গলসির একটি খাদানে চলছে বালি তোলা। নিজস্ব চিত্র
রাস্তা বেহাল থেকে বালির ট্রাকের ধাক্কায় মৃত্যু, অভিযোগ ভুরি ভুরি। তবুও একের পর এক গজিয়ে উঠছে বৈধ, অবৈধ বালি খাদান।
কোনও দুর্ঘটনার পরে ক্ষোভ-বিক্ষোভ চলে এলাকায়। খাদান বন্ধের দাবি ওঠে। প্রশাসন ধরপাকড় করে। কিন্তু কারবার বন্ধ হয় না। স্থানীয় প্রশাসনের দাবি, এক-একটা খাদান ঘিরে বহু মানুষের জীবিকা চলে। তাঁদের মুখের দিকে তাকিয়েই অনেক সময়ে কিছু বলা যায় না।
গলসির দু’টি ব্লকে ৫২টির মতো বৈধ বালিঘাট রয়েছে। এই খাদানগুলির বেশির ভাগই বৈধ হয়েছে দু’বছর আগে। তখন থেকেই কৃষিকাজের বদলে খাদানে দিনমজুরিতে আগ্রহীদেরও সংখ্যা বেড়েছে। গলসির নানা বালি খাদানে কাজ করা সুমন্ত দাস, পবিত্র বিশ্বাসদের দাবি, “চাষবাস করে দিনে বড়জোর ২৫০-৩০০ টাকা রোজগার করা যায়। সেখানে বালি খাদানে কাজ করে দিনে ৮০০ টাকা পর্যন্ত মেলে।’’
কোনও খাদানে যন্ত্র দিয়ে বালি কাটা হলেও ন্যূনতম ৪২ জন শ্রমিক প্রয়োজন। আর কোদাল-বেলচা দিয়ে বালি তুলে ট্রাক্টরে তোলার মতো পুরনো পদ্ধতিতে হলে অন্তত ৯০ জন শ্রমিক দরকার। এ সব ক্ষেত্রে শ্রমিক নেওয়া হয় খাদান লাগোয়া পাড়া বা গ্রাম থেকে। আবার ওই সব শ্রমিক, গাড়ি চালকদের প্রয়োজনে চা, চপ-মুড়ির দোকান, ছোটখাট ভাতের হোটেলও খোলেন স্থানীয়রা। চোলাইয়ের মতো বেআইনি কারবারও দেখা যায়। সবমিলিয়ে রোজগার চলে অনেকের।
দীর্ঘদিন বালি-কারবারে সঙ্গে যুক্ত মানুষজনদের দাবি, “খাদানের বাইরে থাকা চরের বালি কেটে অনেকে বিক্রি করেন। ট্রাক্টর ভাড়া, গাড়ি ভাড়া, বালি তোলার যন্ত্র ভাড়া দিয়েও অনেকে আয় করেন। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে অনেকের বেঁচে থাকার পথ হয়ে গিয়েছে বালি খাদান। ফলে বেআইনি কাজ করেও পার পেয়ে যান খাদানের ইজারাদারেরা।’’ সেই কারণে বালির গাড়ি আটকাতে গিয়ে নিগৃহীত হতে হয় প্রশাসনের কর্তাদেরও। সম্প্রতি সুন্দলপুরে ‘নিগৃহীত’ হন ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের কর্তারা। জেলাশাসক অভিযান করে অতিরিক্ত বালিবোঝাই ট্রাক ধরার পড়ে ‘ওভারলোডিং’য়ের অভিযোগ ওঠে।
বছরখানেক আগে, গলসির গোবডালে দাদা-বোন ও জামালপুরে মা-মেয়ের মৃত্যুতে বালি খাদানকে দায়ী করেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। অগ্নি সংযোগে বালি তোলার যন্ত্র, অস্থায়ী অফিস পুড়ে যায়। খাদান বন্ধের দাবিও ওঠে। তার পরেও হামেশাই বালির গাড়ির ধাক্কায় মৃত্যু, বালি নিয়ে যাতায়াতে রাস্তা, চাষের জমি বেহাল হয়ে পড়ার অভিযোগ ওঠে। সোমবার রাতে গলসির শিকারপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছে বালির ট্রাক উল্টে একই পরিবারের পাঁচ জনের মৃত্যুর পরে অবশ্য স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, বন্ধ করে দেওয়া হোক খাদান। তিন বছর আগে যে ভাবে সংসার চলত, আবার সে ভাবে চলবে। অন্তত প্রাণটা বাঁচবে। যদিও দাবি যে মানা হবে না, তা-ও জানেন মহম্মদ আবু হেনা, দেবু ঘোষেরা। তাঁদের দাবি, “খাদান অনেকের রুজি-রোজগার। কিন্তু এ ভাবে ছাড়া যাবে না। বিকল্প পথ ভাবতে হবে। প্রশাসনকে সুষ্ঠু ব্যবস্থা করতে হবে।’’
ব্যবস্থা না নিলে বিপদ যে বেড়েই চলবে, মেনে নিচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন। গলসির গোহগ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান বিমল ভক্তের দাবি, “শিকারপুর-সহ এই এলাকার ১২টি খাদান থেকে কম করে সাড়ে তিন হাজার মানুষের পেট চলে। তাঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে অনেক সময় কিছু বলা যায় না।’’ আবার গলসি ১ ব্লকের কর্মাধ্যক্ষ (পূর্ত) ফাজিলা বেগমের দাবি, “আমার এলাকার ১৮টি খাদানে পাঁচ হাজারের উপর মানুষ কাজ করেন। অবৈধ খাদান বন্ধ করার জন্য অনেক চিঠি করেছি। এখন সে সব বন্ধ।’’
বিজেপির সাংগঠনিক সভাপতি (বর্ধমান সদর) সন্দীপ নন্দীর অভিযোগ, “বালি খাদানে টাকা উড়ছে। আর সেই টাকা যাচ্ছে শাসকের ঘরে।’’ তৃণমূলের জেলা সভাপতি স্বপন দেবনাথের পাল্টা দাবি, “আমরা মাফিয়া রাজের বিরুদ্ধে। প্রশাসন নিয়মিত ব্যবস্থা নিচ্ছে।’’
তবে ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের একাধিক কর্তার দাবি, এক-একটি খাদানের ইজারাদার সরকারের ঘরে ২০ কোটি টাকা জমা দেন। তার সঙ্গে জমা পড়ে রাজস্ব। সরকার আর ‘গ্রিন ট্রাইব্যুনালের’ নিয়ম পুঙ্খানুপুঙ্খ মানলে ব্যবসা চালানো কঠিন।
অতএব, বালির খাদে বসে দিন গোনাই ভবিতব্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy