গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া রাজু ঝায়ের নিজস্ব বাড়ি রয়েছে বিধাননগরে। ২০২১-এ কয়লা কারবারে অভিযুক্ত জয়দেব খাঁয়ের সপ্তর্ষি পার্কে দু’টি ফ্ল্যাটে তল্লাশিতে এসেছিল সিআইডি। এই দু’জনই শুধু নন, বেআইনি কয়লা কারবারে অভিযুক্ত জয়দেব খাড়কা, লোকেশ সিংহ, নীরদ মণ্ডল-সহ আরও অনেকেরই দুর্গাপুরে স্থায়ী বা অস্থায়ী আস্তানা রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে খবর। কিন্তু এত জায়গা থাকতে এই কারবারিদের ঠাঁই কেন দুর্গাপুরেই, তা নিয়ে নানা মত উঠে আসছে সংশ্লিষ্ট মহলে। ওই মহলের মতে, এর নেপথ্যে রয়েছে চার কারণ।
প্রথম কারণ হিসাবে, পুলিশ ও কয়লা-ক্ষেত্রের সঙ্গে পরিচিতেরা জানাচ্ছেন, দুর্গাপুরকে বেছে নেওয়ার প্রধান কারণ এর ভৌগোলিক অবস্থান। ‘প্রয়োজন পড়লেই’ এখান থেকে দ্রুত রাজ্যের নানা প্রান্তে বা ভিন্-রাজ্যে ছড়িয়ে পড়া যায়। ১৯ নম্বর জাতীয় সড়ক চলে গিয়েছে দুর্গাপুরের মাঝ বরাবর। ফলে, সরাসরি ঝাড়খণ্ডের দিকে চলে যাওয়া যায়। মুচিপাড়া বা সিটি সেন্টার থেকে দুর্গাপুর ব্যারাজ হয়ে বাঁকুড়ার দিক দিয়ে দক্ষিণবঙ্গের যে কোনও জায়গায়, মুচিপাড়া থেকে শিবপুর হয়ে বীরভূম বা মুচিপাড়া থেকে মলানদিঘি ও রঘুনাথপুর হয়ে ১৪ নম্বর রাজ্য সড়ক ধরে বীরভূমে যাওয়া যায় সহজেই। সিটি সেন্টার থেকে আড়রা, কুলডিহা দোমড়া হয়ে রাজ্য সড়ক ধরে বীরভূমে বা রাজ্য সড়ক থেকে দেবশালা বা ১১ মাইল হয়ে পূর্ব বর্ধমান যাওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। এ ছাড়া, দরকার হলে বড় রাস্তা এড়িয়ে লাউদোহা, পাণ্ডবেশ্বর হয়ে বা কাঁটাবেড়িয়া, শিবপুর হয়ে ভিতরের রাস্তা ধরেও বীরভূম চলে যাওয়া যায়। এই ভৌগোলিক অবস্থান এবং উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে যে কোনও ব্যবসায়িক ‘চুক্তি’ চূড়ান্ত করার জন্যও আদর্শ জায়গা হল দুর্গাপুর। উদাহরণ হিসেবে, রাজুর ঘটনাটির কথাই বলছেন অনেকে। রাজু যে গাড়িতে খুন, সেটি গরু কারবারি শেখ আব্দুল লতিফের বলে জানা গিয়েছে। সে গাড়িটিও বীরভূম থেকেই এসেছিল দুর্গাপুরে।
পাশাপাশি, বেআইনি কারবারে আয় করা টাকা নির্মাণ ব্যবসা, পরিবহণ-সহ অন্য ব্যবসায় লগ্নির সুযোগও এই শহরে অনেক বেশি। একটি সূত্রের দাবি, কালো টাকা সাদা করতে অনেকেই খুচরো ব্যবসায় লগ্নি করেছেন। আবার ২০১৪-র পরে নানা কারণে ইস্পাত ও অনুসারী শিল্পে মন্দা নামার ফলে, অনেকে ধুঁকতে থাকা বা বন্ধ কারখানায় সুযোগ বুঝে নামে-বেনামে লগ্নি করেছেন, বোর্ড অব ডিরেক্টর্সের একাধিক পদ কিনে সংস্থার শেয়ার পেয়েছেন অনেকে। এ ধরনের কারখানায় বিনিয়োগের উদাহরণ দুর্গাপুর ও লাগোয়া এলাকার শিল্পাতালুকগুলিতেই রয়েছে বলে শহরের প্রবীণ ব্যবসায়ীদের একাংশ জানাচ্ছেন। সে সঙ্গে, পরিবহণ সংস্থা খুলে ট্রাক, ডাম্পার কিনে ডিএসপি-সহ বিভিন্ন কারখানার মালপত্র তোলা-নামানো, স্ক্র্যাপের ব্যবসার দখল নেওয়া, বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ, ফুডপ্লাজ়া, এমনকি বেনামে স্কুলে লগ্নি করার খবরও পাওয়া গিয়েছেবিভিন্ন সূত্রে।
এ ছাড়া, রয়েছে নাগরিক স্বাচ্ছন্দের প্রশ্ন। শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্স, তারকা হোটেল, নামী রেস্তরাঁ, ফাস্টফুডের চেন, দেশি-বিদেশি সংস্থার শো-রুম, বিভিন্ন হোটেলে বছরের বিশেষ-বিশেষ দিনে পার্টি সবই রয়েছে এখানে। এই জীবনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে দেখা যায় কয়লা কারবারিদের।
তা ছাড়া, রাজনৈতিক কারণেও এই শহরের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। নেতা-মন্ত্রীরা শিল্পাঞ্চলে প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে এলে অনেক সময় দুর্গাপুরে রাত্রে থাকেন। ব্যবসায়িক প্রয়োজনে অনেকেই তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। সে সারিতে বেআইনি কয়লা কারবারে যুক্ত ব্যবসায়ীদেরও দেখা যায়। সম্প্রতি এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সঙ্গে রানিগঞ্জের এক সময়ের তৃণমূল ঘনিষ্ঠ এবং পরে বিজেপিতে যোগ দেওয়া বেআইনি কয়লার কারবারে অভিযুক্ত পরিবহণ ব্যবসায়ী ও ইটভাটা মালিক জয়দেব খাঁয়ের ছবি ভাইরাল হওয়ায় বিতর্ক দেখা দেয়।
তবে, দুর্গাপুরে কয়লা কারবারিদের জন্য আইনশৃঙ্খলাজনিত তেমন বড় সমস্যা তৈরি হয়নি। তখনকার মতো সব শান্ত হয়ে গিয়েছে। আসলে, এই শহরকে নিজেদের স্বার্থেই কয়লা কারবারিরা কার্যত ‘সেফ হাউস’ হিসাবে ব্যবহার করে এসেছেন বরাবর, এমনটাই মনে করছেওয়াকিবহাল মহল।
কিন্তু এই যে কয়লা কারবার, তা শুরু হল কী ভাবে, কমে থাকে, কী ভাবেই বা বোঝা গেল জেলায় বেআইনি ভাবে কয়লা তোলা হচ্ছে, এ সব নানা বিষয়েও কৌতূহল রয়েছে জেলায়। (চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy