কাজে ব্যস্ত ধ্রুববাবু। নিজস্ব চিত্র।
কাঠ আর বাটালির নেশায় দুর্গাপুর রাষ্ট্রায়ত্ত স্টিল কারখানার চাকরিতে যোগ দেননি তিনি। বাহাত্তর পেরিয়েও তাঁকে দেখা যায় কাঠের গায়ে ফুটিয়ে চলেছেন একের পর এক শিল্পকর্ম। তিনি বর্ধমানের ইছলাবাদের ধ্রুবচন্দ্র শীল। এ বার তাঁকেই ‘শিল্পগুরু’ পুরস্কার দিতে চলেছে কেন্দ্র সরকারের হস্তশিল্প উন্নয়ন দফতর।
ধ্রুববাবু তাঁর স্টুডিয়োতে বসেই এক নাগাড়ে বলে চলেন তাঁর শিল্পী হয়ে ওঠার ইতিবৃত্ত, কাঁটাতার টপকে বর্ধমানে আসার গল্প। মাত্র বছর দশেক বয়েসে মাথা গোঁজেন উদ্বাস্তু শিবিরে। সেখানেই বাবার কাছে শিল্পের প্রাথমিক পাঠ নেওয়া। আলাপচারিতায় জানা যায়, সাতের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ধ্রুববাবু আসবাবপত্র তৈরি ছেড়ে পুরোপুরি নিজেকে নিয়োজিত করেন কাঠের বিভিন্ন মূর্তি তৈরির কাজে। একের পর এক মেলা ও প্রদর্শনীতে ধ্রুববাবুর কাজগুলি নজর কাড়ে সমঝদারদের। স্বীকৃতি মেলে রাজ্য সরকারের তরফেও। ১৯৯৬ সালে ধ্রুববাবু একটি কাঠের ফ্রেমে ফুটিয়ে তুলেছিলেন রাম-রাবণের যুদ্ধ। সেই শিল্পকর্মের জন্য মেলে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার।
গত ২১ মে কেন্দ্র সরকারের হস্তশিল্প উন্নয়ন কমিশনার সমীরকুমার বিশ্বাস চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, ২০১২ সালের জন্য ধ্রুববাবুকে ‘শিল্পগুরু’ সম্মান দেবে কেন্দ্র সরকার। ধ্রুববাবুর জীবনপঞ্জি পাঠানোরও অনুরোধ করা হয় ওই চিঠিতে। প্রতি বছর ‘শিল্পগুরু’ পুরস্কার পাওয়া শিল্পীদের জীবন নিয়ে একটি বইও প্রকাশ করে কেন্দ্র সরকারের তথ্য দফতর। চিঠির অনুরোধ মতো ধ্রুববাবু সংশ্লিষ্ট দফতরে সমস্ত নথি পাঠিয়ে দিয়েছেন।
কী করে মিলল এই পুরস্কার? ধ্রুববাবু বলেন, ‘‘বছর খানেক আগে ৪ ফুটের একটি ফ্রেমে দুর্গার মূর্তি তৈরি করি। তা দেখেই সরকার এই পুরস্কারের জন্য আমার নাম বিবেচনা করে।’’ ২০০২ সাল থেকে কেন্দ্র সরকার এই ‘শিল্পগুরু’ পুরস্কার চালু করে। শুধুমাত্র ৫৫ বছরের বেশি ও রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পাওয়া শিল্পীরাই এই পুরস্কার পেতে পারেন বলে জানা গিয়েছে। বর্ধমান জেলা থেকে এর আগে ‘শিল্পগুরু’ পুরস্কার পেয়েছেন মঙ্গলকোটের বনকাপাশি গ্রামের শোলাশিল্পী আদিত্য মালাকার।
ধ্রুববাবু জানান, শিল্পকর্ম দেখানোর জন্য বিদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আমন্ত্রণ আসে। কিন্তু সংসারের চাপে ইতালি ছাড়া আর কোথাও যাওয়া হয়নি। তবে তার জন্য কোনও আক্ষেপ নেই ধ্রুববাবুর। আক্ষেপ যে নেই তা বোঝা গেল, শিল্পী-দাদুকে নিয়ে নাতি-নাতনিদের উচ্ছ্বাস দেখে। ধ্রববাবুর দুই ছেলে রামচন্দ্রবাবু ও ভরতচন্দ্রবাবুও বাবার পথই বেছে নিয়েছেন। তাঁদেরও রাজ্য সরকারের তরফে পুরস্কৃত করা হয়েছে। ধ্রুববাবুর স্ত্রী মমতাদেবী, বড় বউমা রমাদেবীও শিল্পী। তাঁরা ব্যস্ত পোড়া মাটির কাজ নিয়ে। ধ্রুববাবুর ছেলেরা বলেন, “বর্ধমান শহর ও সংলগ্ন এলাকার মোট ২৫০-৩০০ জন শিল্পী বাবার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এই শিল্পকেই জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছেন।’’ নতুন করে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও স্টুডিও তৈরি করা হয়েছে।
প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের চারদিকে ছড়িয়ে সেগুন-শাল কাঠের ফ্রেম। সবই যেন শিল্পীর ছোঁয়া পাওয়ার অপেক্ষায়। তবে বয়েস থাবা বসিয়েছে শরীরে। সে সব পাত্তা না দিয়েই বাটালি হাতে ধ্রুববাবু বলে চলেন, ‘‘বয়স হলেও মূর্তি তৈরির সময় কোথা থেকে যেন শক্তি পাই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy