Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Sovan Chatterjee

শাহের সভায় বার বার ডাক, শোভন ‘বাইরে’, পুরভোটের দরজা প্রায় বন্ধ

বিজেপি সূত্রে যা জানা গিয়েছে, তাতে পুরভোটে শোভনের সক্রিয় অংশগ্রহণের সম্ভাবনা প্রায় তলানিতেই বলা যায়।

বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বার্তায় সাড়া নেই শোভন চট্টোপাধ্যায়ের। —ফাইল ছবি

বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বার্তায় সাড়া নেই শোভন চট্টোপাধ্যায়ের। —ফাইল ছবি

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ২৩:১১
Share: Save:

পুরভোটের আগে কি সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরছেন তিনি? প্রশ্ন প্রায় গোটা রাজনৈতিক শিবিরেরই। কিন্তু সে সম্ভাবনায় আপাতত শেষ পেরেকটা পুঁতে দিলেন কলকাতার প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় নিজেই। ১ মার্চ কলকাতায় মেগা-জনসভা অমিত শাহ, জগৎ প্রকাশ নড্ডাদের। সভামঞ্চে থাকার অনুরোধ করে একাধিক বার বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বার্তা গেল শোভনের কাছে। কিন্তু প্রাক্তন মেয়র এ বারও সে ডাকে সাড়া দিচ্ছেন না বলে জানা যাচ্ছে। কলকাতার বাইরে থাকায় অমিত শাহের সভায় যেতে পারছেন না তিনি, এ কথা বিজেপি নেতৃত্বকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে খবর।

দরজায় কড়া নাড়ছে পুরভোট। ফলে সাড়ে আট বছর কলকাতার মেয়র পদ সামলানো শোভন চট্টোপাধ্যায়কে নিয়েও চর্চা বাড়ছে রাজনৈতিক শিবিরে। ২১ ফেব্রুয়ারি সে চর্চা লাফিয়ে বেড়েছিল। প্রায় গোটা দক্ষিণ কলকাতা ভরে গিয়েছিল শোভনের ছবি এবং বিজেপির প্রতীক সম্বলিত ব্যানারে। ‘বেহাল’ কলকাতাকে ‘স্বমহিমায়’ ফেরাতে আপনি ফিরে আসুন— শোভন চট্টোপাধ্যায়ের প্রতি এই রকম আহ্বান জানানো হয়েছিল সেই সব ব্যানারে। ওই ব্যানারকে ঘিরে রাজনৈতিক শিবিরে তুমুল কৌতূহল তৈরি হয়েছিল। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া শোভন দেননি। ব্যানার-কাণ্ডের পরে যে তিনি সক্রিয় হয়ে উঠলেন, এমন কোনও ছবিও দেখা যায়নি।

শোভনকে সক্রিয় করে তুলতে চেয়ে ব্যানার লাগিয়েছিলেন কারা? এ প্রশ্নের উত্তর এখনও মেলেনি। ব্যানার লাগানোর সঙ্গে নিজেদের সংযোগের কথা অস্বীকার করেছিলেন বিজেপি নেতৃত্ব। তবে দলের স্থানীয় কর্মীরা ব্যানার লাগিয়ে থাকতে পারেন— এমন মন্তব্য করেছিলেন খোদ রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ। শোভন চট্টোপাধ্যায় সক্রিয় হন এবং নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসুন, এমনটা তিনি চান বলেও দিলীপ সে দিন জানিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন: লাগামছাড়া হিংসার নিশানায় মুসলিমরাই, দাবি মার্কিন কমিশনের, অভিযোগ খারিজ দিল্লির​

দীর্ঘ দিন সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে সরে থাকা শোভন এ বার হয়তো নামতে পারেন আসরে, পুরভোটের মুখে কলকাতায় হয়তো বিজেপির হাল ধরতে পারেন তিনি— এই রকম জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছিল ব্যানার কাণ্ডের পরে। শোভনের নাম ও দলের প্রতীক সম্বলিত ব্যানার নিয়ে রাজ্য বিজেপির শীর্ষনেতারা ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দিতে থাকায় সে জল্পনা আরও বাড়ে। কিন্তু বৃহস্পতিবার বিজেপি সূত্রে যা জানা গিয়েছে, তাতে পুরভোটে শোভনের সক্রিয় অংশগ্রহণের সম্ভাবনা প্রায় তলানিতেই বলা যায়।

১ মার্চ শহিদ মিনার ময়দানে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা বিজেপির অন্যতম শীর্ষনেতা অমিত শাহের জনসভা। বিজেপি সভাপতি জে পি নড্ডাও থাকবেন। সেই মঞ্চেই শোভনকেও চাইছিলেন বিজেপি নেতৃত্ব। পুরভোটের আগে কলকাতায় এত বড় সভা যখন হচ্ছে, তখন সেই সভামঞ্চই আনুষ্ঠানিক ভাবে সক্রিয়তায় ফেরার জন্য শোভন চট্টোপাধ্যায়ের পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত হবে বলে বিজেপি নেতারা মনে করেছিলেন।

বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বুধবার থেকে এ পর্যন্ত একাধিক বার যোগাযোগ করেছেন শোভন চট্টোপাধ্যায় এবং বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। অমিত শাহের সভায় যাতে তাঁরা উপস্থিত থাকেন, তার জন্য বার বার অনুরোধ করা হয়েছে। শোভন চট্টোপাধ্যায় মঞ্চেই স্থান পাবেন এবং পুরভোটের মুখে কলকাতার প্রাক্তন মেয়র অমিত শাহের মঞ্চে উপস্থিত থাকলে খুব তাৎপর্যপূর্ণ ছবি তৈরি হবে— এমন বার্তাও বিজেপির তরফে দেওয়া হয়েছে বলে খবর। কিন্তু অমিতের সভায় শোভন যাচ্ছেন না বলে জানা গিয়েছে।

আরও পড়ুন: পঞ্চায়েতের ছবি যেন না ফেরে পুরভোটে: কমিশনকে সতর্ক করলেন ধনখড়

শোভনের ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রের খবর, তিনি এখন কলকাতায় নেই। যে দিন অমিত শাহের সভা হবে, সে দিনও বাইরের থাকার কথা শোভনের। তাই ওই সভায় তিনি যোগ দিতে পারবেন না বলে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

শোভন ওই জনসভায় যেতে পারবেন না শুনেই বিজেপি নেতৃত্ব হাল ছেড়ে দিয়েছেন, এমন কিন্তু নয়। এখন বাইরে থাকলেও অমিতের সভার আগে শোভনের ফিরে আসা উচিত— এই বার্তাও বিজেপির তরফে দেওয়া হয় বলে খবর। শোভন যদি একান্তই না ফিরতে পারেন, তা হলে বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্তত যাওয়া উচিত ওই সভায়— এমন অনুরোধও প্রাক্তন মেয়রের বাড়িতে গিয়েছে বলে খবর। কিন্তু তাতেও কোনও ইতিবাচক সাড়া মেলেনি।

২০১৯-এর শেষ দিকেও অমিত শাহ কলকাতায় এসেছিলেন। নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে সভা করেছিলেন তিনি। সে সভাতেও শোভন চট্টোপাধ্যায় এবং বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কে ডাকা হয়। কিন্তু শোভনরা সেখানেও যাননি। পরে সিএএ-র সমর্থনে কলকাতায় বিশাল মিছিল করেন জে পি নড্ডা। সেখানেও শোভনদের দেখা যায়নি। ২০১৯-এর ১৪ অগস্ট দিল্লির বিজেপি কার্যালয়ে গিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে পদ্মফুলের পতাকা হাতে তুলে নিয়েছিলেন শোভন-বৈশাখী। তার এক সপ্তাহের মাথায় বঙ্গ বিজেপির সদর দফতরে তাঁরা সংবর্ধনা নিতে গিয়েছিলেন। সেই শেষ। তার পর থেকে বিজেপির কোনও অনুষ্ঠানে বা কোনও দলীয় কর্যালয়ে শোভন চট্টোপাধ্যায় পা রাখেননি। পুরভোটের মুখে কলকাতায় অমিত শাহ যে সভা করতে আসছেন, সেখানেও শোভন হাজির থাকবেন না বলে স্পষ্ট হয়ে গেল এ দিন। অতএব এই পুরভোটে শোভনকে আদৌ সক্রিয় রাজনীতির ময়দানে দেখা যাবে কি না, তা নিয়ে বিস্তর সংশয় তৈরি হয়ে গেল।

আরও পড়ুন: ‘দিল্লির ঘটনায় আপ নেতা জড়িত থাকলে, তাঁর দ্বিগুণ শাস্তি হোক’​

বিজেপির হয়ে ময়দানে না নামলে যে পুরভোটে সক্রিয় হওয়ার আর কোনও রাস্তা শোভনের নেই, তা কিন্তু নয়। বিজেপি ছাড়ার কথা শোভন ঘোষণা করেননি, সে কথা ঠিক। কিন্তু শোভন বিজেপিতে যাওয়ার আগে তাঁর সঙ্গে তৃণমূলনেত্রী তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্ক যে রকম তলানিতে পৌঁছেছিল, এখন কিন্তু আর পরিস্থিতি তেমন নয়। ভাইফোঁটার দিন শোভন এবং বৈশাখী চমকে দিয়েছিলেন মমতার বাড়ি গিয়ে। তার পর থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে শোভন চট্টোপাধ্যায়ের বেশ কয়েক বার যোগাযোগ হয়েছে বলে খবর। রাজ্যের মন্ত্রিত্ব এবং কলকাতার মেয়র পদ থেকে শোভন ইস্তফা দেওয়ার পরে মমতার সঙ্গে শোভনের যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। শোভন বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরে স্বাভাবিক কারণেই দূরত্ব আরও অনেক বাড়ে। কিন্তু ভাইফোঁটার পর থেকে সে ছবি বদলে গিয়েছে। মমতার সঙ্গে শোভনের যোগাযোগের সুতোটা আবার জোড়া লেগে গিয়েছে। সুতরাং তৃণমূলের হয়েও শোভন নতুন করে মাঠে নামতে পারেন— এমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিতে চান না রাজনৈতিক শিবিরের একাংশ।

কিন্তু তৃণমূল সূত্রের খবর, রাজ্যের শাসক দলে ফেরাটা আর অতটা মসৃণ হবে না শোভনের পক্ষে। দলে শোভনের ঠাঁই হবে না, এমন নয়। কিন্তু জেড প্লাস নিরাপত্তা পাওয়া মন্ত্রী, কলকাতার মেয়র, দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের দাপুটে সভাপতি— একসঙ্গে যে এত কিছুর যে সমাহার ছিল শোভনের মুকুটে, তৃণমূলে সে সবের সিকিভাগও তিনি আর ফিরে পাবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় বিস্তর। তা ছাড়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগসূত্র নতুন করে তৈরি হলেও, দলের অন্য অনেক প্রভাবশালী মহলই শোভনকে এখন আর জমি ছাড়তে রাজি নন বলে খবর। কলকাতার বর্তমান মেয়র ফিরহাদ হাকিমের সঙ্গে শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সমীকরণ এখন কতটা তিক্ত, তা রাজ্যের রাজনৈতিক শিবিরে প্রায় সকলেরই জানা। তৃণমূলে ক্ষমতার অন্যতম কেন্দ্র হয়ে ওঠা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনোভাব শোভনের প্রতি কেমন, তা নিয়েও গুঞ্জন প্রবল। তাই শোভন নিজেও আর তৃণমূলে ফিরতে চান না বলে তাঁর ঘনিষ্ঠরা বার বারই দাবি করেন।

অতএব পুরভোটে সক্রিয় হয়ে ওঠার জন্য বিজেপি-ই ছিল শোভনের কাছে সবচেয়ে সুবিধাজনক মঞ্চ। গত কয়েক মাস ধরে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যে ভাবে লাগাতার শোভনের সঙ্গে যোগাযোগ করছিলেন, তাতে এ-ও স্পষ্ট যে, বিজেপির হয়ে পুর-যুদ্ধের ময়দানে নেমে পড়লে তিনি যথেষ্ট গুরুত্বই পেতেন। বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বের একাংশের সঙ্গে শোভনের যে মনান্তর হয়েছিল, তা কাটানোর চেষ্টাও শুরু করেছিলেন এ রাজ্যের একাধিক নেতা। অন্তত প্রকাশ্যে শোভন বা বৈশাখী সম্পর্কে কোনও বিরূপ মন্তব্য করছিলেন না বিজেপির কোনও গুরুত্বপূর্ণ নেতাই। বরং মেয়র হিসেবে শোভনের কাজের প্রশংসা বা শোভনের নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতার কথাই শোনা যাচ্ছিল বিজেপির রাজ্য নেতাদের মুখে।

তার পরেও শোভনকে হাজির করানো যাচ্ছে না অমিত শাহের মঞ্চে। প্রাক্তন মেয়রের ঘনিষ্ঠ বৃত্ত অন্তত তেমনই জানাচ্ছে। বিজেপি নেতাদের মতে, পুরভোটের প্রস্তুতি যে রকম তুঙ্গে, তাতে আর দেরি করা চলে না, মাঠে নামার হলে এখনই নামা জরুরি। কিন্তু কলকাতার প্রাক্তন মেয়র তথা বেহালা পূর্বের বিধায়ক যে আপাতত সামনে আসার ‘মুডে’ নেই, তা বেশ স্পষ্ট। অতএব এই পুরভোটের দরজা দিয়ে ফের দাপটের সঙ্গে রাজনীতিতে ফিরে আসার সুযোগও প্রায় তাঁর হাতছাড়া হওয়ার মুখে। মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের বড় অংশই।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy