দুর্ভোগ: কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে এ ভাবেই অপেক্ষায় রয়েছেন অগ্নিদগ্ধ জামেনা বিবি। (ডানদিকে) ছ’দিন ধরে চিকিৎসার আশায় এসএসকেএমের জরুরি বিভাগের সামনে পড়ে রয়েছেন বাঁকুড়ার কালীপদ বাউড়ি। রবিবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
কোথাও হাসপাতালের সামনে শুয়ে কাতরাচ্ছেন পোড়া রোগী, কোথাও গুরুতর আঘাত নিয়ে ছ’দিন ধরে রোগী পড়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে। এমনকি অন্তঃসত্ত্বার শারীরিক অবস্থা খারাপ হতে দেখেও পরিবারকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়ার অভিযোগ উঠছে জুনিয়র চিকিৎসকদের একাংশের বিরুদ্ধে। চিকিৎসা পরিষেবা স্বাভাবিক করতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন প্রত্যাহার করে কাজে যোগদানের পরামর্শ দিয়েছিলেন শনিবার। কিন্তু কর্মবিরতির ষষ্ঠ দিন, রবিবার শহরের পাঁচটি হাসপাতাল ঘুরে রোগী ভোগান্তির ছবিটাই সামনে এল।
এ দিন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দু’নম্বর গেট দিয়ে ঢুকে নিউ বিল্ডিংয়ের সামনে দেখা মিলল জামেনা বিবির। মুর্শিদাবাদের ডোমকলের বাসিন্দা অগ্নিদগ্ধ ওই মহিলা প্রচন্ড গরমে তখন কাতরাচ্ছেন। জুনিয়র চিকিৎসকদের কর্মবিরতির প্রথম দিন গত মঙ্গলবার থেকে সেখানেই মশারি টাঙিয়ে রাখা হয়েছে জামেনাকে।
দিদি নাসিমা বলেন, ‘‘রান্না করতে গিয়ে গায়ে আগুন লেগেছিল বোনের। অবস্থা খারাপ হওয়ায় ডোমকল হাসপাতাল থেকে বদলি করেছিল। ডাক্তারদের ধর্মঘটের জন্য ভর্তি করতে পারছি না।’’ ক্ষোভ উগরে দিয়ে নাসিমা বলেন, ‘‘ডাক্তারের গায়ে হাত দেওয়া বড় ভুল। কিন্তু এ জন্য এত রোগী চিকিৎসা পাবেন না! তাঁদের কী দোষ? রোগীরা যে কষ্ট পাচ্ছেন সেটা চুপচাপ দেখাও তো নিষ্ঠুরতা।’’ এ দিন হাসপাতালের দু’নম্বর গেট ছাড়া সব প্রবেশপথ বন্ধ ছিল। রোগীদের অনেকের অভিযোগ, তাঁদের জরুরি বিভাগ থেকে ফেরানো হয়েছে।
আন্দোলনের প্রথম দিন থেকেই ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মূল গেট বন্ধ রয়েছে। এ দিনও দেখা গেল, গুরুতর অবস্থার রোগীকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। গেটের বাইরে অপেক্ষারত রোগী ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে ভিতর থেকেই কথা বলছেন জুনিয়র ডাক্তাররা। পরিবারকে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, ‘চিকিৎসকদের আন্দোলন চলছে। অন্য হাসপাতালে নিয়ে যান।’ এ সবের মধ্যেই অবশ্য অনেক অনুনয় করে জরুরি বিভাগ পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিলেন তপসিয়ার বাসিন্দা বিশু হাজরা। চোখে গুরুতর আঘাত নিয়ে যাওয়া ওই রোগীর পরিবার জানায়, সেখান থেকে একটি ইঞ্জেকশন দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে তাঁকে।
এ দিন আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিভাগের সামনে অ্যাম্বুল্যান্সে বসে কাতরাচ্ছিলেন বসিরহাট থেকে আসা এক অন্তঃসত্ত্বা অর্পিতা বিশ্বাস। বসিরহাট মহকুমা হাসপাতাল থেকে রেফার হওয়া ওই রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে এক জুনিয়র মহিলা ডাক্তার তখন অর্পিতার পরিবারকে বলছেন, ‘‘আমাদের আন্দোলন চলছে। দয়া করে অন্য হাসপাতালে যান।’’ সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা অর্পিতার ছবি তুলে পরিবারের সঙ্গে কথা বলা শুরু করতেই অবশেষে তাঁকে ভর্তি নেওয়া হয়। জরুরি বিভাগে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে এ দিন আর জি কর থেকে ফিরে যান দুর্ঘটনায় মাথা ফেটে যাওয়া গোয়াবাগানের বাসিন্দা রাজেন্দ্র প্রসাদ। বীরভূম থেকে আসা এক রোগীর দিদি জুলি পটুয়া বলেন, ‘‘জরুরি বিভাগে বলা হচ্ছে, ডাক্তার না থাকায় চিকিৎসা মিলবে না। এই বলে বিধাননগর মহকুমা হাসপাতালে বদলি করা হল।’’
রোগী ফেরানোর একই চিত্র রবিবার ধরা পড়ল এস এস কে এম হাসপাতালে। হাবড়ার বাসিন্দা ইলেকট্রিক মিস্ত্রি তপনকুমার পাল শনিবার কাজ করতে গিয়ে উঁচু থেকে পড়ে মাথায় গুরুতর আঘাত পান। তাঁকে শনিবার প্রথমে হাবড়া হাসপাতাল ও পরে বারাসত মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বারাসত থেকে রেফার করায় এ দিন তাঁকে এসএসকেএমে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রায় দু’ঘণ্টা অপেক্ষা করেও তাঁকে ভর্তি করা যায়নি। বাধ্য হয়ে রোগীর পরিবার মল্লিকবাজারের এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেন তাঁকে। এক আত্মীয় প্রদীপ সরকারের অভিযোগ, ‘‘আমাদের এত টাকা কোথায়? বাধ্য হয়ে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করলাম।’’ ছ’দিন ধরে ওই হাসপাতালেরই জরুরি বিভাগের সামনে চিকিৎসার আশায় পড়ে রয়েছেন বাঁকুড়ার বাসিন্দা কালীপদ বাউড়ি।
কর্মবিরতির মাঝেই কামারহাটির সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছিল দিন তিনেকের এক শিশুর। এ দিন তার মা ঝুম্পা কর্মকার মল্লিককে হাসপাতাল থেকে ছাড়া হয়। তখনও তিনি জানেন না যে তাঁর বাচ্চা আর নেই। ওই হাসপাতালে সদ্যোজাতের জন্য ভেন্টিলেটর না থাকায় এবং রেফার করতে চেয়ে স্বাস্থ্য ভবনে বার কয়েক ফোন করেও না পাওয়ায় শিশুটির মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন কর্তৃপক্ষ। ফের তেমন পরিস্থিতি তৈরি যাতে না হয়, সে জন্য আগাম সতর্কতা দেখাচ্ছেন কর্তৃপক্ষ। দিন তিনেক আগেই সেখানে সুজাতা বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক মহিলা শিশুকন্যার জন্ম দিয়েছেন। হাসপাতাল সূত্রের খবর, জন্মের পর থেকেই শ্বাসকষ্টে ভুগছে শিশুটি। তার অক্সিজেন চলছে। সুজাতার পরিবারের দাবি, ভেন্টিলেশনে দেওয়ার কথা এখনও জানাননি চিকিৎসকরা। তেমন পরিস্থিতি হলে তাঁরা কোথায় যাবেন জানেন না। সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সুপার পলাশ দাস বলেন, ‘‘কর্মবিরতি চালালেও সিনিয়র চিকিৎসকরা কাজ করছেন। ইমার্জেন্সিও চলছে। ওই সদ্যোজাতকে অন্যত্র নিয়ে যেতে চাইলে পরিবার যেন চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে নেয়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy