গত ১৭ অগস্ট স্থানীয়দের হাতে বিশ্বভারতীতে ভাঙচুর। ফাইল চিত্র।
শান্তিনিকেতনকে যাঁরা বাইরে থেকে দেখেন, তাঁরা যে রূপটা দেখতে পান তার সঙ্গে অন্দরের শান্তিনিকেতন একেবারে আলাদা। এখানে রাবীন্দ্রিক কারণে সব কিছুই করা হয়। অন্যায় বা ন্যায্য কার্যাবলী, সবই গুরুদেবের নামে। যাঁরা বহিরাগত, অর্থাৎ বাইরে থেকে আসেন, তাঁরা কোনও ভাবেই রাবীন্দ্রিক হতে পারেন না।
বিশ্বভারতীতে চাকরির জন্য শ্রম না দিয়ে মাসিক বেতন পাওয়া যায় কারণ, হাঙ্গামার ভয়ে কর্তৃপক্ষ কিছু করার সাহস পান না। জিপিএফ-এ লক্ষাধিক টাকা প্রশাসন দিতে বাধ্য থাকেন। ওই একই জুজুর কারণে। যদি এর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার প্রচেষ্টা হয়, তবে যাঁরা কাগজ তৈরি করেন, তাঁদের ধমকি দেওয়া হয়। এগুলো এখানে পরম্পরা। মানতেই হবে। না মানলে উপাচার্যকে তালা বন্ধ করে রাখা হবে এবং মিথ্যা এফআইআর করা হবে। যাঁরা সমকালীন বিশ্বভারতীর ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, তাঁদের কাছে কোনও প্রমাণের প্রয়োজন নেই।
দুটো প্রশ্ন আমাদের সবাইকে বিব্রত করছে। উপাচার্য হওয়ার সুবাদে এর উত্তর দেওয়া আমার দায়িত্ব। প্রথমত, কারা রাবীন্দ্রিক? অর্থাৎ রাবীন্দ্রিক এমন একটা তকমা যার কিছু বৈশিষ্ট আছে, যা কিনা বাইরে থেকে যাঁরা বিশ্বভারতীতে পড়তে বা চাকরি করতে আসেন তাঁরা বোঝেন না। তার ব্যতিক্রম নই আমিও, যদিও আমি বীরভূমের ভূমিপুত্র। আমার এবং আমার পরিবারের সঙ্গে বিশ্বভারতীর যোগাযোগ শতাধিক বছরের উপর। তবে আমি খুশি, যে অর্থে ‘রাবীন্দ্রিক’ শব্দের অবমাননা করা হয়, এই বিশ্বভারতীতে সে অর্থে আমি রাবীন্দ্রিক নই।
এইখানেই হওয়ার কথা পাঁচিল। ফাইল চিত্র।
দ্বিতীয় প্রশ্ন যা কিনা বাঙালির আবেগকে পীড়িত করেছে, সেটারও আলোচনা দরকার। আমি আমার একটা অর্থ থেকে লিখেছি যে, রবীন্দ্রনাথ বহিরাগত ছিলেন। আজকে মহামান্য জিকে গোখলে বেঁচে থাকলে খুব দুঃখ পেতেন। কারণ তিনি মনে করতেন, ‘বাংলা আজ যা ভাবে, দেশ তা কাল ভাবে’। একটা সামান্য ভাবনা যে ভাবে বিকৃত করে অনেক বঙ্গপুঙ্গব তাদের দুঃখের ঝুড়ি ভরালেন, তা ভেবে নিজেকে বাঙালি হিসাবে পরিচয় দিতে লজ্জা হয়। যখন বলেছি যে গুরুদেব এবং তাঁর বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বহিরাগত ছিলেন, তখন আমি একটা ভাবনা প্রকাশ করতে চেয়েছিলাম। কবিগুরু এবং তাঁর বাবা বোলপুর বা বীরভূম নিবাসী ছিলেন না। তাঁরা এসেছিলেন কলকাতা থেকে। এটা এমন একটা ঘটনা যা নাও ঘটতে পারত (It is just an accident of history)। তর্কের খাতিরে ভাবুন যদি মহর্ষি বর্ধমান, বাঁকুড়া, হুগলি বা পশ্চিমবঙ্গের বা ভারতের অন্য স্থানে বিশ্বভারতী করার কথা ভাবতেন, তা হলে বিশ্ববিদ্যালয় সেখানেই হত। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে, গুরুদেব রামগড়ে (যা কিনা উত্তরাখণ্ডে অবস্থিত) ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয় খুলতে চেয়েছিলেন। যে কোনও কারণে যা হয়ে ওঠেনি। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের সহায়তায় আমরা বিশ্বভারতীর দ্বিতীয় পরিসর রামগড়ে খোলার চেষ্টা করছি।
আরও পড়ুন: জমি রক্ষায় পাঁচিল চাই, সওয়াল দিলীপের
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যে, এই অশান্তির পরিবেশে আমি এই উল্লেখ করলাম কেন। যাঁরা বিশ্বভারতীকে জানেন, তাঁরা নিশ্চয় আমার সঙ্গে একমত হবেন যে, যাঁরা বোলপুর, বীরভূম বা পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থেকে এখানে চাকরি করতে আসেন তাঁদের কী ভাবে অবজ্ঞা করেন বিশ্বভারতীতে কাজ করা স্থানীয়রা। বলা হয় যে, বহিরাগতরা রাবীন্দ্রিক হতে পারেন না। যাঁরা স্থানীয় বা এখানে জন্মেছেন এবং লালিত-পালিত হয়েছেন এবং বিশ্বভারতীর ছাত্র-ছাত্রী, তাঁদেরই রাবীন্দ্রিক হওয়ার জন্মগত অধিকার। আমি জানি না, কোনও শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ এই ধরনের ব্যাখ্যায় সায় দেবেন কি না। এই বিস্তারিত আলোচনার পর রবীন্দ্রনাথ বহিরাগত কি না সেটা বোধহয় যে সমস্ত বাঙালী কেঁদে আকুল হচ্ছেন তাঁদের বোধগম্য হবে। যদি না হন, তবে এর পিছনে অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে সেটা বোধ হয় পরিষ্কার। আমি আবার বলতে চাই যে, কবিগুরু ও তাঁর পিতৃদেব ভৌগলিক অর্থে বোলপুর এবং বীরভূমের বাসিন্দা ছিলেন না।
গোলমালের আতঙ্কে হস্টেল ছাড়েন অনেকে। ফাইল চিত্র।
এ বারে দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করব। রাবীন্দ্রিক অনেক ক্ষেত্রেই একটা উপযুক্ত তকমা যা অনেক অনিয়মকে ঢাকা দেওয়ার এক চেষ্টা মাত্র। আমি এই মুহূর্তে সেই কঙ্কালটা জনসমক্ষে আনতে চাইছি না। তবে প্রয়োজন হলে আনব। বিশ্বভারতীর জমি প্রায়শই কব্জা হচ্ছে। রামকিঙ্কর বেইজের স্মৃতি-জড়িত বিখ্যাত কালোবাড়িতে যে অসামাজিক কাজকর্ম হতো, তা কি বিশ্বভারতীর রাবীন্দ্রিক ঐতিহ্যের অনুকূল? প্রশাসন অবশ্য সে সবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। প্রশাসন সেই সমস্ত দুর্গন্ধ দূর করেছে যার পিছনে অনেকের সমর্থন আছে। আবার অনেকেই বলেছেন যে, ও সব কিছু নয়। যাঁরা কলাকুশলী-শিল্পী তাঁরা নাকি এ সব করেই থাকেন। আমার প্রশ্ন, যদি আপনাদের পরিবারের মেয়েদের এর ফলে অসুবিধা হয়, তবে কি আপনারা এর সমর্থন করবেন? ক্যাম্পাসের মধ্যে দুটো রেস্তোরাঁ চলেছে। একটা চলছে বিখ্যাত শিল্পী সুরেন কর মহাশয়ের বাড়িতে। এটা রাবীন্দ্রিক ঐতিহ্যের সহায়ক বলা যেতে পারে। সঙ্গীত ভবন বা প্রতিমা হোস্টেলের মহিলা আবাসিকরা যখন প্রতিনিয়তই কটূক্তি বা অবমাননার সম্মুখীন হন, তখন ওই চত্বরে থাকা ক’জন রাবীন্দ্রিক প্রতিবাদ করেন? লিখিত অভিযোগের পরে প্রশাসনের চুপ থাকা উচিত— এটা কি রাবীন্দ্রিক?
আরও পড়ুন: মাঠের পাঁচিলের চেয়ে অনেক বড় সমস্যা মনের পাঁচিল
রবীন্দ্রনাথ সবার। এটা মানতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তবে এর মানে যদি এই হয় যে, কয়েক জনের জন্য রাবীন্দ্রিক মানে দায়িত্ব পালন না করে অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা, তা হলে সেটা হবে স্বার্থরক্ষার একটা উপায় মাত্র। অতএব জমি-হাঙরদের দৌরাত্ম মানতে হবে। অফিসে না গিয়ে বেতন নেওয়া মানতে হবে। ক্লাস না নেওয়া মানতে হবে। এক দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে মাসের বেতন নেওয়াকে নিয়ম বলে মানতে হবে। অফিসে সমায়ানুবর্তিতা চালু করা চলবে না। এগুলো যদি সমর্থন করা যায়, তবে আপনার চেয়ে সবচেয়ে বড় রাবীন্দ্রিক কেউ নেই।
১৭ অগস্ট, তালা ভাঙা হচ্ছে শান্তিনিকেতনে। ফাইল চিত্র।
জমি-হাঙরদের অত্যাচার নতুন নয়। ১৯৪৫ সালে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ও এর সম্মুখীন হয়েছিলেন। এক বিখ্যাত ‘রাবীন্দ্রিক’ একটা একেবারেই অব্যবহারযোগ্য জায়গার বিনিময়ে আশ্রমের মধ্যে জায়গা চেয়েছিলেন। সেটা সে সময় করা যায়নি। যদিও পরবর্তীকালে তাতে সাফল্য পেয়েছিলেন। বিশ্বভারতীর ৭০ একর জমি কব্জা হয়ে গিয়েছে। খুব সম্প্রতি তান হোস্টেলের সামনের জায়গা কব্জা করার জন্য স্থানীয় কেউ একটা শিবলিঙ্গের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আমরা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান সূত্র খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম। কই তখন তো স্থানীয় রাবীন্দ্রিকরা প্রশাসনকে সাহায্য করেননি। এখন গুরুদেবের আবক্ষ মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে জায়গা হাতানোর আরেকটা প্রচেষ্টা হচ্ছে। সেই জন্য রাবীন্দ্রিকদের মন কাঁদে না। তার কারণ, তাঁরা অধিকার বোঝেন, যার এক কণাও ছাড়বেন না। কিন্তু দায়িত্ব? তা অন্যের। স্বার্থে আঘাত লাগলে যে কোনও ভাবে বিশ্বভারতীকে অবমাননা করতে তাঁরা পিছপা হবেন না। কারণ তাঁরা অধিকার বোঝেন।
আজকে বিশ্বভারতীর অবস্থা শোচনীয়। মেকি রাবীন্দ্রিকদের ছয়লাপ। তার প্রত্যক্ষ ফল ১৭ অগস্টের ধুন্ধুমার কাণ্ড। বিশ্বভারতীর পৌষমেলা মাঠে যে পাঁচিল দেওয়া নিয়ে ক্ষোভ, তা কতটা যৌক্তিক তা ইতিহাস বিচার করবে। তবে, একটা প্রশ্ন রাখতে চাই এখানে। যে সমস্ত রাবীন্দ্রিক এখানে বাসস্থান করেছেন, সেখানে কি দেওয়াল নেই? গুরুদেবের ‘খোলামাঠের খেলার’ ব্যবস্থা করার দায়িত্ব কি শুধু বিশ্বভারতীর, যা কিনা চলে কেন্দ্রীয় সহায়তায়? এখানে এমন কোনও বাড়ি আছে যেখানে সীমানা রক্ষার পাঁচিল নেই? আসুন না, সব পাঁচিল ভেঙে আমরা রাবীন্দ্রিক ভাবনাচিন্তা বাস্তবায়িত করি। যে রেস্তোরাঁগুলো ক্যাম্পাসে চলে, আসুন না আমরা সেগুলো বন্ধ করি। কারণ আর যাই হোক, রেস্তোরাঁগুলো আমাদের ছাত্রছাত্রীদের অসুবিধার সৃষ্টি করে এবং ওই জায়গায় বসবাসকারী রাবীন্দ্রিকদের কোনও ভাবেই সমর্থন করা যেতে পারে না। জানি না, কত জন এতে সাড়া দেবেন। হয়ত এই লেখার জন্য, প্রশাসনকে সাহায্য করার জন্য বিশ্বভারতীর হিতাকাঙ্খীদের আরও অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে।
পরিশেষে গুরুদেবের ভাবনা ধার করে রাবীন্দ্রিক শব্দের সঠিক অর্থ কী, তা অনুধাবন করার চেষ্টা করব। গুরুদেব বলেছেন, “আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে।” এখানে রাজা কিন্তু ‘রক্তকরবী’র রাজা নয়, এখানে রাজা ‘রাজর্ষি’ বা ‘বিসর্জন’-এর রাজা, যিনি প্রজা কল্যাণকারী এবং যিনি পশুবলি বন্ধ করার প্রাণের ঝুঁকি নিতে পিছপা হননি। এখানে পশুবলি একটা রূপক মাত্র। আসলে মানুষের হৃদয়ে যে পশুশক্তির দাপট, তা সমূলে উৎপাটনের একটা দৃঢ় প্রচেষ্টা।
আরও পড়ুন: রবীন্দ্রনাথের উপরই দখলদারি!
সঠিক অর্থে রাবীন্দ্রিক হওয়ার উপায় কবিগুরু নিজেই বলে গিয়েছেন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে। ১৯০৪ সালে লেখা ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে (যা পরে বই আকারে প্রকাশিত হয়) তিনি বলেন, “দেশকে জয় করে নিতে হবে পরের হাত থেকে নয়– নিজের নৈস্কর্ম থেকে ঔদাসীন্য থেকে... কারণ দেশ আমার আত্মা, এই জন্য দেশ আমার প্রিয়– একথা যখন জানি, তখন দেশের সৃষ্টিকার্যে পরের মুখাপেক্ষা করা সহ্যই হয় না।” তিনি আরও বিস্তারিত ভাবে তাঁর যুক্তিকে সমর্থন করে বলেন যে, “দেশের সমস্ত সামর্থ্যকে একত্রে টানিয়া যদি তাহাকে একটা কলেবর দান করিতে না পারি, যদি সেইখান হইতে স্বচেষ্টায় দেশের অন্নবস্ত্র, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার একটা সুবিহিত ব্যবস্থা করিয়া তোলা আমাদের সকলের পক্ষেই অসম্ভব হয়, যদি আমাদের কোন প্রকার কর্মনীতি ও কর্মসংকল্প না থাকে, তবে আজিকার এই আস্ফালন কাল আমাদিগকে নিস্ফল অবসাদের মধ্যে ধাক্কা দিয়া ফেলিয়া দেবে।” তাই অনুরোধ রাবীন্দ্রিক তকমা লাগিয়ে যাঁরা গুরুদেবের ভাবনাচিন্তার বিকৃত করার বিধ্বংসী কর্মে লিপ্ত হয়েছেন, তাঁরা বিরত থাকুন বা রাবীন্দ্রিক আদর্শের আসল অর্থ অনুধাবন করে আসুন আমরা সবাই বিশ্বভারতীর পুরনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার মহাযজ্ঞে অংশগ্রহণ করি। আসুন আমাদের সবার আহ্বানবাণী ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপর নাই’– মাথায় রেখে গুরুদেব যে ভাবে বিশ্বভারতীকে গড়তে চেয়েছিলেন, সেই কাজে আমরা সবাই হাত লাগাই এই গান গেয়ে—
“আয় তবে সহচরী হাতে হাতে ধরি ধরি
নাচিবি ঘিরি ঘিরি গাহিবি গান...”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy