ফাইল চিত্র।
শোভনের ঘর ওয়াপসির জল্পনা দাবানলের মতো ছড়াতে শুরু করেছিল বৈশাখী নবান্নে পা রাখতেই। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক সেরে বেরনোর পরে সে জল্পনা নস্যাৎ করলেন বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়। আর রাত পর্যন্ত ওই বৈঠকের বিষয়ে মমতা নিজে বা তাঁর দল কোনও মন্তব্য করল না। তৃণমূলের সঙ্গে শোভনের দূরত্ব কমার মতো কোনও পরিস্থিতিই তৈরি হয়নি, খবর শোভন চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রের।
বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টা নাগাদ নবান্নে পৌঁছন বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে কলকাতার প্রাক্তন মেয়র তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে জল্পনা যে ভাবে বেড়েছে রাজনৈতিক শিবিরে, তাতে শোভনের নানা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের শরিক বৈশাখী সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী সমীপে হাজির হওয়ায় চাঞ্চল্য তৈরি হয় তৃণমূল এবং বিজেপি দু’দলেই। পরে জানা গেল যে, কলকাতার প্রাক্তন মেয়রের ঘর ওয়াপসির কোনও সম্ভাবনা এই বৈঠকে তৈরি হয়নি।
২০১৮ সালের শেষ দিক থেকেই তৃণমূলের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করতে শুরু করেছিলেন শোভন চট্টোপাধ্যায়। রাজ্যের মন্ত্রিত্বে নিজে থেকেই ইস্তফা দিয়েছিলেন। এর পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে কলকাতার মেয়র পদও ছেড়ে দিতে বলেন। শোভন সে নির্দেশ মেনে ইস্তফা দিয়ে দেন। পরে ২০১৯-এর ১৪ অগস্ট বিজেপিতে যোগও দিয়েছেন তিনি। কিন্তু বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বের একাংশের সঙ্গে মনোমালিন্যের কারণে তিনি রাজনীতিতে এখনও সক্রিয় হননি। সক্রিয় হতে পারেন বলে গুঞ্জন শুরু হয়েছিল রবিবার থেকে। ফলে তৎপর হয়ে ওঠে তৃণমূল। মঙ্গলবারই নিজের বাড়িতে বৈশাখীর সঙ্গে বৈঠক করেন তৃণমূল মহাসচিব তথা রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। সে বৈঠকে যে বরফ গলেনি, বৈশাখীর নানা মন্তব্যে তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তার পরে এ দিন বৈশাখী নবান্নে যাওয়ায় রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, বরফ গলাতে এ বার সক্রিয় হয়েছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল চেয়ারপার্সন। কিন্তু সাক্ষাৎ পর্ব নিয়ে তৃণমূলের নীরবতা এবং শোভন শিবিরের নিস্পৃহ প্রতিক্রিয়া বুঝিয়ে দিয়েছে যে, সম্পর্কের উষ্ণতা ফিরে আসার মতো কোনও পরিস্থিতি এ দিনের বৈঠকে তৈরি হয়নি।
আরও পড়ুন: হঠাৎ নবান্নে বৈশাখী, শোভনের মান ভাঙাতে এ বার কি সক্রিয় মমতা?
বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন আনন্দবাজারকে বলেছেন, ‘‘আমি তৃণমূল চেয়ারপার্সনের সঙ্গে দেখা করতে যাইনি। তা যদি যেতাম, তা হলে তাঁর বাড়িতে বা তৃণমূলের কার্যালয়ে যেতাম। আমি গিয়েছিলাম নবান্নে, সেটা রাজ্য সরকারের সচিবালয়। সেখানে আমি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেই দেখা করতে গিয়েছিলাম।’’ কী কারণে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে হঠাৎ এই সাক্ষাতের প্রয়োজন হল? বৈশাখী বলেন, ‘‘প্রয়োজন হঠাৎ হয়নি। অনেক দিন ধরেই প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছিল। আমি যে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষা, সেখানে দীর্ঘ দিন ধরে অচলাবস্থা রয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী সে সমস্যার সমাধান করতে পারেননি। তাই মুখ্যমন্ত্রীর কাছে গিয়ে জানিয়ে এলাম।’’ সমস্যার সমাধান কি হল? মিল্লি আল আমিন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষার জবাব, ‘‘সমস্যার কথা মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়ে এসেছি। এই বৈঠকটা খুব জরুরি ছিল। আমার কলেজের সহকর্মীরা অনেকটা আশ্বস্ত হয়েছেন।’’
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে বৈশাখীর প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়া যা-ই হোক, শোভন চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বৃত্ত কিন্তু দাবি করছে, কোনও বিষয়েই আশ্বস্ত হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি। বরং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাক্ষাতের পরেও শোভনের পাল্লা বিজেপির দিকেই ঝুঁকে রয়েছে।
আরও পড়ুন: বজবজে ডুবে যাওয়া বার্জের ফ্লাই অ্যাশ থেকে গঙ্গা দূষণের আশঙ্কা
তৃণমূলের সর্বোচ্চ স্তর সচেষ্ট হওয়ার পরেও শোভন বিজেপির দিকে ঝুঁকে কেন? শোভনের ঘনিষ্ঠ বৃত্তের লোকজন বলছেন, কারণ মূলত দু’টি।
প্রথমত, যাঁর সঙ্গে শোভন চট্টোপাধ্যায়ের বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা চলছে, সেই রত্না চট্টোপাধ্যায়ের গুরুত্ব তৃণমূলে ক্রমশ বাড়তে থাকায় শোভন বেশ অসন্তুষ্ট। এ নিয়ে প্রকাশ্যে একাধিক বার মুখ খুলেছেন শোভন। তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বকেও তিনি নিজের অসন্তোষের কথা জানিয়েছিলেন বলে খবর। কিন্তু তাতে লাভ কিছু হয়নি। বেহালা এলাকায় রত্নার গুরুত্ব ক্রমশ বাড়িয়েছে রাজ্যের শাসক দল।
দ্বিতীয়ত, বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি তৃণমূল নেতৃত্বের মনোভাবকেও শোভন ভাল ভাবে নিচ্ছেন না বলে খবর। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নিয়ে তৃণমূলের যে সংগঠন রয়েছে, বৈশাখী এক সময়ে সেই ওয়েবকুপার অন্যতম শীর্ষ পদাধিকারী ছিলেন। শোভনের সঙ্গে বৈশাখীর সম্পর্কের বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিভিন্ন পরিসরে নিজের বিরক্তি প্রকাশ করতে শুরু করার পরে ওই পদ থেকে বৈশাখীকে সরানো হয়। তার কয়েক মাস পরে শোভন মন্ত্রিত্বে ইস্তফা দিয়ে দেন। শোভনের বক্তব্য ছিল, বৈশাখীকে ওয়েবকুপার শীর্ষপদে তিনি বসাননি। তাই তাঁর সঙ্গে কোনও সম্পর্কের কারণে বা তাঁর প্রতি শীর্ষ নেতৃত্বের কোনও অসন্তোষের কারণে বৈশাখীর উপরে কোপ পড়া উচিত নয়। শোভন এখনও সেই অবস্থানে অনড় বলে তাঁর ঘনিষ্ঠরা জানাচ্ছেন। অর্থাৎ তৃণমূল যদি সত্যিই তাঁকে সসম্মানে ফেরত নিতে চায়, তা হলে সর্বাগ্রে বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্মানজনক পুনর্বাসন জরুরি বলে শোভন মনে করেন। তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বকেও শোভন সে বার্তা একাধিক বার দিয়েছেন বলে তাঁর ঘনিষ্ঠদের দাবি। কিন্তু বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্তও তৃণমূলের তরফে সে রকম কোনও আশ্বাস শোভন শিবিরে পৌঁছয়নি বলে জানা যাচ্ছে।
অন্য দিকে বিজেপি নেতৃত্বের আচরণে শোভন অনেক স্বস্তিতে বলেও জানা যাচ্ছে। কলকাতার পুরভোটে শোভনকে সসম্মানে কাজে লাগানোর কথা বলে বিজেপির নেতারা যে ভাবে বার বার প্রকাশ্য বিবৃতি দিচ্ছেন, শহরের প্রাক্তন মেয়র তাতে খুশি বলেই খবর। রাজ্য নেতৃত্বের যে অংশের সঙ্গে এক সময়ে মনোমালিন্য তৈরি হয়েছিল শোভনের, সেই অংশও সম্প্রতি অত্যন্ত ইতিবাচক আচরণই দেখাচ্ছেন বলে শোভন ঘনিষ্ঠদের দাবি। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও সরাসরি শোভনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। ফলে সম্মানজনক ভাবে রাজনীতি করার প্রশ্নে এই মুহূর্তে বিজেপি-ই শোভনের জন্য অধিকতর ভাল ‘অপশন’— এমন ইঙ্গিতও বৃহস্পতিবার দেওয়া হয়েছে প্রাক্তন মেয়রের ঘনিষ্ঠ মহল থেকে।
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক কী নিয়ে ছিল, সে বিষয়ে বৈশাখীর প্রকাশ্য বিবৃতি যা-ই হোক, রাজনৈতিক আলোচনা ওই বৈঠকে হয়েছে বলেই শোভন শিবির সূত্রের খবর। সেই আলোচনার পরেও তৃণমূল সম্পর্কে যখন বৈশাখীর প্রতিক্রিয়া এত নিস্পৃহ, তখন কি তৃণমূলের সঙ্গে পথ চলা শেষ বলেই ধরে নিতে হবে? বৈশাখী বলেছেন, ‘‘আমি তো আগেও বলেছি, ২০১৮ সালের ৮ মার্চ অর্থাৎ ওয়েবকুপা থেকে আমার অপসারণের দিনই তৃণমূলের সঙ্গে আমার পথ চলা শেষ হয়েছিল। তার পর থেকে তো নতুন করে কোনও পথ চলা শুরুই হয়নি। সুতরাং নতুন করে শেষ হওয়ারও প্রশ্ন নেই।’’
শোভনের তৃণমূলে ফেরার পথে অন্যতম কাঁটা বলে যাঁকে মনে করেন শোভন শিবিরের অনেকেই, সেই রত্না চট্টোপাধ্যায় এ দিনের বৈঠকের পরে মুখ খুলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘আমি তৃণমূলে ছিলাম, আছি এবং থাকব। শোভন চট্টোপাধ্যায় দলে ফিরবেন কি না, তাঁর ব্যাপার। তবে তাঁকে ফেরানোর জন্য আমি তৃণমূল ছেড়ে দেব বা আমাকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাড়িয়ে দেবেন, এটা যদি শোভনবাবু ভেবে থাকেন, তা হলে ভুল করছেন।’’ দলের স্বার্থে ১৩১ নম্বর ওয়ার্ড বা বেহালা পূর্ব বিধানসভা কেন্দ্রের দায়িত্ব তিনি ছেড়ে দিতে প্রস্তুত বলে রত্না এ দিন জানান। তবে তার জন্য শোভনকেও কিছু প্রতিশ্রুতি দিতে হবে বলে রত্না মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘১৩১ নম্বর ওয়ার্ড বা বেহালা পূর্ব বিধানসভা আসনের দায়িত্ব তো আমাকে দল এমনি এমনি দেয়নি। শোভন চট্টোপাধ্যায় দীর্ঘ দিন এখানে আসছিলেন না, নিজের ওয়ার্ডের বা নিজের বিধানসভা আসনের দেখভাল করছিলেন না। অনেক দিন এ ভাবে চলার পরে নানা অভিযোগ পেয়ে দল আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে। এখন যদি শোভন চট্টোপাধ্যায় তৃণমূলে ফেরেন এবং বলেন যে, এই ওয়ার্ড এবং এই বিধানসভা কেন্দ্রের দেখভাল তিনি করতে চান, তা হলে আমি হাসি মুখে সেই দায়িত্ব তাঁকে ফিরিয়ে দিতে তৈরি। কিন্তু কাজটা তাঁকে করতে হবে, ওই ওয়ার্ড বা এই বিধানসভা আসনকে তিনি আর অবহেলা করতে পারবেন না, এই প্রতিশ্রুতিটা দিতে হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy