুদ্রদা? উঠুন।’’ নান্দীকারে পৌঁছে দিলেন। বহু বার। উষ্ণহৃদয়। বলা হয়, সম্ভাব্যতার বেড়াজালের মধ্যেই না কি রাজনীতি কাজ করে। অসম্ভবের পায়ে মাথা কুটে তাকে অতিক্রম করার চেষ্টা রাজনীতির সাধারণ লোকেরা করতে পারেন না এবং করেনও না। বুদ্ধদেব এই নিষেধনীতি মানতেন না। রাজনীতিতে ব্যতিক্রমীই। যাঁদের জন্য জনপ্রতিনিধিত্ব, সেই সাধারণ নাগরিকদের সঙ্গে যোগাযোগ তো জরুরি। বুদ্ধদেববাবু ষখন মন্ত্রী, তখন যিনি মুখ্যমন্ত্রী, সেই জ্যোতি বসু খুব কম কথা বলতেন। ভাবটা এমন যেন, এই সব আম-জাম শ্রেণির সঙ্গে কথা বলব কেন! যে টুকু বলার বলব এবং সেটিই বেদবাক্য হবে! জ্যোতি বসু ‘আমরা’ বলতেন না। বলতেন ‘আমি’।

বুদ্ধদেব ঠিক উল্টো ভাবনার। ভুল-দোষ মিলিয়েই। দেখেছি, মহাকরণে বুঁদ হয়ে ক্রিকেটের ধারাবিবরণী শুনছেন। আমি খিদিরপুর ক্লাবে ত্রিকেটে ফার্স্ট ডিভিশনে যোগ দিয়েছিলাম, বিয়ে করার বাসনায় মাঠ ছাড়ি। এ নিয়ে অনেক প্রশ্ন করেছিলেন। ‘রুদ্রদা’ সদুত্তর দিতে পারেনি।

‘দুঃসময়’ লিখেছিলেন। নান্দীকারের ‘শেষ সাক্ষাৎকার’ প্রযোজনা দেখার পর গুম। নাটকটি রাজনৈতিক। সেখানে মন্ত্রীকে পদত্যাগ করার দাবি এক সাধারণ নাগরিকের। বহু নেতামন্ত্রী ওই নাটক দেখেছিলেন। শো বন্ধ করার ‘সুপ্রয়াস’ও হয়েছে। মন্ত্রী বুদ্ধদেবের গুমভাবের কারণ বুঝতে অসুবিধা হয়নি। উনি যে ক্ষেত্রে কাজ করেন, তাকে আঘাত করেই তো ওই নাটক। কিন্তু ভালবাসা তাঁর কমেনি কখনও আমাদের প্রতি। পড়ুয়ালোক, লেখক। দুঃখের বিষয়, লেখালিখির সময় পেতেন না। মন্ত্রিবুদ্ধ-লিডারবুদ্ধ-পার্টিজানবুদ্ধ সময় কেড়ে নিয়েছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের।

বুদ্ধদেবের রাজনীতি নিয়ে শংসা-নিন্দা-প্রতর্ক হয়েছে। শুধু বলতে চাই, ‘রক্তকরবী’র রাজা কিন্তু আমাদের ভাবায়। বুদ্ধদেবের প্রাপ্য ছিল শুদ্ধ রাজনৈতিক সঙ্গীসাথী। আলিমুদ্দিনের গণ্ডিদাগ তাঁর মাপের সঙ্গে যায় না।

আমি সেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে চিনি, যিনি আপাদমস্তক আন্তর্জাতিক বাঙালি। নান্দীকারের জাতীয় নাট্যমেলায় যিনি মন্ত্রিত্ব-মুখ্যমন্ত্রিত্বের আবরণ ভেঙে নিজে থেকেই চলে আসতেন। গান শুনে, কবিতা পড়ে, অভিনয় দেখে যাঁর মুখ আলো হত, চোখ জল ঝরায় যাঁর। যিনি তথাকথিত রাজনীতি সামলেও বাড়ি ফিরে লেখার টেবিলে কলম খুঁজতেন।

খুঁজছেনও হয়তো এখন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE