‘চাঁদনি বার’-এর তব্বুর মতো এমন শাড়ি পরে সাধারণত দেখা যায় না বাস্তবের নর্তকীদের। ছবি: সংগৃহীত।
দৃশ্য এক: অষ্টমীর সন্ধ্যায় যাঁর পরনে ছিল সাদা খোলের উপর সোনালি প্রিন্টের গরদের শাড়ি আর কনুই পর্যন্ত লাল ব্লাউজ়, নবমীতে সেই তিনিই ঝকমকে আকাশি পোশাকে।
দৃশ্য দুই: যিনি ভরা অষ্টমীতে ছিলেন লাল শিফন শাড়ি আর কালো স্লিভলেস ব্লাউজ়ে, নবমী পড়তেই তিনি ফিরে গেলেন ডেনিম হট প্যান্ট আর এমন একটি টপে, যাতে শরীরের বিভঙ্গ দেখা যায়।
দৃশ্য তিন: হলুদ খোলের উপর কালো চৌকো প্রিন্টের শাড়ি আর থ্রি কোয়ার্টার ব্লাউজ় পরেছিলেন অষ্টমী তিথিতে। নবমীতে তাঁর আবার স্বল্পবাস।
তিনটি দৃশ্যই হুগলির তিনটি পানশালার। কোনওটি ডানকুনি, কোনওটি বৈদ্যবাটি আবার কোনওটি শ্রীরামপুরের। শুধু এই তিনটি নয়, ডানকুনি থেকে সুগন্ধা মোড় পর্যন্ত দিল্লি রোডের ধারের অসংখ্য ডান্সবারে অষ্টমীতে নর্তকীদের অধিকাংশই ছিলেন শাড়ি পরিহিতা। স্বল্পবসনা কেউ কেউ যে ছিলেন না এমন নয়, কিন্তু সুরাপায়ীদের নোট উড়েছে শাড়ি পরিহিতাদের জন্যই। নিয়মিত পানশালা-অতিথিরা অনেকেই বলছেন, অষ্টমীতে এমন পোশাক এর আগে কখনও দেখেননি।
পরিস্থিতি দেখে শ্রীরামপুরের এক পানশালার মালিক রসিকতা করে বললেন, ‘‘দুর্গা অষ্টমী দেখার পর আমি ভাবছি, মেয়েদের বলব সরস্বতী পুজোয় বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে আসতে!’’
কয়েক বছর আগে এক শাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থা তাদের বিজ্ঞাপনী লাইন হিসেবে ব্যবহার করেছিল— ‘এই আমাদের শাড়ি আর এই আমাদের নারী’। যুগ যুগ ধরে নারীদের অঙ্গের বাস হিসেবে শাড়িই সর্বাধিক প্রচলিত হয়ে থেকেছে। এমনকি, জনপ্রিয় ধারণা হল, শাড়িতে নারীদের অনেক বেশি মোহময়ী লাগে। শাড়িতে শরীরী বিভঙ্গও অনেক বেশি দৃষ্টিনন্দন হয়। বস্তুত, মধুর ভান্ডারকরের ‘চাঁদনি বার’ ছবিতে তব্বু এক বার নর্তকীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। সেখানেও ডান্স বারে তাঁর পরিধেয় ছিল শাড়ি। সেই চরিত্রে অভিনয়ের জন্য তব্বু সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন।
তবে সাধারণ ভাবে ডান্স বারে নর্তকীরা শাড়ি পরেন না। তাঁরা বিবিধ স্বল্পবাসে পারফর্ম করে থাকেন। সেই কারণেই অষ্টমীতে শাড়ি পরে নৃত্য পরিবেশন সকলের নজর কেড়েছে। শাড়ি পরিহিতাদের জন্য নোটও উড়েছে দেদার।
শ্রীরামপুরের বাসিন্দা কল্পনা (নাম পরিবর্তিত) গত আট বছর ধরে বার ডান্সার হিসাবে নিজের জীবিকা নির্বাহ করেন। কাজ করেছেন ভিন্ রাজ্যেও। কোভিডের জন্য আড়াই বছর কেটেছে দুর্বিষহ। তিনি অষ্টমীতে গরদের শাড়ি পরে ফ্লোর মাতিয়েছেন। আবার নবমীতে ফিরে গিয়েছেন ঝকমকে স্বল্প পোশাকে। প্রতি বারই কি অষ্টমী মানেই শাড়ি? তাঁর জবাব, ‘‘না। এ বারই ঠিক করেছিলাম।’’ শুধু তো তাঁর পানশালা নয়। আশপাশের সমস্ত পানশালাতেই অষ্টমীতে তাঁদের মতো নর্তকীদের শাড়িতে দেখা গিয়েছে। এটা কি কাকতালীয়? পানশালার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে নবমী নিশিতে কল্পনা বললেন, ‘‘হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপে কথা বলেই আমরা এটা ঠিক করেছিলাম। কিন্তু তার আগে মালিকদের অনুমতি নিতে হয়েছিল। অনেকেই রাজি হয়েছিলেন।’’
কিন্তু হঠাৎ শাড়ির কারণ কী? অষ্টমী মানে মেয়েদের শাড়ি আর ছেলেদের পাজামা-পাঞ্জাবির একটা অলিখিত রেওয়াজ রয়েছে। সেই কারণেই? কল্পনা জানাচ্ছেন, সেটিই এক এবং একমাত্র কারণ। সেই সঙ্গে তিনি এ-ও জানালেন, অষ্টমীতে সুরাপায়ীদেরও অনেকে পানশালায় পাজামা-পাঞ্জাবি পরেই এসেছিলেন।
দিল্লি রোডের ধারে বৈদ্যবাটিতে একটি নামকরা পানশালা রয়েছে। আগে সেখানে নর্তকীরা নাচলেও মাঝে আইনি জটিলতায় সেটি বন্ধ ছিল। কয়েক মাস আগে সেই জটিলতা কেটেছে। ২০২১ এবং ২০২২ সালের পুজোয় পানশালাটি কার্যত মাছি তাড়িয়েছিল। এবার সেখানেই ‘সাত সমুন্দর’। ঘটনাচক্রে, ওই পানশালাটির সঙ্গে এক সময়ে যোগ ছিল হুগলি তথা কলকাতা লাগোয়া শিল্পাঞ্চলের এক বড় ডাকাবুকো যুবকের। যিনি পুলিশের খাতায় ‘মাফিয়া’ বলে পরিচিত ছিলেন। যাঁকে খুন করে ওই পানশালার দেড় কিলোমিটার দূরে একটি খালে ফেলে দেওয়া হচ্ছিল। তাঁকে নিয়ে সিনেমাও তৈরি হচ্ছে। পরিচালনায় মন্ত্রী ব্রাত্য বসু।
সেই পানশালার দীর্ঘ দিনের এক কর্মী বললেন, ‘‘অনেকেই মাঝে মাঝে শাড়ি পরে আসেন। কিন্তু তা কখনও একই দিনে এবং এক সঙ্গে নয়। এ বার অষ্টমীতেই সেটা দেখলাম।’’ নিয়মিত ওই পানশালায় যেতে অভ্যস্ত পেশায় ব্যবসায়ী এক সুরাপায়ীর সামনে ওই কর্মী বলেই ফেললেন, ‘‘আমি তো ওদের (নর্তকীদের) বলছিলাম, তোমরা কী করছ! এখানে লোকে অঞ্জলি দিতে আসবে না! মদ খেতে আসবে। ওরা বলেছিল, দেখো কী হয়। আমি সত্যিই অবাক।’’
পানশালায় টাকা ওড়ানোর বন্দোবস্ত রয়েছে। অনেকেই দু’টি বা চারটি ৫০০ টাকার নোট দিয়ে খুচরো করে দিতে বলেন। কখনও তা হয় ৫০-এর নোটে। কখনও ১০০। অনেকে আবার ১০ টাকার নোটও চান। যিনি যেমন চাইবেন, তিনি তেমন পাবেন। এই কাজটা যাঁরা করেন, তাঁদের বলা হয় ‘ডিলিং স্টাফ’। ডানকুনির একটি পানশালার এক ‘ডিলিং স্টাফ’ স্পষ্ট বললেন, ‘‘অষ্টমীতে শাড়িতেই কমিশন পেয়েছি বেশি। রিষড়ার এক ব্যবসাযী একাই ৩০ হাজার টাকার খুচরো করেছেন। সব উড়িয়েছেন শাড়ির পিছনে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy