কোচবিহার জেলা পরিষদের ৯ নম্বর আসনের বিজেপি প্রার্থী পিঙ্কি বর্মণ। —ফাইল চিত্র ।
রাজ্য রাজনীতিতে তাঁর প্রবেশ আচমকা। জেলা পরিষদের আসনে দাঁড়িয়ে জয়ের ব্যাপারে নিশ্চিতও ছিলেন। কিন্তু ফল তেমনটা হয়নি। প্রায় আট হাজার ভোটে তিনি হেরে গিয়েছেন। তিনি অর্থাৎ পিঙ্কি বর্মণ। কোচবিহার তথা বাংলার সমস্ত জেলা পরিষদের আসন মিলিয়ে বিজেপির একমাত্র বৃহন্নলা প্রার্থী। সমাজসেবামূলক কাজের জন্য মাথাভাঙার মানুষ যাঁকে একডাকে চেনেন। পিঙ্কির দাবি, তাঁর নিজের লোকেদের (তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ) অনেকেই তাঁকে সমর্থন করেননি। বাকি ভোট ‘জবরদস্তি’ করে তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সে জন্যই হেরে গিয়েছেন। যদিও ভোটে হেরে গিয়ে বিজেপি ছাড়তে বা অন্য কিছু ভাবতে রাজি নন পিঙ্কি। বুধবার আনন্দবাজার অনলাইনকে স্পষ্ট জানালেন, তৃতীয় লিঙ্গের জন্য তাঁর লড়াই চলবে। পাশাপাশি, এখন তাঁর লক্ষ্য ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন।
এ বারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে কোচবিহার জেলা পরিষদের ৯ নম্বর আসনে বিজেপি থেকে দাঁড়িয়েছিলেন পিঙ্কি। রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে তাঁর নামের পাশে লিঙ্গপরিচয়ে ‘অন্যান্য’ লেখা। এই ‘অন্যান্য’ প্রার্থীকে নিয়ে গেরুয়া শিবিরের ভরসাও ছিল যথেষ্ট। পিঙ্কি নিজেও যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, তিনি জিতবেন। গত লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে কোচবিহারে ভাল ফল করেছিল বিজেপি। যদিও ফলপ্রকাশের পর দেখা গেল, জেলা পরিষদের ৩৪টি আসনের মধ্যে ৩২টিতেই হেরেছে বিজেপি। জয় এসেছে মাত্র দু’টি আসনে। গ্রাম পঞ্চায়েত এবং পঞ্চায়েত সমিতির ফলাফলেও মুখ থুবড়ে পড়েছে গেরুয়া শিবির। পঞ্চায়েত সমিতির ৩৮৩টি আসনের মধ্যে ৩০১টিতে তৃণমূল জিতেছে। বিজেপি জিতেছে ৮১টি আসনে। গ্রাম পঞ্চায়েতের ২,৫০৭টি আসনের মধ্যে তৃণমূলের দখলে ১,৮৩৪টি আসন। অর্থাৎ, কোচবিহারের ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েতে শাসক তৃণমূলেরই রমরমা।
কিন্তু এলাকায় এত জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও কেন হেরে গেলেন পিঙ্কি? পিঙ্কি বলছেন, ‘‘জবরদস্তি আমার সব ভোট কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আমার লোকজনই তো আমাকে ‘সাপোর্ট’ করল না। সব ভোট নিয়ে নিয়েছে। প্রায় আট হাজার ভোটে আমি হেরে গিয়েছি।’’
যদিও ভোটে হেরে একটুও দমতে রাজি নন পিঙ্কি। তিনি এখন থেকেই আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেবেন বলেও জানিয়েছেন। পিঙ্কির কথায়, ‘‘তৃতীয় লিঙ্গের জন্য আমার লড়াই চলবে। পাশাপাশি, আমি ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। তবে প্রার্থী হব না। দলের জন্য কাজ করব। দলকে বাদ দেব না।’’
কোচবিহার শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে মাথাভাঙার অশোকবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা পিঙ্কি। জন্মের পরেই মাকে হারান। পিঙ্কির বাবা হন্যানারায়ণ বর্মণ ছিলেন কৃষক। মাকে হারানোর পরে দিদিদের কাছে মানুষ হন। পিঙ্কির বয়স যখন ১০ বছর, হঠাৎ একদিন অনুভব করেন আর পাঁচটা মেয়ের মতো নন তিনি। নিজের শারীরিক গঠন দিয়ে বুঝতে শেখেন নিজেই। লিঙ্গপরিচয়ের জন্য লেখাপড়ার সুযোগও পাননি। বৃহন্নলার জীবন নিয়ে কিছুটা ভবঘুরে হয়ে যান। এখন অবশ্য নিজের গ্রামেই রয়েছেন। পিঙ্কির কথায়, ‘‘যা শিখেছি, সবটাই জীবনের অভিজ্ঞতা। আমার পরিচয় জানার পরে সমাজও আমায় ভাল চোখে দেখেনি। অনেক লাঞ্ছনা, গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে।’’
তবে সমাজের ‘বঞ্চনা’ সহ্য করলেও পিঙ্কি বদলা চাননি। তিনি বদল চান। তাঁর মতো মানুষকে নিয়ে এই সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন চেয়েছেন। পিঙ্কি জানাচ্ছেন, এই বদল একেবারে তৃণমূল স্তর থেকে হতে হবে। তবেই অন্য ভাবে দেখতে শিখবে সমাজ। তিনি এ-ও বুঝেছেন, খুব বড় কিছু করতে গেলে রাজনৈতিক পরিচয় বেশ কাজে দেয়। সেই কারণেই তাঁর রাজনীতিতে আসা। অতঃপর বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ।
পঞ্চায়েত ভোটে প্রার্থী হওয়ার জন্য মারামারি, লাঠালাঠির অন্ত ছিল না। টিকিট না পেয়ে কেউ দল বদলেছেন। কেউ হয়েছেন নির্দল। কিন্তু পিঙ্কিকে প্রার্থী করার ব্যাপারে বিজেপির ভাবনাচিন্তা ঠিক কী ছিল? স্থানীয় বিজেপি নেতারাও বলছেন, ‘‘এমনি এমনি প্রার্থী করা হয়নি পিঙ্কিকে। সমাজসেবামূলক কাজের জন্য মাথাভাঙার মানুষ পিঙ্কিকে একডাকে চেনেন। কোনও রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়া আগে থেকেই উনি স্থানীয়দের মধ্যে জনপ্রিয়।’’ লোকসভা বা বিধানসভার ভোটের মতো পঞ্চায়েত ভোটে প্রার্থীদের জয় শুধুমাত্র দলের নামে বা ভারে আসে না। এমনটাই মনে করা হয়। বরং এলাকায় ব্যক্তিগত পরিচিতি এবং জনপ্রিয়তার উপরেও সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর জেতা-হারা নির্ভর করে। তাই বিজেপিও পিঙ্কির ‘খ্যাতি’কে কাজে লাগাতে চেয়েছিল বলেই রাজনৈতিক মহলের পর্যবেক্ষণ।
পিঙ্কি অবশ্য এমন কথায় কান দেন না। বিজেপি তাঁর জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়েছে, এমনটা বিশ্বাসও করেন না তিনি। প্রার্থী হওয়ার পর আনন্দবাজার অনলাইনকে পিঙ্কি বলেছিলেন, ‘‘আর কোনও দলের বৃহন্নলা প্রার্থী রয়েছে কি না, জানি না। আমি শুধু জানি বিজেপি, বিশ্বের সবচেয়ে বড় দল আমায় প্রার্থী করেছে। তাই আমি খুব গর্বিত। খুব খুশি।’’
স্থানীয়দের মতে, পিঙ্কি ‘অন্যান্য’ হয়েও ‘অনন্য’। রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার আগে এক জন সাধারণ বৃহন্নলার মতোই জীবনযাপন ছিল তাঁর। সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। বাড়ি বাড়ি সন্তান হলে ‘ছেলে, না মেয়ে’ খোঁজ নেওয়াই ছিল তাঁর কাজ। সেখান থেকেই আয়। তা দিয়েই চলত সংসার। পাশাপাশি, ‘মনসা গানের’ গায়িকা হিসাবে ওই এলাকায় সুনাম আছে তাঁর। নাচেও তিনি সমান দক্ষ। তবে উপার্জনের টাকা শুধু নিজের জন্য খরচ করেন না পিঙ্কি। অনাথ বৃহন্নলাদের জন্য একটি আশ্রম তৈরি করেছেন। নাম: ‘জীবনগাড়ি ফেরিওয়ালা’। বৈরাগীর হাট এলাকায় ওই আশ্রমের মধ্যে এখন বয়স্কদেরও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন পিঙ্কি। পিঙ্কির কথায় ‘‘মা-বাবাদের জন্যই এই আশ্রম।’’
পিঙ্কি জানিয়েছেন, পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপির টিকিটে হেরে গেলেও তিনি বিজেপিতেই থাকবেন। দল করবেন মন দিয়ে। কিন্তু রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার ফলে তাঁর সমাজসেবার কাজে কি বাধা আসবে? জবাবে তিনি সাফ জানিয়েছেন, রাজনীতিকে কখনও সমাজসেবার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে দেবেন না। তাঁর কথায়, ‘‘সমাজসেবামূলক কাজ যেমন চলছিল, তেমনই চলবে। ওই কাজ কখনও বন্ধ করব না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy