—প্রতীকী ছবি।
গড়িয়া লাগোয়া ব্রহ্মপুর হোক, বা বীরভূমের গণ্ডগ্রাম। রাজ্যের সর্বত্র ‘রা’ প্রায় একই। গত ১০ বছরে রাস্তার উন্নতি হয়েছে চোখে পড়ার মতো। পাইপ বেয়ে পরিস্রুত পানীয় জল এসেছে এমন অনেক এলাকায়, যেখানে আগে তার দেখা মিলত না। কাজ হওয়ার অভিজ্ঞান হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে সেতু, সাঁকো, কালভার্ট। তবে অভিযোগও আছে। কোথাও ক্ষোভ এক দশক পরেও বঞ্চনার। বহু জায়গায় আবার পথচলতি মানুষের মন্তব্য, ‘‘এক বর্ষা যেতে-না-যেতেই ‘চোকলা’ ওঠে, ‘দাঁত’ বেরিয়ে আসে অনেক রাস্তার। একই রাস্তা মেরামত করতে হয় বারবার।’’ বিরোধী বয়ানে আসল কারণ, ‘কাটমানি-কালচার’।
যেমন, জঙ্গলমহল। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ঝাড়গ্রামে প্রথম প্রশাসনিক সভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, দীর্ঘ বাম শাসনের পরেও যে সমস্ত এলাকা দুর্গম রয়ে গিয়েছে, সেখানে যোগাযোগ সুগম করাই তাঁর লক্ষ্য। এলাকাবাসীদের বড় অংশ মনে করেন, রাস্তাঘাটের প্রভূত উন্নতি হয়েছে জঙ্গলমহলে। কিন্তু তেমনই তা তৈরির কিছু দিনের মধ্যে বেহাল হওয়ার দৃষ্টান্তও হাজির। অনেক ক্ষেত্রে একই রাস্তা বহু বার সংস্কারের বরাত দেওয়ার পিছনে শাসকদলের ‘মেজো-সেজো-ছোট’ নেতার ‘কাটমানির’ হাত দেখেছেন স্থানীয় মানুষ। আবার কিছু ক্ষেত্রে কাজ শেষ না-করেই পাততাড়ি গুটিয়েছেন ঠিকাদার! তাই একই ঝাড়গ্রামে স্বাধীনতার পরে রাস্তা-ঘাটে সব থেকে বেশি কাজ হওয়ার কথা যেমন বহু জন নির্দ্বিধায় মানছেন, তেমনই কান পাতলে শোনা যাচ্ছে ‘কাটমানির’ কথাও।
এক সময়ে রাস্তা নিয়ে প্রবল ক্ষোভ ছিল উত্তরবঙ্গের মানুষের। ভাঙা রাস্তার উপর দিয়ে দুলতে দুলতে চলা বাসের যাত্রীদের সফরের বিবরণে নিত্যদিন উঠে আসত আতঙ্ক আর বিরক্তির কথা। ১০ বছরে সেই ছবি অনেকটাই বদলেছে। নদিয়া, হুগলি থেকে বীরভূম, বর্ধমান থেকে দুই চব্বিশ পরগনা— রাস্তা সম্পর্কে অনেকখানি প্রশস্তি আর এখনও কিছুটা অভিযোগের হাত ধরাধরি সর্বত্র। কলকাতায় গঙ্গার ঘাটের সৌন্দর্যায়ন যেমন নজর কেড়েছে, তেমনই প্রশ্ন, সামান্য বৃষ্টিতেই মহানগরীর কিছু রাস্তার দশা বেহাল কেন? মুর্শিদাবাদ থেকে শুরু করে মেদিনীপুর— গ্রামের বহু কাঁচা রাস্তা পাকা হয়েছে। সরকারের দাবি, তৈরি হয়েছে ৭৯ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি রাস্তা। মেরামতি ও সম্প্রসারণ হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কিলোমিটার রাজ্য সড়কের।
মুখ্যমন্ত্রী যখনই কোনও জেলায় প্রশাসনিক বৈঠকে গিয়েছেন, খবর নিয়েছেন রাস্তা-সাঁকো-পুলের মতো পরিকাঠামো প্রকল্পের। অনেক সময়ে ‘কাটমানির’ অভিযোগ শুনে প্রকাশ্যে বকাঝকা করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে। কিন্তু প্রত্যাশা সর্বত্র মেটেনি। যেমন, পূর্ব বর্ধমানে সপ্তগ্রাম-ত্রিবেণী-কালনা-কাটোয়া রাজ্য সড়কের একাংশ বেহাল। ক্ষোভ, অবরোধ লেগেই রয়েছে। ধীর গতিতে কাজে ক্ষুব্ধ মন্ত্রী স্বপন দেবনাথই।
অগ্রগতি হয়েছে বাড়িতে পাইপে পরিস্রুত পানীয় জল পৌঁছনোয়। সরকারি হিসেব অনুযায়ী, বাম জমানার শেষে যেখানে ৩৮% বাড়িতে পাইপে জল পৌঁছত, এখন তা ৫৬%। কিন্তু কেন্দ্রের অভিযোগ, মোদী সরকারের ‘হর ঘর পানি’ প্রকল্প রূপায়ণে গড়িমসির। আবার মুর্শিদাবাদ-সহ বিভিন্ন জেলার বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ আর্সেনিকের সমস্যার সুরাহা পাননি। বরং এর আতঙ্ক কিছুটা ‘গা সওয়া’ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তেমনই আবার বীরভূমের ফ্লোরাইড কবলিত এলাকায় ৫৮ কোটি টাকার পানীয় জল প্রকল্পের কাজ শেষের মুখে। জলের সঙ্কট পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি সংলগ্ন কিছু এলাকা, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, দুই দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বিস্তীর্ণ এলাকায়। অথচ মোটের উপরে ‘জল-ছবি’ বেশ খানিকটা ভাল দুই বর্ধমানে।
বিদ্যুৎমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, গত দশ বছরে বিদ্যুৎ পরিষেবায় উন্নতি হয়েছে বিদ্যুৎ গতিতে। গ্রাহক বেড়েছে ১৩৬%। বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১০ হাজার মেগাওয়াটের বেশি হওয়ায় বিদ্যুৎ কার্যত উদ্বৃত্ত। শহর হোক গ্রাম— বিদ্যুৎ পৌঁছেছে প্রায় সমস্ত বাড়িতে। বিরোধীদের অবশ্য কটাক্ষ, বড় শিল্প না-থাকায় চাহিদা কম। তাই উদ্বৃত্তের বড়াই। বিদ্যুৎ পরিষেবার পরিকাঠামো কী অবস্থায়, তা আমপানের পরে বোঝা গিয়েছে বলেও তাঁদের দাবি।
দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোর উন্নতি চোখে পড়ার মতো হলেও, বাণিজ্যিক পরিকাঠামোয় ঘাটতি এখনও যথেষ্ট বলে মনে করে শিল্পমহল। তাজপুর বন্দরের কাজ এখনও শুরু করা যায়নি। সম্প্রতি অন্ডালকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করার কথা বাজেটে বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু কী উপায়ে সেটি সম্ভব, তা অস্পষ্ট। বিশেষত যেখানে বাণিজ্যিক উড়ানে এখনও কঠিন মুনাফার মুখ দেখা।
শিল্পের দাবি, দেশে লগ্নির পছন্দের গন্তব্য হয়ে উঠতে এ রাজ্যে পরিকাঠামোর উন্নয়ন প্রয়োজন আরও অনেকখানি। তা সে পণ্য মজুতের গুদাম হোক বা চওড়া রাস্তা। বহু পরিকাঠামো প্রকল্পের পথে জমি-জট বাধা। কোথাও প্রাচীর লাল ফিতের ফাঁস। দশ বছরে এই ছবি পাল্টায়নি।
অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, লগ্নি টানতে যে পরিবেশ প্রয়োজন, যে সমস্ত শর্ত পূরণ জরুরি, এ রাজ্যে তার বেশ কিছু এখনও অমিল। তেমনই শহর-গ্রাম-রাস্তা সুন্দর করে রক্ষণাবেক্ষণের তাগিদও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকাঠামো উন্নয়নের অন্যতম শর্ত। অভিযোগ, রাজ্যের বাসিন্দাদের অনেকের মধ্যে সেই সচেতনতা কম। প্রশ্ন, সেই তাগিদ তৈরির ‘ঠেলা’ দিতে উপযুক্ত নীতিই বা গত দশ বছরে রাজ্য সরকার আনল কোথায়?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy