অনুদান নিয়ে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের মধ্যে দড়ি টানাটানি উচিত নয়, মনে করছেন পূর্ব বর্ধমানের প্রান্তিক চাষিদের অনেকে। তাঁদের দাবি, রাজ্য সরকারের ‘কৃষকবন্ধু’ প্রকল্পের সঙ্গে কেন্দ্রের ‘পিএম কিসান নিধি যোজনা’রও সুযোগ পাওয়া উচিত। তাতে প্রান্তিক চাষিদের চাষে ঝুঁকি অনেকটা কমবে। আবার কিছু চাষি মনে করেন, যে কোনও সরকারের উচিত, ফলনের বিপণনের উপযুক্ত ব্যবস্থা করা। বিপণন ব্যবস্থা লাভজনক হলে, চাষিদের আর সরকারের অনুদানের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না।
শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অভিযোগ করেন, ‘রাজনৈতিক কারণে’ পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ৭০ লক্ষ কৃষকের ‘পিএম-কিসান’ প্রকল্পের টাকা আটকে রাখা হয়েছে। বাংলার ২৩ লক্ষ কৃষক অনলাইনে আবেদন করলেও তাঁদের টাকা রাজ্য সরকার আটকে রেখেছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য এই অভিযোগ ‘অবাস্তব’ বলে দাবি করেন। তৃণমূলের তরফে পাল্টা দাবি, রাজ্য সরকারের ‘কৃষকবন্ধু’ প্রকল্পে ৪৭ লক্ষ চাষি উপকৃত হয়েছেন।
ভাতারের বলগোনার প্রান্তিক চাষি কামরুল শেখ শনিবার দাবি করেন, ‘‘চাষিদের জন্য কোনও সরকার যদি বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেয়, সেগুলি চাষির কাছে পৌঁছনো উচিত।’’ একই কথা মনে করেন মেমারির বিষকোপা গ্রামের মনসা ক্ষেত্রপালও। তাঁর কথায়, ‘‘দু’টি সরকারের প্রকল্পের টাকা হাতে পেলে, চাষের জন্য ভাবনা কম হত। মহাজনের কাছেও হাত পাততে হত না। কিন্তু কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা কী ভাবে পেতে হয়, তা জানি না।’’ কাটোয়ার চাষি সন্তু প্রধানের অভিযোগ, ‘‘অনলাইনে আবেদন করার সুযোগ থাকলেও আমরা তা নিতে পারছি না। ফলে, পিএম কিসান প্রকল্প থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি।’’
চাষিরা জানান, রাজ্যের ‘কৃষকবন্ধু’ প্রকল্পে সাহায্য মেলে। তবে তাতে বিশেষ লাভ হয় না বলে প্রান্তিক চাষিদের একাংশের দাবি। কালনার কোম্পানিডাঙার কালাম মোল্লার কথায়, ‘‘বছরে দু’বার এক হাজার টাকা করে পাওয়া যায়। তাতে খুব বেশি লাভ হয় না। সরকারের উচিত, বড় চাষিদের দিকে না তাকিয়ে প্রান্তিক চাষিদের আরও বেশি সাহায্যের ব্যবস্থা করা। তাতে নিশ্চিন্তে চাষ করা যাবে।’’ প্রায় একই বক্তব্য মন্তেশ্বরের বিপদ হাজরার। তাঁর কথায়, ‘‘রাজ্যের সঙ্গে কেন্দ্রের প্রকল্পের টাকা যোগ হলে, আমাদের মতো ছোট চাষিদের ভাবনা অনেকটাই কেটে যাবে।’’
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ‘কৃষকবন্ধু’ প্রকল্পে সর্বোচ্চ মেলে পাঁচ হাজার টাকা। যাঁদের এক একর বা তার বেশি জমি, তাঁরা দু’দফায় ওই টাকা পান। তার কম জমি থাকলে, দু’দফায় এক হাজার করে মোট দু’হাজার টাকা মেলে। জেলা কৃষি দফতর সূত্রে জানা যায়, পূর্ব বর্ধমানে আড়াই লক্ষ চাষি ‘কৃষকবন্ধু’ প্রকল্পের আওতায় এসেছেন। কোনও চাষি কর্মরত অবস্থায় (১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সে) মারা গেলে ওই প্রকল্পে দু’লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়ে থাকেন। কৃষি-কর্তাদের দাবি, জেলার ৩৪২ জন চাষির পরিবার সেই টাকা পেয়েছেন।
চাষিদের একাংশের আবার মত, উৎপাদিত ফসল বিপণনের ব্যবস্থা করতে পারলে, সরকারের অনুদানের উপরে তাঁদের নির্ভরশীল থাকতে হবে না। খণ্ডঘোষের শক্তি মণ্ডল, কালনার শেখ আবু কালামদের অভিযোগ, ‘‘সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে গিয়ে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। আর্দ্র বলে অনেকটা করে ধান বাদ দেওয়া হয়। সরকারের গড়িমসির জন্য কম দামে ধান বিক্রি করে দিতে হয়। আবার, আলুর বীজ অনেক বেশি দামে কিনে চাষ করতে হচ্ছে।’’ মন্তেশ্বরের চাষি বিপদ হাজরা, জামালপুরের শান্তি মালদের কথায়, ‘‘সরকারি অনুদান সাহায্য হলেও পেট ভরায় না। তাই সরকারের উচিত, লাভজনক দামে উৎপাদিত ফসল বিক্রির ব্যবস্থা করা।’’
কৃষকদের জন্য সরকারি সাহায্য নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে তরজা শুরু হয়েছে। বিজেপির দাবি, চাষিদের লাভের বিষয়ে তৃণমূলের সরকার উদাসীন। সে কারণেই কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা আটকে রাখা হচ্ছে। দলের কিসান মোর্চার জেলা (বর্ধমান সদর) সাংগঠনিক সভাপতি দেবাশিস সরকারের অভিযোগ, ‘‘ওই প্রকল্পে রাজ্য সরকার চাষিদের তালিকা পাঠাতে পারে, অথবা চাষি ব্যক্তিগত ভাবে অনলাইনে আবেদন করতে পারেন। এ রাজ্যে দু’টি ক্ষেত্রেই চাষি বঞ্চিত হচ্ছেন।’’ বামপন্থী কৃষক সংগঠন কৃষকসভার জেলা সম্পাদক সৈয়দ মহম্মদ হোসেনের দাবি, ‘‘ধানের দাম নেই, আলুর বীজ অনেক বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। সরকারি প্রকল্পের সুফল চাষির ঘরে পৌঁছচ্ছে না। রাজ্য ও কেন্দ্র, দু’টি সরকারের বিরুদ্ধেই ক্ষোভ বাড়ছে। তার অভিমুখ ঘোরাতে চাইছে দুই সরকারই।’’ তৃণমূলের কৃষক ও খেতমজুর সংগঠনের জেলা সভাপতি তথা কেতুগ্রামের বিধায়ক শেখ সাহানেওয়াজের পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘দলমত নির্বিশেষে কৃষকবন্ধুর সুবিধা মানুষ পাচ্ছেন। ভাগচাষিদেরও ওই সুবিধা দেওয়ার কথা ভেবেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মৃত্যুর পরে, পরিবারের এককালীন দু’লক্ষ টাকা পাওয়ার সুবিধা রয়েছে। এ সব সুযোগ কেন্দ্রের প্রকল্পে রয়েছে কি?’’
জেলা প্রশাসনের দাবি, ‘দুয়ারে সরকার’ কর্মসূচিতে জেলায় ১৯,১৪৪টি ‘কৃষকবন্ধু’র আবেদন জমা পড়েছে। তার মধ্যে প্রায় ১৯ হাজার আবেদন মঞ্জুরও হয়ে গিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy