Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Manish Shukla

মণীশ-হত্যা ঘিরে তপ্ত কলকাতাও, তিক্ত বাগ‌্‌যুদ্ধে অর্জুন-ফিরহাদ

সম্প্রতি মণীশ আবার তৃণমূলে ফেরার জন্য বার্তা পাঠাচ্ছিলেন এবং তখনই তাঁকে খুন হতে হল বলে ফিরহাদ মন্তব্য করেন।

মণীশ শুক্লর মৃতদেহ নিয়ে কলকাতায় মিছিল। —নিজস্ব চিত্র

মণীশ শুক্লর মৃতদেহ নিয়ে কলকাতায় মিছিল। —নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০২০ ১৯:১৩
Share: Save:

এক দিকে উত্তপ্ত রাজপথ। অন্য দিকে কান্নার রোল। নেতা খুনের প্রতিবাদে ব্যারাকপুর মহকুমা জুড়ে সোমবার বন্‌ধ পালন করল বিজেপি। আগুন, সংঘর্ষ, লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাসে রণক্ষেত্রের চেহারা নিয়ে নিল শিল্পাঞ্চল। সে সবের মাঝেই দফায় দফায় ভিভিআইপি নেতারা হাজির হলেন দুষ্কৃতীর গুলিতে নিহত বিজেপি নেতা মণীশ শুক্লর বাড়িতে। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক কৈলাস বিজয়বর্গীয়ের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়লেন মণীশের মা। পরে শিল্পাঞ্চল ছাড়িয়ে গোলমাল পৌঁছে গেল এনআরএস হাসপাতালের গেট পর্যন্ত।

মণীশের মৃত্যুর প্রতিবাদে ১২ ঘণ্টার জন্য ব্যারাকপুর বন্‌ধের ডাক দিয়েছিল বিজেপি। সোমবার সকাল থেকেই বন্‌ধ সফল করতে গোটা মহকুমা জুড়ে রাস্তায় নামেন দলীয় কর্মী-সমর্থকেরা। খড়দহ, টিটাগড়-সহ বিভিন্ন এলাকায় বিটি রোড অবরোধ করা হয়। কোথাও রাস্তার উপরে গাছের গুঁড়ি ফেলে, কোথাও আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ চলতে থাকে। ফলে বিটি রোডের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় যান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।

অবরোধ শুরু হয় কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে, বারাসত-ব্যারাকপুর রোড-সহ অন্য অনেক রাস্তাতেই। রবিবার রাত থেকেই শিল্পাঞ্চল জুড়ে পরিস্থিতি থমথমে হতে শুরু করায় দোকান-বাজারও বন্ধ ছিল অনেক এলাকাতে। তবে সোমবার উত্তেজনার রেশ শিল্পাঞ্চলের সীমানা ছাড়িয়ে আমডাঙা বা বারাসতের দিকেও ছড়িয়ে পড়ে।

নিহত মণীশ শুক্লর মৃতদেহ নিয়ে মিছিল বিজেপির, দেখুন ভিডিয়ো:

বিটি রোড থেকে অবরোধ তুলতে বেলা ৩টে নাগাদ বড়সড় বাহিনী নামায় ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেট। সেই বাহিনী টিটাগড়ের অবরোধ তুলতে যেতেই কার্যত রণক্ষেত্রের চেহারা নিয়ে নেয় এলাকা। পুলিশ লাঠি চালিয়ে অবরোধকারীদের তুলতেই আশপাশের গলি থেকে ইট-পাটকেল উড়ে আসতে শুরু করে। হামলার মুখে পুলিশ প্রথমে কিছুটা পিছু হঠে। কিন্তু পর ক্ষণেই তারা কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটিয়ে গলিগুলোও ফাঁকা করতে শুরু করে। ঘটনাস্থলে বিজেপির যে কার্যালয় রয়েছে, তার মধ্যে ঢুকে ভাঙচুর চালানোর অভিযোগ ওঠে পুলিশের বিরুদ্ধে।
দেখুন ভিডিয়ো:

শুধু ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের বিজেপি কর্মীদের মধ্যে নয়, মণীশ হত্যাকে ঘিরে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যও এ দিন তৎপরতা ছিল তুঙ্গে। সকালেই মণীশের বাড়িতে পৌঁছন বিজেপির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা পশ্চিমবঙ্গের পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয়। বিজেপির কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মুকুল রায়, ব্যারাকপুরের সাংসদ তথা বিজেপির রাজ্য সহ-সভাপতি অর্জুন সিংহও মণীশের বাড়িতে পৌঁছন একই সময়ে। কৈলাসের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েন মণীশের মা এবং পরিজনেরা।

আরও পড়ুন: রাজনীতি না পুরনো দুশমনি? রহস্য বাড়ছে মণীশ খুনে

বিজেপির গোটা নেতৃত্ব এ দিন আরও জোর গলায় আঙুল তুলতে শুরু করেছে তৃণমূল এবং পুলিশের দিকে। রাজ্যের শাসক দল এবং পুলিশের যোগসাজসেই মণীশকে খুন করা হয়েছে, না হলে থানার সামনে ‘ব্রাশ ফায়ার’ করে মণীশকে খুন করা সম্ভব ছিল না— দিলীপ ঘোষ থেকে অর্জুন সিংহ, সবাই এ দিন এই সুরে কথা বলেছেন। অর্জুন বলেন, ‘‘যে বন্দুক থেকে গুলি চালিয়ে মণীশকে খুন করা হয়েছে, তা পুলিশ ছাড়া কারও কাছে থাকে না। ওই বন্দুক লাটবাগান (ব্যারাকপুরে সশস্ত্র পুলিশের অস্ত্রের গুদাম) থেকে বেরিয়েছিল। মণীশকে খুন করার পরে আবার সম্ভবত সেখানেই ফিরে গিয়েছে। দেখবেন, ওই অস্ত্র আর খুঁজেই পাওয়া যাবে না।’’

কলকাতায় মণীশ শুক্লর দেহ নিয়ে বিজেপির মিছিল আটকে দেওয়ার পর রাস্তায় নেমে পড়েন লকেট চট্টোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র

বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপের সুরও প্রায় একই রকম। তিনি বলেছেন, ‘‘পশ্চিমবাংলাটা ধীরে ধীরে উত্তরপ্রদেশ-বিহারের মতো মাফিয়ারাজের দিকে চলে যাচ্ছে।’’ দিলীপের কথায়, ‘‘পুলিশ পুরো ব্যাপারটাই জানে। প্রকাশ্যে স্টেনগান নিয়ে বাইকে করে কেউ ঘুরে বেড়াচ্ছে, থানার সামনে ব্রাশ ফায়ারিং হচ্ছে, পুলিশ জানে না! পুলিশই করাচ্ছে।’’ দিলীপ বলেন, ‘‘ওখানে পুলিশকে পাঠানো হয়েছে সুপারি কিলার হিসেবে। তারাই সব প্ল্যানিং করছে। আগেও একাধিক বার ওখানে বোমা-বন্দুক নিয়ে আক্রমণ হয়েছে। অর্জুন সিংহকে নিশানা করা হয়েছে। তাঁর অনুগামীদের নিশানা করা হয়েছে। আর এটা যা হয়েছে, তাতে সারা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এখন ভয়ে জীবনযাপন করবেন।’’

মিছিল আটকানোর পর পুলিশ-প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলছেন কৈলাস বিজয়বর্গীয়। —নিজস্ব চিত্র

বিজেপির এই আক্রমণের জবাব দিতে সন্ধ্যায় তৃণমূলের হয়ে আসরে নামেন কলকাতা পুরসভার প্রশাসক তথা রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। তিনি বলেন, ‘‘আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি, সব ব্যাপারে কেন তৃণমূলের নাম জড়ানো হচ্ছে! আমরা গাঁধীবাদী দল। আমরা হিংসায়, দাঙ্গায় বিশ্বাস করি না।’’ নিহত মণীশ তাঁর খুব ‘প্রিয়পাত্র’ ছিলেন বলে ফিরহাদ জানান। তাঁর দাবি, মণীশ তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যেতে চাননি, বাইরে থেকে দুষ্কৃতীদের এনে চাপ দিয়ে তাঁকে বিজেপিতে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়। সম্প্রতি মণীশ আবার তৃণমূলে ফেরার জন্য বার্তা পাঠাচ্ছিলেন এবং তখনই তাঁকে খুন হতে হল বলে ফিরহাদ মন্তব্য করেন।

মণীশ শুক্লর বাড়িতে গিয়ে তাঁর মাকে পাশে থাকার বার্তা কৈলাস বিজয়বর্গীয়র। —নিজস্ব চিত্র

তাঁর অভিযোগের আঙুল যে অর্জুনের দিকে, তা বেশ স্পষ্ট ভাবেই এ দিন বোঝানোর চেষ্টা করেন ফিরহাদ। কেন হঠাৎ মণীশের দেহরক্ষীরা থাকলেন না? রবিবার সন্ধ্যায় মণীশ যখন অর্জুনের সঙ্গে ছিলেন, তখন কেন পরে মণীশ টিটাগড়ে ফিরলেন আর অর্জুন সিংহ কলকাতার দিকে চলে গেলেন? কৈলাসের কাছ থেকে কী এমন জরুরি ফোন হঠাৎ অর্জুন পেলেন যে, তাঁকে কলকাতা চলে যেতে হল? এই সব প্রশ্ন এ দিন তোলেন ফিরহাদ। তদন্তে সব রহস্যের সমাধান হবে বলে ফিরহাদ দাবি করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘এটা উত্তরপ্রদেশ নয়। এখানে অপরাধীদের এনকাউন্টার হয় না। এখানে অপরাধীদের খুঁজে বার করে বিচারকের সামনে নিয়ে যাওয়া হয়।’’

আরও পড়ুন: রাজভবনে গেলেন না অফিসাররা, রাজ্যপালের জরুরি ডাক মুখ্যমন্ত্রীকে

এনআরএস হাসপাতালের মর্গের সামনে বসে অর্জুন জবাব দিয়েছেন ফিরহাদের এই মন্তব্যেরও। তাঁর কথায়, ‘‘ফিরহাদ হাকিমের সময় শেষ হয়ে এসেছে। মেটিয়াবুরুজ থেকে দুষ্কৃতী পাঠিয়ে খুনের রাজনীতি আর চলবে না। মণীশের খুন এত সস্তা হবে না। মন্ত্রিত্বটা যেতে দিন, লোকে ফিরহাদকে রাস্তায় পেটাবে।’’

বিজেপির প্রতিবাদ মিছিল ঘিরে উত্তেজনা। —নিজস্ব চিত্র

এনআরএস হাসপাতালে দিনভর বিজেপি নেতাকর্মীরা এ দিন ভিড় করে ছিলেন। সেখানে মণীশের দেহের ময়নাতদন্ত হয়। দুপুর থেকেই কৈলাস বিজয়বর্গীয়, অরবিন্দ মেনন, সব্যসাচী দত্ত, লকেট চট্টোপাধ্যায়, অর্জুন সিংহ, শিবাজি সিংহরায়, শঙ্কুদেব পন্ডা, রাকেশ সিংহের মতো বিজেপি নেতারা জড়ো হতে শুরু করেন এনআরএসের মর্গের দিকে ঢোকার গেটে। বিজেপির কর্মী-সমর্থকেরাও বিশাল সংখ্যায় জড়ো হন সেখানে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিরাট বাহিনী মোতায়েন করেছিল কলকাতা পুলিশও। প্রথমে বিজেপি নেতাদের ভিতরে যেতে দিতে রাজি ছিল না পুলিশ। শুধু মণীশের পরিজনদের ঢুকতে দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছিল। কিন্তু তাতে উত্তেজনা ক্রমশ বাড়তে থাকে। বিজেপি কর্মীদের প্রবল চাপে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। অবশেষে বিজেপি নেতাদের ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হয়।

ময়নাতদন্ত এবং অন্যান্য নথিপত্র সংক্রান্ত কাজ মেটার পরে সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ মণীশের দেহ তুলে দেওয়া হয়েছে তাঁর পরিজন ও বিজেপি নেতৃত্বের হাতে। শববাহী শকট নিয়ে প্রথমে রাজভবনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিজেপি নেতারা। রাজ্যপালের দরজায় গিয়ে সিবিআই তদন্তের দাবি জানানোর পরে মণীশের দেহ নিয়ে টিটাগড়ের দিকে ফেরা হবে— বিজেপির পরিকল্পনা তেমনই। কিন্তু মণীশের দেহ রাজভবনে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পুলিশ দেয়নি। পরে রফাসূত্র মেলে যে, বিজেপির চার জন প্রতিনিধি রাজভবনে গিয়ে রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করবেন। সেই অনুযায়ী নিহত মণীশ শুক্লর বাবা, অর্জুন সিংহ, লকেট চট্টোপাধ্যায় এবং কৈলাস বিজয়বর্গীয়— এই চার নেতা রাজভবনে গিয়ে রাজ্যপালের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁরা রাজভবনে পৌঁছনোর পরে মণীশ শুক্লর দেহ নিয়ে শববাহী গাড়িও রওনা দেয় টিটাগড়ের উদ্দেশে।

অন্য বিষয়গুলি:

Manish Shukla BJP Dilip Ghosh Arjun Singh Firhad Hakim
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy