স্বজনহারা: দুর্ঘটনায় মৃত সুবাস বর্মণের বাড়িতে শোকের ছায়া। কোচবিহার জেলার দেওয়ানবসে। ছবি: হিমাংশু রঞ্জন দেব
মা জিজ্ঞেস করছিলেন, ‘‘আর কতক্ষণ লাগবে? ভাত কি বসিয়ে দেব?’’ ট্রেন তখন ধরলা নদীর সেতু পার হয়েছে। চিরঞ্জিত জবাব দিয়েছিলেন, ‘‘চিন্তা কোরো না মা, পৌঁছে যাব।’’ এই কথার মাঝেই বিকট শব্দ ভেসে আসে মায়ের ফোনে। তার পর তিন বার ‘মা’ বলে চিরঞ্জিতের আর্তনাদ। এবং সব শেষ। শুক্রবার কোচবিহারের চান্দামারিতে বাড়িতে বসে কিছুতেই আগের বিকেলের কথাগুলো ভুলতে পারছিলেন না ফুলমতী বর্মণ। বারবার ডুকরে উঠছিলেন, ‘‘একুশ বছরের জোয়ান ছেলেটা এই ভাবে চলে গেল গো!’’
কোচবিহারেরই দেওয়ানবসের বাসিন্দা ৩৮ বছরের সুবাস বর্মণ। সাত মাস তিনি বাড়ির বাইরে। এর মধ্যে তাঁর এক ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে। তার নাম রেখেছেন সুপ্রিয়া। সেই কয়েক মাসের সুপ্রিয়াকে দেখতেই বাড়ি ফিরছিলেন সুবাস। ঘনঘন ফোন করে জানতে চাইছিলেন, ‘‘মেয়ে কী করছে?’’ সেই ফোনেই সুবাসের মৃত্যু সংবাদ পৌঁছয় বাড়িতে।
কোচবিহারেরই ফেশ্যাবাড়ির সম্রাট কার্জি (১৭) এবং ঘোকসাডাঙার রঞ্জিত বর্মণের (৪২) মৃত্যু হয় ট্রেন দুর্ঘটনায়। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, ওঁরা প্রত্যেকেই পরিযায়ী শ্রমিক। চিরঞ্জিতের গলব্লাডারে পাথর হয়েছিল। তাঁকে অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দেন চিকিৎসক। খুব গরিব পরিবারের ছেলে চিরঞ্জিত। বাবা নির্মল কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন। মা ফুলমতী বিড়ি বেঁধে সংসার চালাতেন। অস্ত্রোপচারের টাকা জোগাড় করতেই চিরঞ্জিত জয়পুরে কাজ নিয়ে গিয়েছিলেন। রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজে কিছু টাকাও রোজগার হয়েছিল। সেই টাকা নিয়েই বাড়ি ফিরছিল। শুক্রবার তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় কান্নায় ভেঙে পড়েছেন তাঁর আত্মীয় ও প্রতিবেশীরা। তাঁর মা ছেলের দেহ শনাক্ত করতে জলপাইগুড়ি গিয়েছেন। তাঁর পিসি শৈল বর্মণ বলেন,
“বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে চিরঞ্জিত। এখন কী করে ওই দু’জন বেঁচে থাকবে, জানি না।”
সুবাসের বাড়িতেও দূর থেকে ভেসে আসছিল কান্নার শব্দ। তাঁর বৃদ্ধ বাবা নির্মল ও মা রমণী বারে বারে জ্ঞান হারাচ্ছিলেন। তাঁর স্ত্রী টুম্পা, ছোট ছোট দুই ছেলে শুভ ও সুরজ এবং তিন মাসের শিশুকন্যাকে নিয়ে দেহ শনাক্ত করতে জলপাইগুড়ি নিয়ে গিয়েছেন রেল আধিকারিকরা। তাঁর পরিবারের সদস্যরা জানান, প্রায় ১৫ বছর ধরে রাজস্থানে একটি সংস্থায় কাজ করতেন সুবাস। বছরে এক-দু’বার বাড়ি ফিরতেন। সুবাসের বাবা বলেন, “দুর্ঘটনার এক ঘণ্টা আগেও ছেলে ফোন করেছিল। বাড়ি ফিরবে বলে তাঁর মনে অনেক আনন্দ ছিল। তা আর হল না।”
পশ্চিম বর্ধমানের রাধানগরের তালপোখোরিয়ার বাসিন্দা অজিত প্রসাদ (৩৪) ২০১৬-এ রেলের ট্র্যাক মেন্টেনারের পদে চাকরি পান। তাঁর কর্মস্থল ছিল উত্তর-পূর্ব রেলের রঙ্গিয়া ডিভিশনে। শুক্রবার অজিতের কাকা বাবন প্রসাদ জানান, বৃহস্পতিবার রাতেই অজিতের সহকর্মীরা ফোন করে দুর্ঘটনার খবর জানান। খবর পেয়েই অজিতের দাদা, ভারত-তিব্বত সীমান্ত পুলিশের জওয়ান সুজিত, ছোট ভাই অমরজিৎকে নিয়ে ময়নাগুড়ির দিকে রওনা দেন। বাবন বলেন, “এখনও সুজিতরা কোনও খবর দেয়নি। কী করে কী ঘটে গেল, কিছুই বুঝতে পারছি না।” অজিতের বাড়িতে রয়েছেন, বৃদ্ধ বাবা, দাদা, ভাই ও স্ত্রী খুশবু। অজিতের বাল্যবন্ধু শম্ভু প্রসাদ এ দিন বলেন, “প্রায়ই আমাদের সঙ্গে ওর কথা হত। হোলিতে আসবে বলেছিল। তার আগেই এমন ঘটনা ঘটবে, তা দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি।”
(সহ-প্রতিবেদন: তাপস পাল ও সুশান্ত বণিক)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy