প্রথমে বাংলাদেশ। মাঝে মুর্শিদাবাদ। তার পরে পহেলগাম। একের পর এক ঘটনায় হিন্দু ভাবাবেগে শাণ দিয়ে প্রভাব বাড়াতে সক্রিয় বিজেপি। আর তার উল্টো দিকে দলের কৌশল নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে সিপিএমের অন্দরে। তৈরি হয়েছে রাজ্যে অবশিষ্ট জমি হারিয়ে ফেলার উদ্বেগও।
এই চর্চায় সর্বশেষ সংযোজন মুর্শিদাবাদে গোলমালে নিহত সিপিএম সমর্থকের পরিবার ‘হাতছাড়া’ হওয়ার ঘটনা। জাফরাবাদে নিহত বাবা-ছেলের বাড়িতে অন্য রাজনৈতিক দলের আগেই পৌঁছেছিলেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম, যুব নেত্রী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়েরা। তাণ্ডব চলাকালীন পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে ওই পরিবার যে অভিযোগ করেছিল, তাকেই সামনে এনে গোটা ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছিলেন তাঁরা। পরিবারকে সাহায্যের জন্য অর্থ সংগ্রহও শুরু হয়েছিল। তার পরে ওই বাড়িতে গিয়ে বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার এনআইএ তদন্তের কথা বলেছিলেন। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী জাফরাবাদে গিয়ে সেই আশ্বাসই দিয়েছেন। রাজ্য সরকার-সহ কারও আর্থিক সহায়তা যে পরিবার নিতে চায়নি, তারাই শুভেন্দুর দেওয়া চেক গ্রহণ করেছে।
প্রশ্ন উঠছে, এমন গুরুতর ঘটনার পরে সমর্থক একটি পরিবারকে কি আগলাতে পারল না সিপিএম? অথচ এলাকার রাজনৈতিক ইতিহাস বলছে, গত পঞ্চায়েত ভোটেও সেখানে শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের পাশাপাশি বেশ কিছু আসন জিতেছিল কংগ্রেস ও বামেরা। গত বছরের লোকসভা ভোটেও শমসেরগঞ্জ বিধানসভা এলাকা থেকে ভাল ‘লিড’ পেয়েছিলেন বাম-সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী ইশা খান চৌধুরী। বিজেপির সেখানে বলার মতো কোনও জমিই নেই। কিন্তু ওয়াকফ-অশান্তির জেরে নিহত সিপিএম সমর্থক পরিবারকে ‘কাছে’ টেনে নিল বিজেপি! সিপিএমের মুর্শিদাবাদ জেলা সম্পাদক জামির মোল্লা অবশ্য বলছেন, ‘‘ঘটনার পর থেকে ওই পরিবারের সঙ্গে আমাদের দল যোগাযোগ রেখেছে। কোনও ভাবে হয়তো ওঁদের বিভ্রান্ত করা হয়েছে। আমরা খোঁজ নিচ্ছি।’’
সিপিএমেরই একাংশ অবশ্য মনে করছে, ‘বিভ্রান্তি’র সুযোগ এসে যাচ্ছে দলের ভূমিকা ও বক্তব্যেই। দলের রাজ্য কমিটির এক সদস্যের মতে, ‘‘বিজেপির মতো বিভাজনের রাজনীতি বা তৃণমূলের মতো প্রতিযোগিতায় নামা কোনওটাই আমাদের কাজ নয়। কিন্তু আক্রান্ত মানুষজন সব সময় ভারসাম্য মেপে কথা শোনার পরিস্থিতিতে থাকেন না। দু’পক্ষই আক্রান্ত, এই বক্তব্য ওই পরিবারের ভাল লাগেনি বলেই মনে হচ্ছে। পহেলগাম-কাণ্ডের পরেও ইসলামি মৌলবাদের নিন্দা আমাদের একটু স্পষ্ট ভাষায় করা উচিত ছিল। বাংলাদেশের ঘটনার পরেও একই প্রশ্ন উঠেছিল।’’
উদ্বাস্তুদের নিয়ে আন্দোলনে আবার গতি আনতে গত কিছু দিনে চার দফায় ২০টি জেলার নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেছেন সিপিএম নেতৃত্ব। সূত্রের খবর, সেই আলোচনাতেও দলের একাধিক প্রতিনিধি উল্লেখ করেছেন সাম্প্রতিক কালে চেনা মানুষের মনোভাবও তাঁদের ‘অচেনা’ ঠেকছে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের বক্তব্য, ‘‘এই ভাগাভাগির পরিস্থিতি থেকে বেরোতে গেলে বিকল্প ভাষ্য তৈরি করে আমাদের রাস্তায় নেমে যাওয়া উচিত। সেটাও তো হচ্ছে না!’’
এই পরিস্থিতির ফায়দা নিতেই এখন মরিয়া বিজেপি। পরিমাণে যতটুকুই হোক, বামেদের দখলে থাকা ‘হিন্দু ভোট-ব্যাঙ্ক’ নিজেদের দিকে টেনে আনার ঘোষিত লক্ষ্য নিয়ে তারা নেমেছে। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু বলছেন, ‘‘মুর্শিদাবাদের বাবা-ছেলে সিপিএম সমর্থক বলে নন, প্রাণ দিয়েছেন ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে। বাস্তব এটাই। দলের রাজ্য সম্পাদক ব্রিগেড সমাবেশ থেকে নিজেদের নিহত সমর্থকের নামও ভুল বলেছেন!’’ বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্তও সরাসরি পহেলগামের সঙ্গে মুর্শিদাবাদকে এক বন্ধনীতে বসিয়ে ‘হিন্দু বাঁচাও’ ডাক দিচ্ছেন।
আমন্ত্রণ রক্ষা করতে ভিয়েতনাম সফরে গিয়েছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সেলিম। তবে যাওয়ার আগে তিনি বলেছেন, ‘‘মুর্শিদাবাদের সঙ্গে পহেলগামের তুলনা পাকিস্তানকেই সাহায্য করছে। কাশ্মীরে নিরীহ পর্যটকদের মেরেছে সন্ত্রাসবাদীরা। আর মুর্শিদাবাদে তৃণমূল এবং বিজেপি ধর্মের নামে উস্কানি দিয়েছে।’’ তাঁর আবেদন, ‘‘সাম্রাজ্যবাদীদের পরিকল্পনা মতো ভারতকে ধর্মের নামে আফগানিস্তান বা বাংলাদেশ বানাতে দেবেন না।’’
তবে কথায় চিঁড়ে ভিড়ছে কি না, প্রশ্ন এখন বিস্তর!
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)