প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল আগেই। এ বার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের করা ‘মৃত্যুকুম্ভ’ মন্তব্য বিধানসভার কার্যবিবরণী থেকে বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়ে রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসের দ্বারস্থ হলেন বিজেপির বিধায়কেরা। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্বে বিধানসভা থেকে বৃহস্পতিবার মিছিল করে রাজভবনে গিয়ে ওই দাবি জানিয়ে এসেছেন তাঁরা। শুভেন্দুর দাবি, রাজ্যপাল মহাকুম্ভকে ‘মৃত্যুঞ্জয়’ বলেছেন। বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য বলেছেন, ‘‘বিধানসভা সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব স্পিকারের, রাজ্যপালের নয়। প্রয়োজন মতো তা ব্যাখ্যা-সহ জানিয়ে দেওয়া হবে।’’
বিধানসভায় মঙ্গলবার রাজ্যপালের ভাষণের উপরে জবাবি বক্তৃতায় বিজেপিকে আক্রমণ করতে গিয়ে মমতা বলেছিলেন, “কুম্ভমেলাকে সম্মান করি। কুম্ভের কথা না-ই বা বললাম। মহাকুম্ভ না মৃত্যুকুম্ভ? মৃত্যুকূপ হয়ে গিয়েছে!” তার পরেই প্রতিবাদে সরব হয়েছিলেন বিজেপির রাজ্য ও কেন্দ্রীয় নেতারা। সঙ্ঘের ছাত্র সংগঠন এবিভিপি বিধানসভার ফটকে বিক্ষোভ করেছিল। উত্তরপ্রদেশের বিধানসভায় দাঁড়িয়ে বুধবারই সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ সমাজবাদী পার্টি, তৃণমূল-সহ বিরোধীদের পাল্টা নিশানা করে কুম্ভে অব্যবস্থার অভিযোগ নস্যাৎ করেছিলেন। রাজ্যের বাজেট অধিবেশনের শেষ দিনে, বৃহস্পতিবার ‘মৃত্যুকুম্ভ’ মন্তব্য এবং বাংলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রতিবাদে বিধানসভা চত্বরে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন বিজেপি বিধায়কেরা। কলকাতা কেন ‘আতঙ্কনগরী’ হয়ে উঠছে, পুলিশমন্ত্রীর কাছে তার জবাবদিহি দাবি করে প্ল্যাকার্ড এনেছিলেন তাঁরা।
পরে রাজভবন থেকে বেরিয়ে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দুর দাবি, “একশো কোটি হিন্দুর আস্থায় আঘাত দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রীর তাপ-উত্তাপ, অনুশোচনা নেই! আমরা চাই না ‘মৃত্যুকুম্ভ’ শব্দটা নথিতে থাকুক। আমরা বলেছি, রাজ্যপাল পরিষ্কার করে বিধানসভার স্পিকারকে বলে দিন, এই শব্দ বিধানসভার নথি থেকে বাদ দিতে হবে।” রাজ্যপাল বোস সদ্যই কুম্ভে স্নান সেরে ফিরেছেন। বোস মহাকুম্ভকে ‘মৃত্যুঞ্জয়’ আখ্যা দিয়েছেন দাবি করে বিরোধী দলনেতা জানিয়েছেন, এই নিয়ে তাঁদের প্রতিবাদ চলবে।
বিধানসভায় নিলম্বিত (সাসপেন্ড) বিরোধী দলনেতাকে আক্রমণ করে হিন্দুত্ব নিয়ে নানা কথা বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তার প্রেক্ষিতে এ দিন বিরোধী দলনেতার পাল্টা বক্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, আমরা নতুন হিন্দু নেতা। আমরা হিন্দু নেতা হইনি। হিন্দু ধর্মের নেতা শঙ্করাচার্য। আমরা যে যা রাজনৈতিক দল অথবা পেশায় থাকি না কেন, আমরা আমাদের ধর্মের সঙ্গে তঞ্চকতা করিনি।’’ তাঁর আরও কটাক্ষ, “আপনি রেড রোডে চলে যান অন্য ধর্মের অনুষ্ঠানে। তাঁরা বিরক্ত হন। তবু আপনি যান আপনার ভোটের জন্য।”
তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ পাল্টা আঙুল তুলে বলেছেন, ‘‘কুম্ভে রাজ্যের মৃত এ রাজ্যের মানুষের দেহ উত্তরপ্রদেশ সরকার যখন শংসাপত্র ছাড়া পাঠিয়েছিল, তখন শুভেন্দু বা রাজ্যপাল কোথায় ছিলেন? সে ব্যবস্থা করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আসলে কুম্ভমেলার প্রশাসনিক গাফিলতি ও বিজেপি সরকারের রাজনৈতিক অপদার্থতা আড়াল করতে বিষয়টিকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।’’
ধর্মের জিগির তুলে শাসক ও প্রধান বিরোধী দলের তরজা নিয়ে সরব হয়েছে সিপিএম ও কংগ্রেস। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘মহাকুম্ভের নামে বিজেপি যেটা করছে, তাতে ব্যবসায়িক কাজ হচ্ছে। কুম্ভের নামে মানুষের আবেগকে ব্যবহার করছে বিজেপি। তৃণমূলও সেই ধর্মের তাস খেলছে। আসলে তো দরকার মানুষের জীবন-জীবিকার লড়াই।’’ প্রদেশ কংগ্রেসের বর্ষীয়ান নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্যের মতে, ‘‘মেরুকরণ করে কংগ্রেস ও বামকে কোণঠাসা করার জন্য বিজেপি এবং তৃণমূল এই কৌশল নিয়েছে। কিন্তু মানুষ এখন এই কৌশল বুঝতে পারছেন। এই ভাগাভাগি বাংলার সংস্কৃতি নয়। রবীন্দ্রনাথও সমাজজীবনে এমন ভাগাভাগিকে কখনও প্রশ্রয় দেননি।’’
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)