ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্ত নেই, অথচ রোগীর জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন। এমন বহু পরিস্থিতিতে ফোন পেয়েছেন তিনি। দ্রুত রক্তদাতা জোগাড় করে ছুটে গিয়েছেন হাসপাতালে। গত এক দশক ধরে এমন ভাবে বহু মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছেন পূর্বস্থলীর চরগোয়ালপাড়ার বাসিন্দা বছর পঁয়তাল্লিশের হুমায়ুন শেখ। তাঁর এই অবিরাম নিঃস্বার্থ কাজের প্রশংসা করেছেন এলাকাবাসী।
একটি ছোট বাড়িতে মা, বাবা, স্ত্রী এবং চার সন্তানকে নিয়ে বাস হুমায়ুনের। এক সময় তাঁতের কাজ করতেন। ব্যবসা মন্দা যাওয়ায় টোটো চালাতে শুরু করেন। স্থানীয় হাড়কাটাগলি, গোয়ালপাড়া, ধোবা ও গাবতলা এলাকায় গেলেই দেখা মিলবে তাঁর। পাশাপাশি, রক্তদানের জন্য সমাজকর্মী হিসেবেও এলাকায় পরিচিত হয়ে উঠেছেন তিনি।
হুমায়ুন জানান, কালনা, মেমারি, নবদ্বীপ, শান্তিপুর-সহ বিভিন্ন এলাকা ফোন আসে। যাঁরা রক্ত দিতে ইচ্ছুক নিজের খাতায় তাঁদের নাম, রক্তের গ্রুপ ও যোগাযোগ নম্বর লিখে রাখেন তিনি। খোঁজ এলেই রাস্তার পাশে টোটো দাঁড় করিয়ে ডোনারদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তার পরে তাঁদের টোটোয় নিয়ে সোজা চলে যান হাসপাতালে। অনেকে আবার সরাসরিও পৌঁছন সেখানে।
সোমবারও হুমায়ুন দুই রক্তদাতা সুদীপকুমার দাস এবং আরিফ হোসেন খানকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হন কালনা মহকুমা হাসপাতালে। তিনি জানান, ধাত্রীগ্রামের বাসিন্দা সুদীপ এক প্রসূতিকে রক্ত দেন। আর গোয়ালপাড়ার বাসিন্দা আরিফ রক্ত দেন এক ক্যানসার রোগীকে। রোজা রেখেই রক্ত দিয়েছেন তিনি। সুদীপ ও আরিফ বলেন, “হুমায়ুনদা রক্ত দিতে ডাকলে আর ফেরাতে পারি না। ওর ডাকে আগেও এসেছি।”
হুমায়ুনকে চেনেন এমন অনেকের দাবি, বছর খানেক আগে দুর্ঘটনায় ব্যাপক ভাবে জখম হয় তাঁর বাঁ পা। দীর্ঘ সময় তাঁকে বাড়িতে কাটাতে হয়। চরম অর্থ কষ্টের মধ্যে দিন কাটাতে হয়েছে সেই সময়। কিন্তু অসুস্থ অবস্থাতেও অনেকের রক্তের প্রয়োজন মেটাতে তিনি খুঁজে দিয়েছেন ডোনার। অনেক সময় রাত-বিরাতে ছুটে গিয়েছেন নানা জায়গায়। বহু ক্ষেত্রে যাতায়াতের খরচও তাঁকে করতে হয়েছে নিজের পকেট থেকেই।
নদিয়া জেলার একটি রক্তদাতাদের সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ওসমানগনি খান জানিয়েছেন, “হুমায়ুনকে প্রায় ১০ বছর ধরে চিনি। রক্তের কারণে মানুষ বিপদে পড়লেই উনি মানুষের পাশে দাঁড়ান।” কালনার রক্তদাতাদের সংস্থার তরফে মণীন্দ্রনাথ পান বলেন, “মানুষের জন্য ভাল কাজ করার ইচ্ছা না থাকলে এমন বছরের পর বছর করে যাওয়া কঠিন।”
হুমায়ুন বলেন, “বছর দশেক আগে এলাকার এক প্রসূতির জন্য রক্ত পেতে চরম সমস্যায় পড়েন তাঁর পরিবার। শারীরিক সমস্যার জন্য নিজে রক্ত দিতে পারিনি। তখন থেকেই ডোনার খোঁজা শুরু করি। ধীরে ধীরে যোগাযোগ বাড়ে। এখন বেশির ভাগ সময়েই রক্তদাতা জোগাড় করে দিতে পারি।” কালনা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের সুপার চন্দ্রশেখর মাইতি বলেন, “দুর্ঘটনায় জখম হলেও মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন হুমায়ুন। রক্তের টান পড়লেই রোগীর পরিবারের পাশে থাকতে দেখেছি ওঁকে।”
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)