চলতি বছরে দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসছে ভারতীয় বিচারব্যবস্থা। নির্ভয়া-কাণ্ডে এক সাজাপ্রাপ্তের রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদনের প্রেক্ষিতে ফাঁসির দিন পিছনোয় দেশ জুড়ে একটা চাপা ক্ষোভ দেখা দিচ্ছে। তবে সম্প্রতি রাজ্যজুড়ে বেশ কয়েকটি অপরাধের ঘটনায় দোষীদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে জেলা আদালতগুলি। এই প্রেক্ষিতে অবশ্য বিতর্কের অভিমুখ খানিকটা পাল্টেছে। প্রথমেই চরমতম শাস্তি হিসেবে ফাঁসির যৌক্তিকতা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। একাংশ ফাঁসির বদলে আজীবন কারাবাসের দাবি করছেন। আবার কেউ ফাঁসিকেই সমর্থন জানাচ্ছেন। অন্য দিকে, জেলা আদালতগুলি ফাঁসির সাজা দিলেও সেগুলি কতদিনে কার্যকর করা যাবে তা চিন্তিত অনেকেই।
গত এক সপ্তাহে উত্তরবঙ্গ-সহ বেশ কয়েকটি জায়গায় দোষীদের ফাঁসির সাজা দেওয়ার পরেই শুরু হয়েছে বিতর্ক। সমাজকর্মী ও অপরাধবিজ্ঞানীদের দাবি, এক সপ্তাহের মধ্যে এতগুলি ফাঁসির সাজা ঘোষণা করা হলেও অভিযুক্তদের সামনে হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট এবং রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত প্রাণভিক্ষার আবেদন জানানোর সুযোগ থাকায় এখনই শাস্তি কার্যকর করা যাবে না। ফলে, এখনও বেশ কয়েক বছর নানা টানাপড়েনের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে নির্যাতিতের পরিজনদের। এখানেই সমস্যা। ভারতীয় বিচারব্যস্থার এই দিক নিয়েই সমালোচনায় ‘মুখর’ হচ্ছেন অনেকে।
তাঁদের দাবি, যে অপরাধকে ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ বলে আদালত অভিহিত করেছে, তার শাস্তি কার্যকর করায় দেরি হবে কেন? আবার উঠে আসছে বিরুদ্ধ মতও। কয়েকজনের দাবি, নিম্ন আদালতে এক বার দোষী সাব্যস্ত হলেও বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় উচ্চতর আদালতে অভিযুক্তেরা নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে উচ্চতর আদালতে ধরা পড়ে, নিম্ন আদালতে বিচারের ক্ষেত্রে কিছু ত্রুটি থেকে গিয়েছিল। এর ফলে, এক বার দোষী সাব্যস্ত হলেই যে কেউ অপরাধী— এমনটা জোর দিয়ে বলায় আপত্তি রয়েছে একাংশের। তাঁদের দাবি, প্রকৃত সত্য জানতে বারবার ঘটনাকে বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করা দরকার। ঠিক এই কাজটাই করা হয় ভারতীয় বিচারব্যবস্থায়। সেখানে এক জনকে দ্রুত শাস্তি দিতে গিয়ে যাতে কোনও ভাবেই বিচারে ভুল না হয়, সে দিকে নজর রেখেই এই কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। এই কারণেই উচ্চতম আদালত পর্যন্ত অভিযুক্তই ‘অপরাধী’ কি না সে বিষয়ে চুলচরা বিচার বিশ্লেষণের দরকার।
এই প্রবণতাকে সমালোচনা করে অনেকে বলেন, যেহেতু ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ অপরাধে দণ্ডিতদের মানসিক অবস্থান এবং ঠান্ডা মাথায় নৃশংস অপরাধ করার ক্ষমতা সাধারণের থেকে অনেক বেশি, তাই তাদের বাঁচিয়ে রাখার অর্থ— দেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি অপরাধীদের ‘ভয়’ নষ্ট হয়ে যাওয়া। ‘বিরলতম’ অপরাধ করেও দিনের পর দিন বেঁচে থাকার অর্থই হল অপরাধীদের কাছে ভুল বার্তা যাওয়া। এতে সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সমস্যা হয়। প্রাণভিক্ষার আর্জি যদি কোনও কারণে মঞ্জুর হয়, তা হলে কিন্তু পরবর্তী সময়ে এ ধরনের অপরাধীদের ক্ষেত্রে অন্যায় করেও পার পাওয়া যাবে এমন ধারণা সৃষ্টির আশঙ্কাও তৈরি হয়। তাই অবিলম্বে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার দাবি জানাচ্ছেন অনেকে।
তবে এই বিতর্কের প্রেক্ষিতে একটা কথা বলাই যায়, যখন অপরাধ হয় ঘৃণ্য এবং অপরাধীর মানসিকতা থেকে যায় অপরিবর্তনীয় তখন অপরাধের কিনারা ও বিচার হলে যত দ্রুত সম্ভব অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া দরকার। সেই সঙ্গে হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টে যাতে সে সংক্রান্ত মামলার শুনানি দ্রুত শেষ করে রায় দেওয়া যায় সে বন্দোবস্তও করা দরকার।
মইন আখতার মল্লিক
বিচারপ্রার্থীদের কথাটাও ভাবতে হবে
জেলে নিজেদের মধ্যে বিশেষ কথা বলছিল না ওরা। তবে কয়েকটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, এক সঙ্গে ওদের চার জনের কথা বলতে দিয়ে তাদের কথা থেকেই কারারক্ষীরা আঁচ করেছিলেন কী করে ফাঁসির দিন আরও পিছনো যায় তলে তলে তারই পরিকল্পনা করছিল নির্ভয়া কাণ্ডের চার অভিযুক্ত। ঠিক সেই আশঙ্কা সত্যি করে এক জনের প্রাণভিক্ষার আবেদন খারিজ হতেই রাষ্ট্রপতির শরণাপন্ন হল আরও এক জন। তার আবেদন খারিজ হলে নিশ্চয় বাকিরাও একই আবেদন করবে। আর তার থেকেও অস্বস্তির কথা, দণ্ডিতদের এ ভাবে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন ভারতীয় আইন ও সংবিধানকে রক্ষার ব্রত নিয়ে পড়াশোনা করেছেন এমন কয়েকজন আইনজীবী। সম্প্রতি দেশ জুড়ে পরপর কয়েকটি ঘটনায় অপরাধীদের ফাঁসি ঘোষণার পরে, বারবার এ প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে— এ ভাবে আইনের সুযোগ নিয়ে কতদিন বাঁচবে অপরাধীরা?
প্রশ্ন জাগছে, এ ভাবে যদি অপরাধীরা দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরেও বিচারব্যবস্থার নিয়ম মানার কারণে শাস্তি থেকে আপাত-রক্ষা পায় তা হলে জনমানসে কী বার্তা যাবে? এই ঘটনা যে বিচারব্যবস্থার প্রতি একশ্রেণির মানুষকে অধৈর্য করে তোলে তার প্রমাণ তো হাতের কাছেই রয়েছে। তেলঙ্গানায় চিকিৎসককে ধর্ষণ এবং খুনে অভিযুক্তদের এনকাউন্টারের পরে, গোটা দেশ জুড়ে শোরগোল পড়েছিল। সে সময়ে একদল মানুষের উল্লাসই বলে দিয়েছিল অপরাধের কিনারা হওয়ার পরেও, ‘দোষী’র (এ ক্ষেত্রে অভিযুক্ত) শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত জনমানসে কতটা ক্ষোভ থাকে। ফলে, আশঙ্কা থেকেই যায়, তা হলে কি পরোক্ষ ভাবে অপরাধীদের শাস্তি কার্যকর হওয়ায় দেরি মানুষকে এনকাউন্টারের নীতিতে আস্থাবান করে তুলছে না তো?
ইতিহাস বলে, যখনই বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা টলে, তখনই রাষ্ট্রে বিঘ্ন ঘটেছে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায়। দেখা গিয়েছে, জনরোষকে কাজে লাগিয়ে দ্রুত ‘হাতে গরম বিচার’-এর আশ্বাস দিয়ে ক্ষমতা দখলে সচেষ্ট হয়েছে হিংসাশ্রয়ীরা। প্রশ্ন উঠছে, বর্তমান ভারত ধীরে সেই পরিণতির দিকে এগিয়ে চলছে না তো।
বর্তমান প্রজন্মের মানসিক বৈশিষ্ট্য আলোচনা করলে দেখা যায় সাধারণ মানুষ বিশেষ করে দেশের বর্তমান তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সংবেদনশীলতা ও নিরাপত্তাহীনতা আগের থেকে অনেকটা বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে পরবর্তী অপরাধ রুখতে দ্রুত ন্যায়বিচার চাইছেন অনেকে। কিন্তু ন্যায়বিচারের জন্য বছরের পরে বছর আদালতের দরজায় মাথা খোঁড়া, বা আর্থ-সামাজিক কারণে বিচারপ্রার্থীর ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হওয়া সাধারণ মানুষ মানতে নারাজ। তাই কোনও কারণে বিচারপ্রার্থীর প্রতি ন্যায়বিচারে দেরি জনমানসে বিরূপ প্রভাব ফেলতে বাধ্য।
এই পরিস্থিতিতে দেশের এক আদালতে দোষী সাব্যস্তেরা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যাওয়ায় এক দোর থেকে অপর দোরে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে বিচারপ্রার্থীদের। দেশের অধিকাংশ নাগরিকই তাই চাইছেন দ্রুত এবং ত্রুটিহীন বিচার হোক। সে কাজের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো তৈরির দাবিও রয়েছে। রয়েছে মানুষকে ( ভয়ে) ঘৃণ্য কাজ করা থেকে বিরত করতে পারে, এমন শাস্তির দাবিও। সমাজের এই দাবি যদি বিচারের প্রক্রিয়াগত কারণে আটকে যায়, তা হলে জনমানসে বিপরীত দিকে ঝোঁকার প্রবণতা অর্থাৎ, আইন হাতে তুলে নেওয়ার মানসিকতা তৈরি হওয়াকে ‘অস্বাভাবিক’ বলা চলবে না।
জেসমিন সুলতানা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy