সংসারে ‘একলা’ সৌমিত্র এখন দলেও ‘মিত্রহীন’।
স্ত্রী সুজাতা মণ্ডল শুধু বিজেপি ছাড়েননি, বিজেপি-র সাংসদ স্বামী সৌমিত্র খাঁকেও ছেড়ে চলে গিয়েছেন। এর পরে কেঁদেকেটে সাংবাদিক বৈঠক করেছেন বিজেপি যুবমোর্চার রাজ্য সভাপতি তথা বিষ্ণুপুরের সাংসদ। কিন্তু সংসারে ‘একলা’ সৌমিত্র এখন দলেও ‘মিত্রহীন’। তাঁর পাশে নেই দলের নেতৃত্বও। একের পর এক ‘ভুল’ কাজের জন্য রাজ্য ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ধমকের পরেও তিনি যে শোধরাননি, তারা নজির সম্প্রতিও দেখা গিয়েছে। অভিনেত্রীদের ‘যৌনকর্মী’ আখ্যা দেওয়া বা ভোটে জিতলে পড়ুয়াদের স্কুটি বিলি করা হবে বলে তিনি যে মন্তব্য করেছেন তাতেও রুষ্ট দল। রাজ্য বিজেপি-র মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য স্পষ্ট ভাষাতেই জানিয়েছেন, ওই দু’টি বিষয়কেই সমর্থন করে না দল।
সৌমিত্র যে দলে ‘মিত্রহীন’, বিজেপি-র সাম্প্রতিক কর্মসূচিগুলিও তার ইঙ্গিত বহন করছে। বেশ কিছুদিন ধরে তিনি একাই সভা-সমাবেশ করছেন। অন্য কোনও রাজ্য নেতা যেমন তাঁর সঙ্গে থাকছেন না, তেমনই অন্য কারও সমাবেশেও তাঁকে রাখা হচ্ছে না। বিধানসভা নির্বাচনের জন্য বাকি শাখা সংগঠনের নেতাদের মূল সংগঠনের বিভিন্ন দায়িত্ব দেওয়া হলেও তাতে নেই সৌমিত্র। রাজ্যের যুবমোর্চার সহ-সভাপতি শঙ্কুদেব পণ্ডাকে কলকাতা জোনের কমিটিতে রাখা হলেও কোনও কমিটিতেই স্থান হয়নি বিষ্ণুপুরের সাংসদের। তিনি কি আপাতত দলে কোণঠাসা? সৌমিত্রর জবাব, ‘‘না-না! আমি একেবারেই তা মনে করি না। আমার উপর যুবমোর্চার বড় দায়িত্ব রয়েছে তো! প্রতিটি সাংগঠনিক জেলায় সভা করার লক্ষ্য নিয়েছি। সেই কাজেই আমাকে ছুটতে হচ্ছে।"
গত বুধবার পূর্ব বর্ধমানের খণ্ডঘোষের সভায় সৌমিত্র বলেছিলেন, ‘‘দক্ষিণ কলকাতায় কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী আছেন, যাঁরা শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে ২ লক্ষ টাকা করে বেতন পান, তাঁরা বলছেন, শিবমন্দিরে যে শিবলিঙ্গ থাকে, তাতে গর্ভনিরোধক পরিয়ে শিবপুজো করা হোক। দেবী সরস্বতীকে যৌনকর্মী বলেছেন সায়নী ঘোষ। যারা শিবলিঙ্গকে বা মা মনসাকে অপমান করে, তারাই আসলে যৌনকর্মী!’’ ওই মন্তব্যের পরে রীতিমতো পড়েছিল অস্বস্তিতে বিজেপি। বুধবারের সভায় সৌমিত্র এমনটাও বলেছিলেন যে, বাংলায় বিজেপি ক্ষমতায় এলে সাইকল নয়, স্কুটি উপহার দেওয়া হবে পড়ুয়াদের। যে প্রসঙ্গে শমীক আবার বলেছেন, “দলের এমন কোনও কর্মসূচির কথা আমার জানা নেই।” আর সৌমিত্র? তিনি বলছেন, "প্রথমটা আমার ব্যক্তিগত বক্তব্য। একজন শিবভক্ত হিসেবে কথাটা বলেছি। আর বিজেপি ক্ষমতায় এলে যুবমোর্চার পক্ষ থেকে পড়ুয়াদের স্কুটি দেওয়া হবে।’’ যদিও বিজেপি সূত্রে খবর, ইতিমধ্যেই নেতৃত্বের তরফে ‘সংযত’ হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সৌমিত্রকে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের যে সফর বাতিল হল, সেখানেও তাঁকে কোনও দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।
যেমন খুশি কথা বলার জন্য এই প্রথম নয়, আগেও একাধিক বার নেতাদের ধমক খেয়েছেন সৌমিত্র। কিছুদিন আগেই পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতনে তিনি বলেছিলেন, "শুভেন্দু’দার (শুভেন্দু অধিকারী) নেতৃত্বে তৃণমূল ভাঙবে। দিলীপ ঘোষ বিজেপি-র মুখ্যমন্ত্রী হবেন।" বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মুখ্যমন্ত্রীর মুখ নিয়ে প্রথম থেকেই নীরব থাকার নীতি নিয়েছেন। ‘বাংলার ভূমিপুত্র’-ই মুখ্যমন্ত্রী হবেন বলে রাজ্য সফরে এসে সরাসরি জবাব এড়িয়েছেন খোদ অমিত। প্রকাশ্যে দিলীপের নাম বলার জন্য গত ১৮ জানুয়ারি দলীয় বৈঠকে ভরা সভায় নাম না করে সৌমিত্রকে কড়া বার্তা দিয়েছিলেন বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতা শিব প্রকাশ। এর পর সৌমিত্র ঘনিষ্ঠ মহলে অনুযোগ করেছিলেন, তিনি ‘ছোট’। তাই তাঁকে ধমক দেওয়া হয়। কিন্তু ভুল ‘বড়’রাও অনেক করেন।
তবে বিজেপি রাজ্য নেতাদের বক্তব্য, সৌমিত্রর ভুলের শেষ পাওয়া যাচ্ছে না। দলে তাঁর উত্থান যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য। বিজেপি-তে যোগ দেওয়ার পরেই লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী করা হয়। সাংসদ সৌমিত্রকে যুবমোর্চার সভাপতি করা হয়। কিন্তু সেই পদের ‘মর্যাদা’ না দিয়ে তিনি একের পর এক এমন কাজ করেছেন, যাতে দলের মুখ পুড়েছে। যুবমোর্চার দায়িত্ব পাওয়ার পরে বিভিন্ন জেলা কমিটি গঠনের সময়েও তাঁর বিরুদ্ধে ‘স্বজনপোষণ’-এর অভিযোগ উঠেছিল। যা আটকাতে সব কমিটি ভেঙে দেন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। বিজেপি সূত্রের খবর, সৌমিত্র যুবমোর্চার সভাপতি হয়েছিলেন মূলত কৈলাস বিজয়বর্গীয় এবং মুকুল রায়ের ‘পছন্দ’ হিসাবে। কিন্তু তাঁদেরও বিভিন্ন সময়ে অস্বস্তিতে ফেলেছেন সৌমিত্র। গত ১৩ ডিসেম্বর সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে মুকুলকে পাশে নিয়ে ‘চাকরির প্রতিশ্রুতি কার্ড’ প্রকাশ করেছিলেন সৌমিত্র। জানিয়েছিলেন, ওই কার্ড নিয়ে ৭৫ লক্ষ যুবক-যুবতীর বাড়ি যাওয়ার কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। সেই কার্ড ‘বিক্রি’ হচ্ছে বলে অভিযোগ ওঠে। শেষ পর্যন্ত বেকারদের চাকরির ‘টোপ’ দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে বিজেপি। গোটা কর্মসূচিই বাতিল করা হয়। পরে সৌমিত্র বলেছিলেন, ‘‘ওটা ছাপার ভুল ছিল। চাকরি নয়, আমরা কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিতে চেয়েছিলাম।’’
এক রাজ্য নেতা ২০২০ সালের অগস্ট মাসের কথা টেনে এনে বলছিলেন, তখন বাংলা শ্রাবণ মাসের শেষ সোমবার মাথা মুণ্ডন করে বিষ্ণুপুরে ষাঁড়েশ্বর মহাদেবের পুজো ও যজ্ঞ করেছিলেন সৌমিত্র। যুবমোর্চার কর্মীদের হাতে হাতে ত্রিশূল তুলে দেওয়াও শুরু করেন। তিনি বলেছিলেন, ৯০ হাজার ত্রিশূল বিলি করবেন। এতেও দলের কোনও সমর্থন ছিল না। সেই কর্মসূচিও বাতিল হয়ে যায়। স্ত্রী সুজাতাকে বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী করা বা রাজ্য মহিলা মোর্চার সভানেত্রী করার জন্যও সৌমিত্র নেতৃত্বের কাছে অনেক বার তদ্বির করেছিলেন বলে অভিযোগ। তবে সে সব এখন অতীত। যদিও সাংসদ থাকা সত্বেও বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বাসনা নাকি এখনও রয়েছে সৌমিত্রর। লক্ষ্য, বিজেপি ক্ষমতায় এলে মন্ত্রী হওয়া। তাই কি? সৌমিত্রর জবাব, ‘‘দল কোথায় কাকে প্রার্থী করবে জানি না। আমায় করলে আমি লড়ব।’’
এত সব অভিযোগের মধ্যেই অভিনেত্রীদের ‘যৌনকর্মী’ বলা নিয়ে দলের ভিতরে-বাইরে চাপে সৌমিত্র। নেতাদের বকুনি আর ধমকও শুনতে হচ্ছে। সে কথা স্বীকারও করেছেন সৌমিত্র। আবার বলেছেন, ‘‘আমি ছোট। ছোটরা যেমন ভালবাসা পায়, তেমন কখনও কখনও বকুনিও খায়। তবে বুঝতে পারছি এ বার কথাবার্তায় একটু সংযত হতে হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy