গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
চুলের মুঠি ধরে শনিবার আরামবাগে মারা হয়েছিল প্রাক্তন বিধায়কের স্ত্রী তথা এ বারের পঞ্চায়েত নির্বাচনের মহিলা প্রার্থীকে। রবিবার মনোনয়ন পর্বে ছিল বিরতি। সোমবার ফের মনোনয়ন জমা শুরু হতেই একই ছবির পুনরাবৃত্তি। বিজেপি প্রার্থীর মেয়েকে রাস্তায় ফেলে চলল বেধড়ক মার। ঘটনা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বারুইপুরের।
শুধু বারুইপুরের কথা বললে কিছুই বলা হয় না। রামপুরহাট, সিউড়ি, বোলপুর, বহরমপুর, লালবাগ, ডোমকল, জঙ্গিপুর, রঘুনাথগঞ্জ, তমলুক— তীব্র সন্ত্রাসের খবর এল রাজ্যের প্রায় সব প্রান্ত থেকে। একের পর এক বিডিও এবং এসডিও অফিস শাসক দলের ক্যাডারদের নিশ্ছিদ্র ঘেরাটোপে রইল দিনভর। লাঠিসোটা, বাঁশ, বোমা, পিস্তল নিয়ে পাহারা দিল দুষ্কৃতী বাহিনী।
নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারি ভাবে যাঁদের উপর, সেই পুলিশ অধিকাংশ এলাকাতেই ছুটির মেজাজে বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে পুলিশ যে কয়েকটি এলাকায় সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করেছে, সেখানেই আক্রান্ত হয়েছে। মগরাহাটে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন এক পুলিশকর্মী। বারুইপুরে তৃণমূলের তাণ্ডব রোখার চেষ্টা করতেই হামলা হয়েছে এক পুলিশকর্তার উপরে।
আরও পড়ুন: ফার্স্ট বয় কেষ্ট! মনোনয়ন শেষের আগেই জেলা পরিষদ তৃণমূলের
আরও পড়ুন: ফোনে হুমকি পেলাম, খবর করতে এলে ঠ্যাং ভেঙে দেব
মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ দিনে কোন জেলার ছবি কেমন? দেখে নিন এক ঝলকে:
বীরভূম: গত এক সপ্তাহ ধরে যে ধরনের হিংসা দেখা গিয়েছে সিউড়ি, বোলপুর, রামপুরহাট, হাঁসন, মহম্মদবাজারে সোমবারও তার ব্যতিক্রম দেখা গেল না। এ দিন বরং আরও কোমর বেঁধে নেমেছিল শাসক দল। প্রত্যেকটি ব্লক ও এসডিও অফিসের সামনে সশস্ত্র জমায়েত ছিল এবং বিরোধীদের ধারেকাছে ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ।
অনুব্রত মণ্ডলের জেলার প্রায় সব প্রান্তে গত এক সপ্তাহ ধরে দেখা গিয়েছে এই ছবি। —নিজস্ব চিত্র।
জেলা পরিষদ কার্যত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তৃণমূলের দখলে চলে গিয়েছে। অধিকাংশ পঞ্চায়েত সমিতির বোর্ডও তৃণমূলের হাতে যাওয়া নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে।
মুর্শিদাবাদ: গোটা জেলা হিংসার কবলে। জঙ্গিপুর, রঘুনাথগঞ্জ, লালবাগ, বহরমপুর, ডোমকলে প্রবল রক্তচক্ষুর সামনে একটিও মনোনয়ন দাখিল করতে পারলেন না বিরোধীরা।
লালবাগে প্রশাসনিক ভবন এবং তার সামনের রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে রইল গুন্ডা বাহিনী। আর পুলিশ ভিতরে খোশগল্পে মশগুল রইল। ছবিতে অন্তত তেমনই ধরা পড়েছে। বিরোধীদের অভিযোগও তেমনই।
বিরোধীদের মনোনয়ন জমা আটকাতে মুর্শিদাবাদের রাস্তায় পিস্তল হাতে দুষ্কৃতী। —নিজস্ব চিত্র।
ডোমকলে হেলমেট মাথায় দিয়ে ডান্ডা হাতে প্রশাসনিক ভবন পাহারা দেওয়া হচ্ছিল। কোনও বিরোধী প্রার্থীকে মনোনয়ন জমা দিতে দেওয়া হচ্ছিল না বলে অভিযোগ ওঠে। কিন্তু ডোমকল পুরসভার চেয়ারম্যান তথা তৃণমূল যুব কংগ্রেসের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক সৌমিক হোসেন আনন্দবাজারকে বললেন, ‘‘কে কে মনোনয়ন জমা দিতে পারছেন না, আমাকে বলুন। আমি জমা করিয়ে দিচ্ছি।’’ সৌমিক আরও বললেন, ‘‘বাম আমলে তো ডোমকলের জন্য সরকার কিছুই করেনি। কিন্তু গত সাত মাসে আমরা যে পরিমাণ কাজ ডোমকলে করেছি, সেই কাজই আমাদের হয়ে কথা বলছে। আমরা কাউকে বাধা দিচ্ছি না। সাধারণ মানুষই বিরোধীদের বাধা দিচ্ছেন।’’
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা: জেলার নানা অংশে বাধা দেওয়া হয় বিরোধী প্রার্থীদের। বীরভূম, মুর্শিদাবাদের মতো দক্ষিণ চব্বিশ পরগনাতেও বিডিও এবং এসডিও অফিসগুলি ঘিরে রেখেছিল শাসক দল।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অশান্তি বাড়তে থাকে গোটা জেলায়। মগরাহাটে মনোনয়ন জমা দিতে গেলে বিজেপি বাধা পায়। সেখানে জমায়েত হওয়া তৃণমূল কর্মীদের সঙ্গে বিজেপির হাতাহাতি শুরু হয়ে যায়। পুলিশ বাধা দিতে গেলে সেই জমায়েত থেকে গুলি চলে। তাতে গুলিবিদ্ধ হন রফিক জামাল নামে এক সাব-ইনস্পেক্টর। তাঁকে চিকিৎসার জন্য ডায়মন্ড হারবারে নিয়ে যাওয়া হয়।
হিংসার ছবি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা থেকেও। —নিজস্ব চিত্র।
বারুইপুরে মহকুমা শাসকের দফতরে মনোনয়ন জমা দিতে যান এক বিজেপি প্রার্থী। সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী ও মেয়ে। অভিযোগ, তৃণমূলের কর্মীরা বিজেপি প্রার্থীকে মনোনয়ন জমা দিতে শুধু বাধা দিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি, তাঁর মেয়েকে রাস্তায় ফেলে বেধড়ক মারধর করা হয়। পুলিশ থামাতে গেলে তাঁদেরও মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। পাল্টা লাঠিচার্জ করে পুলিশ।
পূর্ব মেদিনীপুর: সকাল থেকে তমলুকে জেলা প্রশাসনিক ভবনের সামনে ক্যাম্প করে তল্লাশি অভিযান শুরু করে তৃণমূল। পথচলতি গাড়ি থামিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে থাকা মালপত্র পরীক্ষা করা হয় বলে অভিযোগ। কারও কাছে মনোনয়নের কাগজপত্র দেখলেই কেড়ে নেওয়া হয়েছে, গাড়ি থেকে নামিয়ে শাসানি দিয়ে ফেরত পাটানো হয়েছে বলে অভিযোগ।
সঙ্গে মনোনয়ন পত্র নেই তো? তমলুকে পথচারীদের ব্যাগে তল্লাশি। —নিজস্ব চিত্র।
প্রশাসনিক ভবনে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি মনোনয়ন জমা দিতে আসা বাম-বিজেপি প্রার্থীদের। সংবাদ মাধ্যমের লোক দেখলেই লাঠি হাতে তাড়া করেছে দুষ্কৃতীরা। সুপ্রিম কোর্টের রায় জানার পর শাসক দলের মারমুখী কর্মীরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন বলে খবর।
সব মিলিয়ে, মনোনয়ন জমা পর্ব শেষ হওয়ার পরে দেখা যাচ্ছে, ভোটের আগেই গোটা রাজ্যের ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের সিংহভাগ নিজেদের দখলে নেওয়া নিশ্চিত করে ফেলেছে শাসক দল।
বিরোধীরা এ দিনও দফায় দফায় কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছে। কমিশনের দফতরে গিয়ে এ দিন তৃণমূলের তরফে নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে দেখা করেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। বৈঠক সেরে বেরিয়ে তিনি বলেন, ‘‘জনগণের উপরে আমাদের আস্থা রয়েছে। নির্বাচন যাতে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হয়, সেই দাবিই জানালাম।’’
বিজেপির শমীক ভট্টাচার্য কমিশন থেকে বেরিয়ে বলেন, ‘‘গণতন্ত্রকে নির্লজ্জ ভাবে হত্যা করা হচ্ছে। গোটা রাজ্যে বিরোধীরা আক্রান্ত। মনোনয়নই জমা দিতে দেওয়া হল না। এটা নির্বাচন হচ্ছে না। কমিশনকে বলেছি, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচন কমিশনার জানিয়েছেন, তিনি উপযুক্ত পদক্ষেপই করবেন। আমরা পদক্ষেপের অপেক্ষায় থাকছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy