বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের স্মৃতিচারণায় বংশগোপাল চৌধুরী। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
আমার বয়স যখন ২৫-২৬, তখন থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে চিনতাম। বিধানসভায় তিনিই ছিলেন আমার পথপ্রদর্শক। প্রথম যখন মন্ত্রী হয়েছিলাম, তখন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছিলেন, ‘‘বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তোমাকে গাইড করবে।’’ আজীবন গাইড করে গিয়েছেন। ওঁর শূন্যস্থান পূরণ হওয়ার নয়।
২৬ বছর বয়সে প্রথম বার বিধায়ক হয়ে বিধানসভায় গিয়েছিলাম। তখন বুদ্ধবাবু আমার পথপ্রদর্শক। পাঁচ বছর পরে ১৯৯১ সালে মন্ত্রী হয়েছিলাম। সেই সময় মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ডেকে কথাটা বলেছিলেন। সেই সময় একটি নতুন দফতর তৈরি হয়। সেই কারিগরি শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ দফতরের মন্ত্রী করা হয় আমাকে। পশ্চিমবঙ্গে পলিটেকনিক কলেজের জন্য ওই দফতর তৈরি করা হয়েছিল। তখন রাজ্যে একের পর এক কলেজ করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাঙ্কের প্রকল্পের সাহায্য নিয়ে তৈরি করা হয়েছিল সেই সব কলেজ। কলকাতার টেকনিক্যাল স্কুলের উদ্বোধন করেন জ্যোতিবাবু। সেটি প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান।
প্রাক্তন মন্ত্রী বিদ্যুৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর জ্যোতিবাবু এবং বুদ্ধবাবু আমায় শিল্প এবং বাণিজ্য দফতরের দায়িত্ব দেন। সেই সময় সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় ডব্লুবিআইডিসি (ওয়েস্ট বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন)-র চেয়ারম্যান ছিলেন। জ্যোতিবাবু, বুদ্ধবাবুর উপস্থিতিতে ঠিক হয় দুর্গাপুরে শিল্প সম্মেলন হবে। আমি তখন শিল্প দফতরের মন্ত্রী। সেই সম্মেলনের পর থেকে দুর্গাপুরে কাজের গতি শুরু হয়, বহু শিল্প এনে দেয়। দুর্গাপুর-সহ ওই এলাকায় বহু কারখানা হয়। এই গোটা বিষয়ে গাইড করে গিয়েছেন বুদ্ধবাবু। ক্রমে পশ্চিমবঙ্গে অনেক কলকারখানা হয়। তখন হুগলি জেলায় একটা বড় কারখানা হয়— ইলেকট্রিকের তার তৈরি করত তারা। এই কলকারখানা তৈরির নেপথ্যেও বুদ্ধবাবু। গাইড করে যেতেন। চেম্বার অফ কমার্সের প্রত্যেকটি বৈঠকে উপস্থিত থাকতেন। জ্যোতি বসু থাকলেও থাকতেন, না থাকলেও বুদ্ধবাবু ঠিক থাকতেন।
রাজ্যে শিল্পের উন্নয়নের দিকে সব সময় নজর ছিল বুদ্ধবাবুর। যখন হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যাল তৈরির কাজ এগোচ্ছিল, সেই সময় আলাদা ভাবে তার দায়িত্ব নেন তিনি। সেই সময়েই কলকাতায় চর্মশিল্পের নগরী তৈরি করেন তিনি। আমাকে তখন ওই চর্ম শিল্পনগরীর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেন। তবে নিজে বরাবর পাশে থেকে গাইড করতেন। পরবর্তী কালে চর্মশিল্পের ক্ষেত্রে নতুন দিক উন্মোচিত হয়। হলদিয়াতে মিৎসুবিসি কারখানা হয়। পরবর্তী কালে আরও একটি কারখানার উদ্বোধন করতে হলদি নদী পেরিয়ে লঞ্চে করে এসেছিলেন বুদ্ধদেববাবু। এখনও স্পষ্ট মনে আছে আমার। সঙ্গে ছিলেন বুদ্ধদেববাবুর সন্তান। ওই কারখানা উদ্বোধন করেই বিকেলের মধ্যে ফিরে যান তিনি।
বার্নপুরে ইসকো (আইআইএসসিও) কারখানা সম্প্রসারণের জন্য একটি কমিটি গঠন হয়। তার চেয়ারম্যান করা হয় আমাকে। পরে বুদ্ধবাবুকে নিয়ে এই সম্প্রসারণের জন্য একটি সভা হয়েছিল। যাঁদের জমি গিয়েছিল, তাঁদের নিয়ে সমস্যার সমাধানও করা হয়েছিল। পরে এই এলাকায় ধস এবং মিথেন গ্যাস থেকে আগুন লাগার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট একটি নির্দেশ দেয়। শীর্ষ আদালতে মামলাটি করেছিলেন সিএমএসের সাধারণ সম্পাদক তথা বামফ্রন্টের প্রাক্তন সাংসদ হারাধন রায়। ওই মামলার ভিত্তিতে রায় দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। তখন কোল ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান ছিলেন পার্থ ভট্টাচার্য। সুপ্রিম কোর্টের রায়দানের পর পার্থবাবুকে নিয়ে প্রথম বৈঠক হয় বুদ্ধবাবুর ঘরে। তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলে ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দ করিয়েছিলেন বুদ্ধবাবু। পুনর্বাসনের সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছিল। যদিও ৫২ কোটি টাকা ২০১১ সালের পরে এসেছিল এই রাজ্যে।
অন্য দিকে, বার্নপুরে ইসকো কারখানা সম্প্রসারণের কাজ জমিজটে আটকে গিয়েছিল। সে দিন অনেকে বাধাও দিয়েছিলেন, সে ছিল চরম বাধা। আজ তাঁদের নাম বলব না। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পরামর্শে আমি সেই বাধাবিপত্তি কাটিয়ে উঠেছিলাম। তৎকালীন অবিভক্ত বর্ধমানের জেলাশাসক-সহ সকলকে সঙ্গে নিয়েই এই সমস্যা কাটিয়ে উঠেছিলাম। তখন কেন্দ্রে ছিল ইউপিএ সরকার। এই সরকারের কাছে আমাদের দাবি ছিল, ইসকোর আধুনিকীকরণ, সম্প্রসারণ করতে হবে। এবং অবশ্যই তা নিজেদের হাতে রাখতে হবে, অর্থাৎ, ইসকো বেসরকারি হাতে গেলে চলবে না। আজ ভালই চলছে ইসকো।
রানিগঞ্জে বেঙ্গল পেপার মিলের উদ্বোধন করেছিলেন বুদ্ধবাবু। তিনি না থাকলে বেঙ্গল পেপার মিল হাই কোর্ট থেকে বেরিয়ে আসত না। তৎকালীন অ্যাডভোকেট জেনারেলকে বুদ্ধবাবু বলেছিলেন, ‘‘আপনি বলুন, যাঁরা চালাবে তাঁদের কারখানা দিতে হবে।’’ আসানসোল, দুর্গাপুরে একের পর এক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, হলদিয়ায় পলিটেকনিক কলেজ, শিলিগুড়িতে মহিলা পলিটেকনিক কলেজ, সবেরই নেপথ্যে ছিলেন বুদ্ধবাবু। মণিকাঞ্চন যখন উদ্বোধন হয়, তখন আমি শিল্পমন্ত্রী। জ্যোতি বসু এবং সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে উদ্বোধন হয়। আমার মনে আছে, তখন বুদ্ধবাবু বলেছিলেন, ‘‘ইনফোসিস এখানে আসছেই।’’ কিন্তু পরবর্তী কালে নানা ঘটনার কারণে তারা আর পশ্চিমবঙ্গে আসতে চায়নি। ২০১১ সালের পরে এক বার মাইসুরু গেছিলাম। তখন আমি সাংসদ। ইনফোসিস জানিয়েছিল, তারা আসছে না।
বুদ্ধবাবু সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ ছিলেন। রবীন্দ্র ভবন, রবীন্দ্র সদন, কলকাতার সৌন্দর্যায়ন, সব জায়গায় ওঁর ছাপ ছিল। শিল্প কলকারখানার পাশাপাশি সংস্কৃতিকেও অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ যাঁকে হারাল, সেই শূন্যস্থান পূরণ হওয়ার কেউ নেই। জ্যোতিবাবুর মতো তিনিও ইতিহাসে থেকে গেলেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy