বিধানসভা ভবনে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে শ্রদ্ধা শুভেন্দু অধিকারীর। রয়েছেন (বাঁ দিক থেকে) সুজন চক্রর্বতী, শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম, অরূপ বিশ্বাস, অভিষেক বন্দ্য়োপাধ্যায় প্রমুখ। শুক্রবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের দো’তলার ঘরে ডিম্বাকৃতি টেবিলে খোলা বই। তাঁর নির্দিষ্ট চেয়ারে মগ্ন তিনি। প্রায় আবদারের সুরেই বলা গেল, ‘‘খবর দিন না কিছু! নতুন কিছু করবেন?’’ বই থেকে মুখ উঠল। স্মিত হাসি মুখে ছড়িয়ে তিনি বললেন, ‘‘আমি আর কী খবর দেব? আর নতুন কিছু আমাকে দিয়ে হবে নাকি! নতুনেরা করবে। আমাকে দিয়ে আবার বিসমিল্লায় গিয়ে শুরু করা হবে না!’’
অনন্য বাচনভঙ্গিতে কয়েকটা বাক্যেই তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। অসুস্থতার ধাক্কা সামলেও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তখন দলের রাজ্য দফতরে আসেন। তাঁর কাছে এই প্রশ্নকর্তার বহু দিনের অনুনয় ছিল, আত্মজীবনী লিখতে হবে! সে দিনও প্রশ্নটা তোলা হয়েছিল। লিখছেন ওটা? ‘‘আত্মজীবনী থাক। তবে লিখছি। এ বার চিন নিয়ে। এগিয়েছি অনেকটা।’’ জানিয়েছিলেন সিপিএমের লেখক, নাট্যকার এবং চলচ্চিত্র-প্রেমী নেতা।
কয়েক মাস পরে সামনে এসেছিল বুদ্ধদেবের লেখা সেই পুস্তিকা। ‘স্বর্গের নীচে মহাবিশৃঙ্খলা’। চিনের চোখ-ধাঁধানো অগ্রগতির পাশাপাশিই সে দেশে দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাধির বিশ্লেষণ। মুখ্যমন্ত্রী হয়ে যখন রাজ্যে বিনিয়োগ টানতে এবং শিল্পায়নের পথে এগোতে যাচ্ছেন, সে সময়ে দেং জিয়াও পিঙের সঙ্গে তাঁর তুলনা হত। ‘বেড়াল যে রঙেরই হোক, ইঁদুর ধরতে পারলেই হল’ — দেঙের দেশের এই প্রবচনে বিশ্বাস রাখতেন বুদ্ধদেব। আবার সেই তিনিই চিনের সমাজতন্ত্রের মডেলকে অন্ধ অনুসরণ না করে তার ত্রুটি-বিচ্যুতিকে নজরে রাখতে চেয়েছেন। বুদ্ধদেবের ব্যাখ্যা ছিল, ‘‘কারও পক্ষে বা বিপক্ষে দাঁড়ানোর ব্যাপার নয়। যা বাস্তবে প্রমাণিত, সেটাই সত্য। শুধু তত্ত্ব নয়। এটা মার্ক্সীয় ভাবনা, আমি সেটা ধরেই চলার চেষ্টা করেছি।’’
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর প্রয়াণের পরে তাঁর স্ত্রী মীরা ভট্টাচার্যকে পাঠানো চিঠিতে কংগ্রেস নেতা এবং লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী লিখেছেন, ‘মতাদর্শের গোঁড়ামিতে বাঁধা পড়ার লোক ছিলেন না বুদ্ধদেব’। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের বহুচর্চিত ঘটনা এবং নানা বিতর্ক সরিয়ে বুদ্ধদেবের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির হদিস পেতে গেলে রাহুলের এই বিশ্লেষণ নির্ভুল মনে হবে। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর প্রচেষ্টা, কর্মকাণ্ড সব ২০১১ সালে বিপুল ভোটে পরাজিত হয়েছিল। কিন্তু তার অনেক পরেও চিন সংক্রান্ত বইয়ে বুদ্ধদেব স্পষ্ট করে লিখেছেন, ‘বাজারের অর্থ কী? বাজার মানেই পুঁজিবাদ নয়। বাজার সমাজতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী, দুইয়েরই কাজে আসতে পারে। পুঁজিবাদী উৎপাদনের কিছু কিছু সাফল্য, কিছু উৎপাদন ব্যবস্থা বা পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য। পাশাপাশি, সমাজতন্ত্রে ব্যক্তি পুঁজির ভূমিকাও থাকবে। সরকারের লক্ষ্য দুইয়েরই উন্নয়ন। বাজার যে ভাবে চাইবে, সেই ভাবে এগোবে। শেষ পর্যন্ত কর্তৃত্ব থাকবে সরকারের হাতে’।
তাঁর দল বা বামপন্থী শিবিরের বড় অংশ যখন চিন নিয়ে কেবলই মুগ্ধ, বুদ্ধদেব তখন প্রশ্ন তুলে গিয়েছেন। চিনে গিয়ে সরেজমিনে দেখে যা শেখার শিখেছেন। আবার যা ভাল লাগেনি, তা-ও বলেছেন। দলের অন্দরে মতাদর্শগত দলিল তৈরির সময়ে চিন সংক্রান্ত প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় মানবাধিকার লঙ্ঘন বা দুর্নীতির অভিযোগের কথা তুলেছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে চিন যে লড়ার চেষ্টা করছে, তারও উল্লেখ করেছেন।
শুধু ভাল-মন্দের চিনই নয়, তাঁর ভাবনা ছিল ‘সর্বহারার একনায়কতন্ত্রে’র মন্ত্র নিয়েও।
শিল্প-চেষ্টা আর সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামই সব নয়। বুদ্ধদেবের সঙ্গে বিদায় নিল ভাবনা-প্রয়াসী একটা মনও!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy