Advertisement
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
PhD of Maoist Leader

অর্ণবের জন্য ‘দাম’ দিচ্ছেন বাকিরা, বর্ধমানের ইতিহাস বিভাগে ভর্তিই শুরু হল না উপাচার্য জবাব না-পাওয়ায়

ইতিহাস ছাড়া অন্যগুলিতে পিএইচডিতে ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। জেল কর্তৃপক্ষের চিঠির জন্য অপেক্ষা করছে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়। ইতিহাস বিভাগ অবশ্য পুরো বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উপরে ছেড়েছেন।

অর্ণব দাম।

অর্ণব দাম। —ফাইল চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
বর্ধমান শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০২৪ ২৩:০০
Share: Save:

প্রবেশিকার পর ইন্টারভিউয়েও প্রথম হয়েছেন জেলবন্দি মাওবাদী নেতা অর্ণব দাম। কিন্তু এখনও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা শুরু করতে পারেননি তিনি। তৃণমূলের অভিযোগ, বাধা দিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। উপাচার্য যদিও জানিয়েছেন, অর্ণবের গবেষণার বিষয়ে যথেষ্ট ‘সদিচ্ছা’ রয়েছে তাঁদের। কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষের কাছে দু’টি বিষয় জানতে চেয়েও জবাব পাননি বলে বিষয়টি আটকে রয়েছে। জেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, তাঁরা কারা কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি পাঠিয়েছেন। অর্ণব ভর্তি হতে পারেননি বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে গবেষণার জন্য ভর্তি শুরু হয়নি বলেও জানিয়েছেন উপাচার্য। অন্য দিকে, রাজ্যের তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ উপাচার্যের দিকে আঙুল তুলে জানিয়েছেন, ওই বিষয়ে কথা হয়েছে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু এবং কারামন্ত্রী অখিল গিরিরও। প্রয়োজনে অর্ণবকে হুগলি জেল থেকে বর্ধমান জেলে নিয়ে আসা হতে পারে বলেও খবর। এই আবহে হুগলি জেলের মধ্যেই প্রতীকী অনশনে বসেছেন অর্ণব।

যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অর্ণব দীর্ঘ দিন ধরেই হুগলি জেলা সংশোধনাগারে বন্দি। ছাত্রজীবনে মেধাবী পড়ুয়া হিসাবে পরিচিত অর্ণব জেলে বসেই উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে যোগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষা সেট-এ উত্তীর্ণ হন। তার পরে জেল থেকে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে গিয়ে পিএইচডির প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে প্রথম স্থান অর্জন করেন। গত শুক্রবার পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। তৃণমূল নেতা কুণালের বক্তব্য, পরীক্ষায় ভাল ফল করা সত্ত্বেও অর্ণবকে পিএইচডি করতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। বাধা দিচ্ছেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্বয়ং গৌতম চন্দ্র। বৃহস্পতিবার নিজের এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে একটি পোস্ট করে কুণাল লিখেছেন, ‘‘মাওবাদী অভিযোগে বন্দি অর্ণব দামকে পিএইচডি করতে দিতে হবে। ও যোগ্যতা প্রমাণ করেছে।... উপাচার্য অকারণ জট তৈরি করে বাধা দিচ্ছেন।’’ ঘটনাটি নিয়ে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ভূমিকায় রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্যও ‘ক্ষুব্ধ’ বলে খবর শিক্ষা দফতর সূত্রে। কুণাল জানিয়েছেন, ওই দুই মন্ত্রী আলোচনা করেছেন। সহযোগিতার আশ্বাসও দিয়েছেন। গবেষণায় যাতে সুবিধা হয়, সে কারণে অর্ণবকে হুগলি থেকে বর্ধমান জেলে সরানো হবে।

উপাচার্য যদিও মানেননি অভিযোগ। আনন্দবাজার অনলাইনকে উপাচার্য জানিয়েছেন, তিনি চান অর্ণব তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়েই পিএইচডি করুন। দু’টি প্রশ্নের সদুত্তর মিললেই যাবতীয় ‘জটিলতা’ কেটে যাবে। সেই দুই প্রশ্ন তিনি পাঠিয়েছেন হুগলি জেল কর্তৃপক্ষকে। প্রথম প্রশ্ন, কী ভাবে অর্ণব বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে নিয়মিত ক্লাস করবেন? সে ক্ষেত্রে তাঁর নিরাপত্তার বিষয়টি কে বা কারা দেখবেন? দ্বিতীয় প্রশ্ন, অর্ণবকে পিএইচডি করতে দেওয়ার বিষয়ে জেল প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি বা অনুমোদন রয়েছে কি না। উপাচার্য জানান, ওই দু’টি বিষয়ের ‘সদুত্তর’ না মেলায় অর্ণবের পিএইচডিতে ভর্তির বিষয়টি শুরু করা যাচ্ছে না। তিনি এ-ও জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৯টি বিভাগের মধ্যে কেবল ইতিহাস ছাড়া অন্যগুলিতে পিএইচডিতে ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। জেল কর্তৃপক্ষের চিঠির জন্য অপেক্ষা করছেন তাঁরা। ইতিহাস বিভাগ অবশ্য পুরো বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উপরে ছেড়েছেন।

এর পর হুগলি জেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগায়োগ করে আনন্দবাজার অনলাইন। জেল সূত্রে জানা গিয়েছে, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সেই চিঠি রাজ্যের কারা দফতরকে পাঠানো হয়েছে। তার জবাব এখনও আসেনি। এই আবহে হুগলি জেলে প্রতীকী অনশনে বসেছেন অর্ণব।

উপাচার্যের দাবি

মাওবাদী নেতা অর্ণবকে গবেষণায় বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গৌতম চন্দ্রের দাবি, তিনি চান অর্ণব তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়েই পিএইচডি করুন। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি জানিয়েছেন, দু’টি প্রশ্নের সদুত্তর মিললেই যাবতীয় ‘জটিলতা’ কেটে যাবে। এই জবাব জানতে চেয়ে তিনি হুগলি জেলের সুপারকে চিঠি দিয়েছেন। তাঁর কথায়, “আমি হুগলির জেল সুপারকে চিঠি দিয়ে দু’টি প্রশ্ন করেছিলাম। প্রথম প্রশ্ন, কী ভাবে অর্ণব বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে নিয়মিত ক্লাস করবেন? সে ক্ষেত্রে তাঁর নিরাপত্তার বিষয়টি কে বা কারা দেখবেন? দ্বিতীয় প্রশ্ন, অর্ণবকে পিএইচডি করতে দেওয়ার বিষয়ে জেল প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি বা অনুমোদন রয়েছে কি না।” উপাচার্য জানান, ওই দু’টি বিষয়ের ‘সদুত্তর’ না মেলায় অর্ণবের পিএইচডিতে ভর্তির বিষয়টি শুরু করা যাচ্ছে না। ওই বিষয়ে নিজের ‘সদিচ্ছা’র দিকটিও ব্যাখ্যা করেন উপাচার্য। তিনি জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৯টি বিভাগের মধ্যে কেবল ইতিহাস ছাড়া অন্যগুলিতে পিএইচডিতে ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। তাঁরা হুগলি জেলের সুপারকে দেওয়া চিঠির উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছেন। ইতিহাস বিভাগ পুরো বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উপরে ছেড়েছেন। ইতিহাসের বিভাগীয় প্রধান সৈয়দ তনভীর নাসরিন বলেন, “আমরা একেবারে প্রস্তুত। অর্ণবের ভর্তি প্রক্রিয়া মিটে গেলেই আমরা ক্লাস শুরুর অপেক্ষায় আছি।”

জেল সূত্রে খবর

বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জানিয়েছেন, তিনি হুগলি জেল কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দিয়ে দু’টি বিষয় জানতে চেয়েছেন। জবাব না মেলার কারণেই অর্ণবের গবেষণার বিষয়ে জট কাটছে না। এমনিতে তাঁর কোনও আপত্তি নেই বলেই জানিয়েছেন উপাচার্য। এর পরেই হুগলি জেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে আনন্দবাজার অনলাইন। জেল সূত্রে জানা গিয়েছে, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সেই চিঠি রাজ্যের কারা দফতরকে পাঠানো হয়েছে। তার জবাব এখনও আসেনি। জবাব এলে তা পাঠিয়ে দেওয়া হবে উপাচার্যকে। এই আবহে হুগলি জেলে প্রতীকী অনশনে বসেছেন অর্ণব। দীর্ঘ দিন ধরে হুগলির জেলেই রয়েছেন তিনি। গত ফেব্রুয়ারিতে তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল আদালত।

টানাপড়েনের সূত্রপাত

খড়্গপুর আইআইটির মেধাবী ছাত্র অর্ণব পড়াশোনা ছেড়ে সিপিআই (মাওবাদী)-এর রাজনৈতিক মতবাদে আকৃষ্ট সেই সংগঠনে যোগ দিয়েছিলেন। শিলদা ইএফআর ক্যাম্পে হামলার ঘটনায় পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। গত ফেব্রুয়ারিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পান তিনি। দীর্ঘ দিন ধরেই হুগলি জেলা সংশোধনাগারে বন্দি। তিনি জেলে বসেই উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে যোগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষা সেট-এ উত্তীর্ণ হন। তার পরে জেল থেকে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে গিয়ে পিএইচডির প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে প্রথম স্থান অর্জন করেন। তার পরেও গবেষণার কাজ শুরু করতে পারেননি তিনি। সেই নিয়েই শুরু হয়েছে টানাপড়েন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাংশের ‘অস্বস্তি’

অর্ণবকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের একাংশের মধ্যে ‘অস্বস্তি’ রয়েছে বলে খবর। যদিও সাম্প্রতিক বিতর্কের প্রেক্ষিতে সেটি কেউই প্রকাশ্যে বলতে চান না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একটি সূত্রের খবর, একটা সময়ে ‘একে ৪৭’ রাইফেল নিয়ে ঘোরা অপরাধীর পিএইচডি করা নিয়ে আপত্তি রয়েছে কিছু অধ্যাপকের। এমনকি, পড়ুয়াদের একাংশও নাকি ওই বিষয়ে নিজেদের আপত্তির কথা জানিয়েছেন। পুলিশকে নিয়ে জেলবন্দি অপরাধী পিএইচডির ক্লাস করতে গেলে অন্য পড়ুয়াদের মনে কী প্রভাব পড়বে, তা নিয়েও চিন্তিত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের একাংশ। একাংশ আবার জানিয়েছেন, এক জন গবেষককে কেন ‘নিয়মিত’ বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হবে। সেই নিয়ে উপাচার্যের যুক্তি, পিএইচডির ক্ষেত্রে তাঁদের ছ’মাসের একটা কোর্স আছে। এই কোর্সে প্রত্যেক গবেষককে বিশ্ববিদ্যালয়ে সশরীরে হাজির থাকতে হয়। এর অনুমতি অর্ণব পাবেন কি না, তা নিয়ে রয়েছে ধন্দ।

কুণালের দাবি

বৃহস্পতিবার সকালেই অর্ণবকে পিএইচডি করতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ তুলে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে সরব হন তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ। নিজের এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে একটি পোস্ট করে কুণাল লেখেন, ‘‘মাওবাদী অভিযোগে বন্দি অর্ণব দামকে পিএইচডি করতে দিতে হবে। ও যোগ্যতা প্রমাণ করেছে।... উপাচার্য অকারণ জট তৈরি করে বাধা দিচ্ছেন।’’ কুণাল আরও লিখেছেন, পড়াশোনার সুবিধার জন্য অর্ণবকে হুগলির জেল থেকে বর্ধমান জেলে সরানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কিন্তু পাশাপাশিই কুণালের অভিযোগ, ওই বিষয়েও সমস্যা তৈরি করছেন উপাচার্য গৌতম। অর্ণব বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে তাঁর সঙ্গে পুলিশ যাবে কি না, তিনি কী ভাবে যাতায়াত করবেন, এই সব নানা বিষয় উত্থাপন করে বিষয়টিকে জটিল করছেন তিনি। প্রসঙ্গত, বন্দিজীবনে কুণালের ‘ঘনিষ্ঠ’ ছিলেন অর্ণব। দু’জনে একসঙ্গে পড়াশোনাও করতেন। সেখান থেকেই বন্ধুত্ব। অর্ণবের পিএইচডি সংক্রান্ত জটিলতা প্রসঙ্গে কুণাল বলেন, ‘‘আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব! অর্ণবকে পিএইচডি করিয়েই ছাড়ব!’’

‘ক্ষুব্ধ’ ব্রাত্য

তৃণমূল বার বার অভিযোগ করেছে, অর্ণবের গবেষণায় বাধা দিচ্ছে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ঘটনাটি নিয়ে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ভূমিকায় রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুও ‘ক্ষুব্ধ’ বলে খবর শিক্ষা দফতর সূত্রে। ব্রাত্য এবং রাজ্যের কারামন্ত্রী অখিল গিরি এ নিয়ে আলোচনা করেছেন। যাতে প্রয়োজনে অর্ণবকে হুগলি জেল থেকে বর্ধমান জেলে নিয়ে আসা যায়। সে ক্ষেত্রে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত সহজতর হতে পারে। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনে নেমেছে তৃণমূলের ছাত্র সংগঠন টিএমসিপি-ও। বৃহস্পতিবার উপাচার্য এবং রেজিস্ট্রার বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে গেলে তারা তাঁদের বাধা দেয় বলে অভিযোগ। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের সংগঠনও উপাচার্যের বিরোধিতা করেছে। তারা বলেছে, উপাচার্য উচ্চশিক্ষা দফতরের নির্দেশ সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করছেন।

অন্য বিষয়গুলি:

Burdwan university Bardhaman Arnab dam
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy