জিনিস গুছোতে ব্যস্ত পরেশবাবু। —নিজস্ব চিত্র।
সবে ভোর হয়েছে। বেস ক্যাম্পে তখনও ঘুম ভাঙেনি অভিযাত্রীদের। হঠাৎ গুম গুম আওয়াজ। বরফের পাহাড়ে ধাক্কা খেতে খেতে ক্রমশ মিলিয়ে গেল শব্দটা।
ওই দিন, ১৮ই এপ্রিল আরও পাঁচ অভিযাত্রীর সঙ্গে সমুদ্রতল থেকে প্রায় ১৭ হাজার ফুট উচ্চতায় বরফ মোড়া বেস ক্যাম্পে শুয়েছিলেন পরেশচন্দ্র নাথ। বিকট ধস নামার শব্দ শুনতে পেলেও খুব একটা গা করেননি তাঁরা। রোজই তো হয়। কিন্তু ঘণ্টাখানেক পরেই খবর আসে, ধসে চাপা পড়ে মারা গিয়েছেন ১৬ জন শেরপা। পরেশবাবুর এভারেস্ট জয়ের স্বপ্নও বরফ চাপা পড়ে।
এরপরের কয়েক ঘণ্টা একের পর এক ঘটনা। এক দিকে বরফ সরিয়ে উদ্ধারকারী দল একের পর এক দেহ বের করে আনছে, অন্য দিকে উদ্ধার কাজে গতি নেই, ক্ষতিপূরণ চাই দাবি তুলে কাজ করবেন না বলে জানিয়ে দিচ্ছেন অন্য শেরপারা। শেষ পর্যন্ত ২৪ এপ্রিল নেপাল সরকারের এক মন্ত্রী হেলিকপ্টারে করে বেস ক্যাম্পে এসে জানিয়ে গেলেন, অভিযানের জন্য জমা দেওয়া রয়্যালটির মেয়াদ বজায় থাকবে ৫ বছর। এই সময়ের মধ্যে অভিযান করলে আর রয়্যালটি জমা দেওয়ার দরকার হবে না। সে দিনই পাততাড়ি গুটোনো শুরু হয়ে গিয়েছিল বেস ক্যাম্পে। দিন পাঁচেক পরে পরেশবাবুরা পৌঁছেও যান পাহাড় ঘেরা লুকলা এয়ারপোর্টে। কিন্তু আবহাওয়ার দুর্যোগ, ছোট প্লেনের সীমিত আসন সংখ্যানানা কারণে অপেক্ষা করতে হয় আরও কয়েকদিন। অবশেষে প্রায় এক মাস পরে বুধবার রাতে দুর্গাপুরের বাড়িতে পৌঁছন পরেশবাবু।
যাওয়ার সময় এভারেস্ট চূড়ায় পা দেওয়ার স্বপ্নে ট্রেনে রক্সৌল, সেখান থেকে নেপাল সীমান্ত পেরিয়ে বীরগঞ্জ, তারপর ৫ ঘণ্টা ট্রেকারে কাটিয়ে কাঠমান্ডু এয়ারপোর্ট, তারপর প্লেনে লুকলা, পায়ে হেঁটে চড়াই-উতরাইকী ভাবে দিন কেটেছিল বুঝতেই পারেন নি। কিন্তু ফেরার পথটা যেন বড্ড দূর। পরেশবাবু জানান, ফাকটিং, নামচে বাজার পেরিয়ে ৯ দিনের মাথায় তাঁরা পৌঁছন বেস ক্যাম্পে। আটদিন ছিলেন সেখানে। বেস ক্যাম্প থেকে আরও চার ঘন্টার হাঁটা পথ পেরিয়ে যেখানে পৌঁছনো যায়, সেখানেই সে দিন ধস নেমেছিল। শেরপারা গিয়েছিলেন তাঁবু তৈরির সরঞ্জাম ও অন্যান্য কিছু সামগ্রী রেখে আসতে। আর ফেরেননি তাঁরা। পরেশবাবু বলেন, “বেস ক্যাম্প থেকে পুরো এলাকাটা দেখা যাচ্ছিল। এমন ধস দিনে একাধিক নামে। তাই প্রথমে গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু খবর শুনে চমকে উঠি।”
পেশায় দর্জি, বছর পঞ্চাশেকের পরেশবাবু দুর্গাপুরের ইস্পাত নগরীর বি-জোনের শরৎ চন্দ্র অ্যাভিনিউয়ে থাকেন। আদি বাড়ি দুমকায়। দাদার চাকরি সূত্রে এসেছিলেন এ শহরে। ১২ বছর বয়সে দুর্গাপুজোয় বাজি ফাটাতে গিয়ে বাঁ হাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কব্জি থেকে হাতটাই কেটে বাদ দিতে হয়। পরে চণ্ডীদাস বাজারে দোকান খোলেন। পরিচয় হয় এক পর্বতারোহী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত সরোজ দের সঙ্গে। মাথায় নেশা চাপে পাহাড়ে চড়ার। জম্মু কাশ্মীরের জওহর ইনস্টিটিউট অফ মাউন্টেনিয়ারিং, দার্জিলিংয়ের হিমালয়ান ইনস্টিটিউট অফ মাউন্টেনিয়ারিং থেকে একাধিক কোর্স সেরে প্রথম অভিযান করেন ১৯৮৯ সালে। এক হাত নিয়েই হিমাচল প্রদেশের সিটিধর (উচ্চতা ৫২৯৪ মিটার), গাড়োয়াল হিমালয়ের থালু (৬০০০ মিটার) ও কোটেশ্বর (৬০৩৫ মিটার), হিমালয়ের গঙ্গোত্রী ২ (৬৫৯০ মিটার), চন্দ্র প্রভাত (৬৭২৮ মিটার), কেদার ডোম (৬৮৩০ মিটার) পেরিয়ে যান। তারপরেই সমস্ত প্রতিবন্ধকতা পিছনে ফেলে স্থির করেন, এ বার এভারেস্ট।
কিন্তু খরচ মাথা পিছু প্রায় ১৮ লক্ষ টাকা। দিনরাত ঘুরে সরকারি, বেসরকারি স্তরে সাহায্যের আবেদন করেন। অনুদানও পান। কিন্তু মাঝপথ থেকেই ফিরতে হয় এ যাত্রায়।
পরেশবাবু জানান, বেসক্যাম্প থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে ২৬ হাজার ফুট উচ্চতায় চতুর্থ ক্যাম্প। তারপর ‘ডেঞ্জার জোন’। টানা ১২ থেকে ১৪ ঘন্টা হেঁটে ২৯ হাজার ২৮ ফুট উচ্চতার শৃঙ্গে উঠে আবার দ্রুত ফিরে আসতে হয় চতুুর্থ ক্যাম্পে। রোদ উঠে গেলে ধসের ভয় বেড়ে যায়। তাই সন্ধ্যায় যাত্রা শুরু করতে হয়। তুষার ঝড়ের সম্ভাবনা প্রতি পদে। তাছাড়া অত উঁচুতে বায়ুচাপ, ঘাম, শ্বাস নিতে সমস্যা তো আছেই। একটু বেচাল হলেই বিপদ। “তবে এ যাত্রায় আর সে সব হল না। দেখা যাক কত দিনে হয়!” বাড়ি ফিরে জিনিস গুছোতে গুছোতে বললেন পরেশবাবু।
পর্বতারোহী সংগঠন ‘দুর্গাপুর মাউন্টেনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের’ সাধারণ সম্পাদক সাগরময় চৌধুরীরও আশ্বাস, “বহু চেষ্টা করে এভারেস্ট অভিযানের সুযোগ ও খরচ জোগাড় করেছিলেন পরেশবাবু। আশা করি দ্রুত তাঁর স্বপ্ন সফল হবে।”
সেই বিশ্বাসই এখন মূলধন পরেশবাবুর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy