অঙ্কন: রৌদ্র মিত্র
লোডশেডিংয়ে উঠোন ধুয়ে যাচ্ছিল জোছনায়। মা-কাকিমা ব্যস্ত রান্নাঘরে। ঠাকুমা, দাদুর মাঝে বসে দুর্গার গল্প শুনেছিলাম আমি। দুর্গা, যিনি দুর্গতি বিনাশ করেন।
‘‘দৈত্যনাশার্থবচনো দকারঃ পরিকীর্তিতঃ।
উকারো বিঘ্ননাশস্য বাচকো বেদসম্মত।।
রেফো রোগঘ্নবচনো গশ্চ পাপঘ্নবাচকঃ।
ভয়শত্রুঘ্নবচনশ্চাকারঃ পরিকীর্তিত।।’’
অর্থাৎ দ অক্ষরটি দৈত্য বিনাশ করে, উ-কার বিঘ্ন নাশ করে, রেফ রোগ নাশ করে, গ অক্ষরটি পাপ নাশ করে এবং অ-কার শত্রু নাশ করে। দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা।
স্কন্দ পুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, বরাহ পুরাণে দুর্গার উল্লেখ আছে। তিনি কখনও দুর্গ নামের অসুর, কখনও শুম্ভ-নিশুম্ভ, কখনও মহিষাসুরকে বধ করেছেন। তাঁদের অপরাধ ছিল, কখনও জোর করে অন্যের জিনিস কেড়ে নিয়েছে তাঁরা, কখনও নারীকে দেখেছে অপমানের, লোভের চোখে। আর তার শাস্তি হয়েছে বিনাশ, মৃত্যু। তবে দুর্গতিনাশিনীর এই রূপ চার ছেলেমেয়ে পাশে নিয়ে বঙ্গ মহামায়ার রূপের থেকে খানিক আলাদা। এখানে অসুরও থাকে, ত্রিশূলও থাকে, আবার একই সঙ্গে ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার ধরে রাখেন দুর্গা। এই দুর্গারা ঘোরাফেরা করেন আমাদের চারপাশেও। কখনও রেণু খাতুন, বিলকিস বানো, কখনও ট্রিনিটি সাইয়ো বা বিরুবালা রাভার মতো তাঁরা লড়াই করেন। সেই লড়াই অস্তিত্ব রক্ষার, আবার উন্নয়নেরও। ছোটবেলার জোছনামাখা সেই উঠোনের মতোই ওঁদের কাহিনি ধুয়ে দেয় সব ক্লান্তি, গ্লানি। ছোট থেকে লক্ষ্মীমন্ত হতে শেখা মেয়েরা একাধারে সরস্বতী, এমনকি দুর্গাও হয়ে ওঠেন এ ভাবেই।
অসমের গোয়ালপাড়ার ঠাকুরভিলা গ্রাম কুখ্যাত ছিল একাধিক মহিলাকে ডাইনি অপবাদে ঘরছাড়া করার জন্য। দশকের পর দশক ধরে সে প্রথার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন গ্রামবাসীও। রুখে দাঁড়ান বিরুবালা রাভা। পশ্চিমবঙ্গেও ডাইনি অপবাদে ঘরছাড়া করা, বিবস্ত্র করে মারধরের ঘটনা শোনা যায়। বিরুবালা একটি দল গড়ে প্রতিবাদ করেন এই কুসংস্কারের। দীর্ঘ দিন ধরে হুমকি, মারধরের মুখোমুখি হয়ে ‘ঠাকুরবালা মহিলা সমিতি’ গড়ে ওই গ্রাম ও আশপাশের বহু গ্রামে তিনি বোঝান, এই প্রথা আসলে সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়া, মহিলাদের অবদমনের চেষ্টা। নিজের লড়াইয়ে বিরুবালাও দুর্গা।
কেতুগ্রামের রেণু খাতুনের কব্জি কেটে নিয়েছেন তাঁর ‘প্রিয়জন’। সদ্য নার্সিংয়ের চাকরি পাওয়া রেণুর ডান হাতের অংশ বাদ যাওয়া মানে ভবিষ্যৎই নড়ে যাওয়া। অদম্য রেণু অস্ত্রোপচারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বাঁ হাতে লেখা শুরু করেন। এখন নার্সিং হস্টেলের মেয়েদের নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে অণুপ্রাণিত করেন তিনি। এ গল্পও লক্ষ্মীমন্ত মেয়ের দুর্গারূপ বেরিয়ে আসার।
মেঘালয়ের এক পাহাড়ি গ্রামের স্কুল শিক্ষিকা ট্রিনিটি সাইয়োর দুর্গারূপে মিশে থাকেন সরস্বতী। ১৮ বছর আগে এক বিশেষ হলুদের চাষ শুরু করেন তিনি। পূর্বসূরিদের চাষের পদ্ধতি অণুসরণ করলেও, ট্রিনিটি তাঁর গবেষণায় বুঝেছিলেন এই হলুদ বিশেষ রকমের। সাধারণ হলুদে ক্যানসার প্রতিরোধকারী কারকিউমিন থাকে পাঁচ শতাংশ। লাচেনের হলুদে তা থাকে ১২ শতাংশের কাছাকাছি। গ্রামের মহিলাদের ওই হলুদ চাষ শেখান তিনি। এখন হাজার খানেক মহিলা তাঁর সঙ্গী।
২০০২ সালে গোধরা-কাণ্ডের পরে গুজরাতে সাম্প্রদায়িক হিংসা চলাকালীন দাহোড় জেলার এক গ্রামে ভয়াবহ হামলা হয়। পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা বিলকিস বানোর সঙ্গে তাঁর মা-বোনকে গণধর্ষণ করা হয়। বিলকিসের চোখের সামনে তাঁর তিন বছরের মেয়েকে পাথরে আছড়ে মারে হামলাকারীরা। পরিবারের ১৪ জন-সহ ওই গ্রামের ১৭ জনকে খুনও করা হয়। বম্বে আদালত অভিযুক্ত ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। পরে তাদের এক জন সুপ্রিম কোর্টে মুক্তির আবেদন করে। আদালত গুজরাত সরকারকে তা বিবেচনা করতে বলে। বিবেচনা করে ১১ জনকেই মুক্তি দিয়েছে ওই সরকার। ২১ থেকে ৪১-এ পৌঁছে যাওয়া বিলকিসের সব ক্ষত আবার টাটকা হয়ে ওঠে। যুদ্ধে জিতেও কোথাও একটা হেরে যাওয়া গ্রাস করে। নারীর দিকে লোভ, কাম-দৃষ্টি দেওয়ায় মহিষাসুরকে বধ করা দানবদলনীকে আমরা পুজো করলেও বিলকিসের পাশে থাকতে পারি না। অথচ, তিনি এবং তাঁর মতো অনেকের জীবনের বড় অংশ শুধুই যুদ্ধ।
মহালয়ায় ‘মহিষাসুরমদ্দির্নী’তে শুনি ‘‘হে ভগবতী মহামায়া, তুমি ত্রিগুণাত্রিকা। তুমি রজগুণে ব্রহ্মার গৃহিণী বাগদেবী, সপ্তগুণে বিষ্ণুর পত্নী লক্ষ্মী, তমো গুণে শিবের বনিতা পাবর্তী।’’ বাস্তবেও লক্ষ্মী, সরস্বতী দুর্গা মিশে যায় এক দেহে। ঠাকুমা বলতেন, মেয়েরা লক্ষ্মী। এখন ভাবি, মেয়েদের কেন শুধু লক্ষ্মীমন্ত হতে শেখানো হয়! লক্ষ্মীর ভাঁড়ে জমানো পয়সা মেয়ের পড়াশোনায় খরচ হয় না, বরং সমাজ-সংসার প্রতিকূল হলে মেয়ের হাতে বিদ্যার, বুদ্ধির, সাহসের অস্ত্র তুলে না দিয়ে বিয়ে দেওয়াটাই রীতি এখনও। করোনাকালে তাই স্কুলছুট বাড়ে, নাবালিকা প্রসূতির হার উদ্বেগ বাড়ায়। তবু আশা রাখি, আশ্বিনের শারদপ্রাতে আলোর বেণু বেজে বাজিয়ে মৃন্ময়ীর চিন্ময়ী হয়ে ওঠা হোক অনন্ত। মেয়েদের শুধু লক্ষ্মী নয়, দুর্গা হতেও শেখানো হোক ঘরে ঘরে। আবার কোনও এক জোছনামাখা রাতের শেষে নরম আলোর ভোরে দাদু-ঠাকুমার কোল ঘেঁষে বসা কোনও ছোট্ট মেয়ে শুনুক, ‘‘জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণধারিণী
অভয়া শক্তি, বলপ্রদায়িনী, তুমি জাগো...।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy