এসএসকেএমে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।—ছবি পিটিআই
ছোট্ট ফুসকুড়ি খামোকা চুলকে দিলে অনেকসময় তা থেকে গ্যাংগ্রিন হয়ে যায়। কখনও হাত-পা কেটে বাদ পর্যন্ত দিতে হয়।
কেন এমন হয়, সে সব ব্যাখ্যা চিকিৎসকেরা জানেন। আমরা সাধারণ মানুষ অতশত বুঝি না। তবে এটুকু খেয়াল রাখার চেষ্টা করি, ফুসকুড়ি যাতে অঙ্কুরেই নাশ হয়। জীবন আমাদের বারবার শিখিয়েছে, ‘চুলকাইয়া ঘা করিবেন না!’
রাজ্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা আজ ভেঙে পড়ার মুখে। শত শত সরকারি চিকিৎসক গণ-ইস্তফা দিচ্ছেন। চিকিৎসা-প্রার্থী হাজার হাজার আবালবৃদ্ধবনিতার আর্ত হাহাকারে বাতাস ভারী। সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় তিন দিনের শিশুর নিথর দেহ কোলে তার বাবার ছবি আমাদের বিবেকের কাছে বিচার চাইছে। সে চিকিৎসা পায়নি। আন্দোলনের এ কী নির্মম চেহারা!
কিন্তু এ তো মুদ্রার একটি দিক। অবস্থা এমন নিদারুণ আকার নিল কেন, সেটাও অবশ্যই ভাবতে হয়। আর তখনই মনে পড়ে যায়, ‘চুলকাইয়া’ ঘা না-করার সেই হিতোপদেশ! চলতি অচলাবস্থা এই ভাবে বেড়ে ওঠার পিছনে সেই ‘হিতোপদেশ’ অগ্রাহ্য করার লক্ষণ স্পষ্ট। কিন্তু কান, মন সব রুদ্ধ রেখে শুধু শাসকের তর্জনী তুলে কি ‘সুশাসন’ সম্ভব? কোথাও একটু ‘মমতা’ থাকবে না? এই প্রশ্নটা সবাইকে ভাবাচ্ছে।
মানতেই হবে, পাঁচ দিন ধরে এই অভূতপূর্ব অবস্থা চলার পিছনে রয়েছে এক ধরনের জেদ। আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারেরা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথা বলতে চাননি। অন্য দিকে সেটা ‘অপমান’ বলে কঠোর অবস্থান নিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাতেই আন্দোলন বেড়ে সর্বত্র ছড়াল। জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক উদ্বেগের জায়গায় যাওয়ার পথ প্রশস্ত হল। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি, বিশেষ করে বিজেপি, পরিস্থিতির সুযোগ নিল। ফলে মমতা আরও শক্ত হলেন। জটিলতাও বাড়তেই থাকল। অথচ তিনি সামান্য নরম হলে বহু আগেই হয়তো সমাধানের পথ বেরোত।
এখন মরিয়া হয়ে পথ খোঁজার উদ্যোগ চলছে। মীমাংসা অবশ্যই কাম্য। তবে এই উদ্যোগে এখন কোনও প্রশাসনিক দক্ষতার ছাপ আছে, বলা যাবে না। এটা, এক অর্থে, বিলম্বে বোধোদয়। গুরুত্ব বিচার করে কখনও এক পা পিছিয়েও যে দু’পা এগোনো যায়, সেটা বুঝতে বুঝতেই বিষয়টি অহেতুক ঘোঁট পাকিয়ে গেল।
হাসপাতালে ডাক্তার-পেটানো এই প্রথম, তা নয়। এটা যেন একপ্রকার ‘গণতান্ত্রিক অধিকার’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোগীর মৃত্যু নিয়ে অভিযোগ তৈরি হলেই হাসপাতালে আকছার তাণ্ডব চালানো হয়। সেই তাণ্ডব যারা চালায়, তাদের মধ্যে রোগীর পরিজন যত না থাকেন, তার থেকে বেশি জুটে যায় আশপাশের এক শ্রেণির হামলা-প্রিয় মানুষ। এলাকা নির্বিশেষে এটাই এই ধরনের ঘটনার চরিত্র। পরে সাময়িক আলোড়ন, প্রশাসনের নড়েচড়ে বসার তৎপরতা চোখে পড়ে। কিছু দিন কাটলে আবার যথাপূর্বম্। আরও একটি ঘটনার জন্য অপেক্ষা।
এ কথা ঠিক, চিকিৎসকেরাও সবাই সর্বদা তাঁদের কর্তব্যে অবিচল এবং নিষ্ঠাবান থাকেন না। থাকলে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসায় অবহেলার গুচ্ছ গুচ্ছ অভিযোগ জমত না। বস্তুত হাসপাতালে এমন অনেক মৃত্যু ঘটে যার দায় সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকেরা এড়াতে পারেন না। তাঁদের একাংশের দায়িত্বজ্ঞানহীনতাই অনেক সময় রোগীর মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠে। সব চিকিৎসকের ব্যবহারও আন্তরিক হয় না। এগুলি বেদনাদায়ক।
কিন্তু এনআরএসে জুনিয়র ডাক্তার পরিবহ মুখোপাধ্যায়ের মার খেয়ে লুটিয়ে পড়ার যে দৃশ্য সামনে এসেছে, তার পরে বিষয়টি আর শুধু পারস্পরিক চাপান-উতোরের জায়গায় থাকে না। যে বৃদ্ধ মারা গিয়েছেন, তাঁর পরিবারের ক্ষোভ যদি সঙ্গতও হয়, তবু তার জন্য দু’টি লরি বোঝাই ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী এসে অবাধে মারদাঙ্গা করবে, তরুণ চিকিৎসককে বাঁশ পেটা করে মাটিতে ফেলে তাঁর রক্তাক্ত মুখে জুতো পরা পায়ে লাথি মারতে মারতে অশ্রাব্য হুমকি দিতে থাকবে এবং পুলিশ-প্রশাসনকে দূরবীন দিয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে না— এটা কোনও সভ্য, গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা হতে পারে না। তার কঠোর নিন্দা করতেই হবে। আর সেই দায়ও নিতে হবে তাঁদের, যাঁরা বসে আছেন শাসনক্ষমতার উপরতলায়।
দুর্ভাগ্য, বিষয়টিতে গোড়া থেকেই রাজনীতি খোঁজার চেষ্টা হল। নন্দীগ্রামে সিপিএমের ‘সূর্যোদয়ের’ বিরুদ্ধে সচেতন জনমত যে দিন রাস্তায় নেমেছিল, তৎকালীন রাজ্য-শাসক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তার মধ্যে ‘আমরা-ওরা’ দেখতে পেয়েছিলেন। শাসকের পতাকার রং বদলালেও সেই ট্যাডিশন সমানে চলেছে।
যদিও আজকের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মানবিক মুখ বিভিন্ন সময়, নানা ঘটনায় উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে রয়েছে। মমতার স্পর্শ দিতে তিনি কার্পণ্য করেন না, এটাই সবাই দেখতে অভ্যস্ত। তাই পরিবহের সতীর্থ এবং মার খাওয়া জুনিয়র চিকিৎসকেরা হয়তো তাঁদের অভিভাবক হিসেবে মুখ্যমন্ত্রীকে একবার পাশে দেখতে চেয়েছিলেন। তিনি কেন গেলেন না, তা অবশ্যই তাঁর বিবেচনা। সব মিলিয়ে বড় দেরি হয়ে গেল। জরুরি পরিষেবায় এমন অস্থিরতা ঠিক নয়।
আন্দোলনকারী চিকিৎসদের দু’টি দাবি। নিজেদের নিরাপত্তা এবং ‘প্রকৃত দোষী’দের গ্রেফতার। দু’লরি ঠ্যাঙাড়ের মধ্যে এখন পর্যন্ত গ্রেফতার মাত্র পাঁচ। সেটা যে যথেষ্ট নয়, বলাবাহুল্য। বাকিদের ধরতে বিলম্ব কেন?
চিকিৎসকদের নিরাপত্তার যে দাবি উঠেছে, সে সম্পর্কে বৃহস্পতিবার এবিপি-আনন্দের সাক্ষাৎকারে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, হাসপাতালগুলিতে পুলিশি বন্দোবস্ত তুলে দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের বসানো কলকাতার পুলিশ কমিশনার। বলেছেন, ‘‘এটা আমার জানা ছিল না।’’
আমরা জানি, ডাক্তারদের উপর এর আগে হামলার পরিপ্রেক্ষিতেই সব হাসপাতালে এই পিকেটের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। অর্থাৎ, এটি সরকারের স্থায়ী নির্দেশ। জানতে ইচ্ছে করে, যদি সেই পিকেট না-থাকে তবে সেটা কি রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের অগোচরে তুলে দেওয়া হয়েছিল? এত দিন ঊর্ধ্বতন সবাই কি চোখ বুজে ছিলেন?
দ্বিতীয়ত, ভোট মেটার পরে পুলিশ কমিশনার পদে যিনি ফিরে এসেছেন, তিনিই বা কী করলেন? যদি এনআরএস-এ ঘটনা না ঘটত, তা হলে আরও কত দিন, কত মাস হাসপাতালগুলি অরক্ষিত থাকত, সেই জবাব কে দেবেন? কোন পুলিশ কর্তা, অথবা নবান্নের কোন আমলা?
কেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে বিষয়টি জেনে তবে ব্যবস্থা নিতে হবে? এটা কি মুখ্যমন্ত্রীর স্তরে নজরদারির যোগ্য কাজ? এ বার কি রাস্তায় ট্র্যাফিকও তাঁকে সামলাতে হবে!
এই যদি প্রশাসনের অবস্থা হয়, তা হলে শঙ্কা জাগে কোথাও হয়তো কোনও ফাঁক থেকে যাচ্ছে। কয়েক দিন আগেই খোদ মুখ্যমন্ত্রীর চলার পথে ‘নিরাপত্তার গাফিলতি’ নজরে এসেছে। মমতা নিজে তার জন্য পুলিশকে ভর্ৎসনাও করেছেন। এখন হাসপাতালেও দেখা গেল নিরাপত্তা কোন গহ্বরে তলিয়ে গিয়েছে।
কোনও ঘটনা ঘটার পরে প্রশাসন জাগবে, কিন্তু আগাম কোনও সতর্কতা থাকবে না— এই যদি হাল হয়ে দাঁড়ায়, সেটা খুব স্বাস্থ্যকর নয়। কোনও যুক্তি দিয়েই এই ফাটল ভরানো যাবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy