E-Paper

বইমেলায় কথায় গল্পে ফিরে এল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও নবনীতা দেবসেন -এর স্মৃতি

কলকাতা বইমেলা ২০২৩

কলকাতা বইমেলা ২০২৩

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৭:৩৮
Share
Save

শনিবার, ঘড়ির কাঁটায় তখন প্রায় দুপুর তিনটে। বইমেলায় ধীরে ধীরে বাড়ছে ভিড়। ভর্তি হচ্ছে এসবিআই অডিটোরিয়াম। কারণ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং নবনীতা দেবসেন। কথায়, গল্পে, আড্ডায় ফিরে দেখা সেই দুই ব্যক্তিত্বকে, যাঁদের লেখা বুকে নিয়ে বেঁচে রয়েছে নতুন প্রজন্ম। সেই কিংবদন্তীদের নিয়েই স্মৃতিচারণ করলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সুবোধ সরকার, শুভঙ্কর দে এবং সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এঁদের প্রত্যেকের জীবনের কোনও না কোনও অংশ জুড়ে ছিলেন সুনীল ও নবনীতা।

বইমেলা জুড়ে হুল্লোড় থাকলেও অনুষ্ঠানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অডিটোরিয়ামের ভিতরে থাকা প্রত্যেকে যেন ছিল ঘোরের মধ্যে। স্মৃতিরও কোনও ঘোর থাকে? হয়ত থাকে। যে ঘোর মনে পড়িয়ে দেয়, নীললোহিতের উপন্যাস ‘যুবকযুবতীরা’ বা নবনীতা দেবসেনের ‘নটী নবনীতা’।

এ দিনের স্মরণসভার সূচনা করেন নাট্যব্যক্তিত্ব সৌমিত্র মিত্র। অনুষ্ঠান সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন সুপর্ণা মজুমদার। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের এমন দুই উজ্জ্বল নক্ষত্রের স্মৃতিচারণের সময় স্বভাবতই ভাষা হারিয়ে ফেলছিলেন তিনি।

স্মৃতিচারণ শুরু করেন লেখক, কবি সুবোধ সরকার। তিনি বলেন, বইমেলার অনেকটা জুড়েই রয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং নবনীতা দেবসেন। এঁরা দু’জনেই এমন লেখক, যাঁরা হৃদয়ের অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছেন। এঁদের লেখা পড়ে বড় হয়েছি আমরা। নবনীতা দেবসেন এমন একজন লেখিকা, যাঁর লেখা শেষ করলে মুখে যেন হাসি লেগে থাকে। মস্কো আন্তর্জাতিক বইমেলায় আমন্ত্রিত ছিলেন নবনীতা দেবসেন। তখন অক্সিজেন নল তাঁর নাকে। অথচ বইয়ের প্রতি তাঁর ভালবাসা এতটাই ছিল যে সেই অবস্থায় তিনি সেই বইমেলায় গিয়েছিলেন। এবং মজার বিষয় হল ওই শারীরিক অবস্থায় তিনি বিতর্ক সভায় অংশ নিয়েছিলেন। অসম্ভব ভাল তার্কিক ছিলেন নবনীতা। ওঁর লেখা ‘ট্রাকবাহনে ম্যাকমোহন’ আজও আমায় অবাক করে দেয়। নারী ক্ষমতায়নের এক চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত এই লেখা। আমরা প্রত্যেকেই নবনীতা দির কাছে বকা খেয়েছি। তাঁর সেই ভালবাসা, ব্যক্তিত্ব, স্নেহ ভোলা বড় মুশকিল।

অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে সুবোধ সরকার

অন্যদিকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা বলতে গিয়ে সুবোধ সরকার বলেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর কাছে ভীষণভাবে কবি। তিনি বাংলার কবিতায় বিপ্লব এনেছিলেন। বলা ভাল, প্রথাগত কবিতাকে তছনছ করে এই শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলিকে গদ্যে প্রকাশ করেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ভীষণ বন্ধু ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি এ দিন বলছিলেন, প্রতিভাবানরা গতে বাঁধা নিয়ম মানে না। সুনীলের অফুরান প্রাণশক্তিও মানত না। বন্ধুকৃত্যে জুড়ি নেই। অথচ কেউ কথা রাখেনি। কেউ কথা রাখে না। সুনীলও রাখেনি হয়ত। সুখে, দুঃখে আমরা পাশাপাশি থেকেছি। ঘটনাচক্রে আমরা সহকর্মীও ছিলাম। সুনীল ছিল নাস্তিক। অনেকটা চাঁদবণিকের মতো। সুনীল ও স্বাতী আমেরিকা গিয়েছে। বাসে বসে আছে। সেই বাসের দুর্ঘটনা হয়। সুনীলের কোনও চোটও লাগেনি। এক বার সুনীলের বাড়িতে আগুন লেগেছিল। আবার নিজের থেকে নিভেও গিয়েছে। আমি বহুবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এর পরেও তোমার ভগবানকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। সুনীল শুধু হেসেছিল।

সুনীল আসলে এমন একটা মানুষ, যাঁর জনপ্রিয়তা ছিল উত্তমকুমারের মতো। এমন সফল মানুষ আমি খুবই কম দেখেছি। আমি নিজে ভাবতাম, কী ভাবে একটা মানুষের এত গুণমুগ্ধ থাকতে পারে। এক সঙ্গে কত জায়গায় আমরা গিয়েছি। একসময় ওর প্রতিটা কবিতা আমার মুখস্থ থাকত। পরে যখন গদ্য লিখতে শুরু করে সুনীল, তখন কবিতা লেখা অনেক দূরে গিয়েছে। নবমীর সকালে যখন সুনীলের খবর শুনলাম, আমার পৃথিবী যেন টালমাটাল হয়ে গেল। আমি সেদিন সুনীলের বাড়িতে যেতে পারিনি। কারণ, সেদিন আনন্দবাজার পত্রিকায় সুনীলের অবিচুয়ারি লিখতে হয়েছিল আমায়। ওর চলে যাওয়ার জায়গাটা আজও শূণ্য হয়ে রয়ে গিয়েছে।

বক্তব্য রাখছেন বিশিষ্ট লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

বক্তব্য রাখছেন বিশিষ্ট লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

অন্যদিকে নবনীতা দেবসেনকে নিয়েও খানিকটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। এত প্রাণোচ্ছ্বল, স্ফুর্তিতে পরিপূর্ণ একটা মানুষকে দেখে আমি প্রায়শই বলতাম, ‘বিধাতা আপনাকে আর কী কী দিতে বাকি রেখেছে বলুন তো! একটা পরিবারে এত বিখ্যাত মানুষ থাকে কী ভাবে? এক সময় নিজে গাড়ি চালিয়ে যাদবপুর পড়াতে যেতেন।’ তাঁর লেখা এতটা অকপট ছিল, যা আমায় চমকে দিয়েছে। তার অফুরান, প্রাণবন্ত জীবন যে কোনও মানুষের অনুপ্রেরণা।

কথায়, গল্পে, শনিবার বইমেলার এসবিআই অডিটোরিয়াম যেন হয়ে উঠেছিল এক টুকরো দিকশূণ্যপুর। যে রাস্তা দিয়ে স্মৃতির মহল্লায় ফিরে এসে ছিলেন কাকাবাবু নিজে।তাঁর সম্পর্কে বলতে গিয়ে সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় তুলে ধরলেন কত-শত স্মৃতির কথা। খুব কাছ থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে দেখেছিলেন সঙ্গীতা। জীবনে চলার পথে অনেকটা সময় সুনীলের সান্নিধ্যে পেয়েছিলেন তিনি। মাত্র তেরো বছর বয়সে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা পড়েছিলেন তিনি। কলেজে পড়ার সময় একবার তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্য মনের একরাশ কথা লিখে ১০-১২ পাতার চিঠি লিখে আনন্দবাজারে দিয়ে এসেছিলেন সঙ্গীতা। তাঁর কাছে নীললোহিত মানেই আজও রোমান্টিসিজম। রবিবারের এক আড্ডায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতেই প্রথম মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়েছিল তাঁর। জীবনের চলার পথে তাঁর লেখা আমায় পথ দেখিয়েছে।

বরং শুভঙ্কর দে তাঁর খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন নবনীতা দেবসেনকে। পিসি বলে ডাকতেন তাঁকে। বইমেলার মঞ্চ থেকেই ফিরে গেলেন স্মৃতিচারণায়। যখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মারা যান, সেদিন নবনীতা দেবসেন শ্মশান থেকে ফেরার পথে এক সাংবাদিক পিসিকে প্রশ্ন করে, “নবনীতা দি আপনার কেমন লাগছে?” এই ধরনের প্রশ্ন প্রায়শই করা হয়ে থাকে। নবনীতা দেবসেন উত্তর দিয়েছিলেন, “আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। আমার বন্ধু আজ চলে গিয়েছে তো, তাই আনন্দ।” আর সেটা কতটা কষ্টে বলেছিলেন সেটা বুঝেছিলাম তাঁর কথা শুনে এবং তাঁকে দেখে। নবনীতা দেবসেন যখন মারা যান, তখন আমি বাংলাদেশে। তাঁর মৃত্যুর পরে আমি তাঁকে নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম। লেখাটির নাম দিয়েছিলাম ‘আদুরে বাসা’। যখন নবনীতা দেবসেনের ক্যানসারের চতুর্থ স্টেজ, তখন তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়। সেই সময়েও পিসি বলেছিলেন, ‘আমি চলে যাওয়ার আগে আমার বইগুলো সব পড়ে ফেলবি তো!’

বইমেলায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও নবনীতা দেবসেন-এর স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে দ্য বেঙ্গল-এর সদস্য ঈশা দত্ত

সময় চলে যাবে সময়ের মতো করে। সাদা-কালো পাতায় অমর সৃষ্টিতে থেকে যাবেন নবনীতা দেবসেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

Kolkata Book Fair 2023 Literature Sunil Gangopadhyay Nabanita Deb Sen

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।