বলদেব মন্দিরের ভরাট আসরে গাইতে উঠেছেন মনোহরশাহী ঘরানার এই প্রজন্মের অন্যতম কীর্তনীয়া সুমন ভট্টাচার্য। এই ঘরানায় বাদকের ভূমিকাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। কীর্তনের নানা পর্যায়ে নানা রকম তালের ব্যবহার মনোহরশাহীর বিশেষত্ব। একে বলা হয় তাল ফেরতা। এই ধারার কীর্তনের চলন দ্রুত। ধামার, তেওট, দশকুশি, চৌতাল বা রুদ্রতালের মতো কঠিন তালের সঙ্গে চঞ্চুপুট, একতালি, লোফার ব্যবহারে কীর্তন দ্রুতিময়।
আসরের সূচনা হল দুই মৃদঙ্গ বাদকের শ্রীখোলের লহরা দিয়ে। বোলে তুফান তুলে বাদকেরা জানান দিলেন, তাঁরা কোন ঘরানার অনুসারী। কে তাঁদের গুরু, কেমন তাদের ‘তৈয়ারি’ সবই রসিকজন বুঝে নিতে পারেন শুরুর এই পর্বে। কীর্তনের পরিভাষায় একে বলে ‘হাতুটি’। উত্তাল মৃদঙ্গ স্তিমিত হতেই রেওয়াজি কন্ঠে কীর্তনীয়া ধরলেন আলাপ। দেশ রাগের ওই আলাপ গোটা আসরের উপর কেমন এক মায়া বিছিয়ে দিল যেন। শিক্ষিত গুণী শ্রোতামাত্রেই জানেন, প্রাচীন কীর্তনে একে বলা হত ‘আপত্তন’। গাওয়া হত একটি নির্দিষ্ট রাগে। এখন তার বদলে গাওয়া হয় ‘বন্দনা’। কীর্তনের এই আসরে বন্দনা পর্বে সুমন গাইলেন বাসুদেব সার্বভৌম রচিত ‘শ্রীশচীতনয়াষ্টকমের’ সুপরিচিত ‘উজ্জ্বলবরণম গৌরবরদেহম’ পদটি। শ্রোতারা আপ্লুত। বন্দনা পর্বে অনেকে জয়দেবের গীতগোবিন্দ, দশাবতার স্তোত্র বা বাংলা কোন বন্দনাও ব্যবহার করেন। এরপর একে একে রাধাকৃষ্ণ, গৌরাঙ্গ-নিত্যানন্দ, গুরু এবং বৈষ্ণবকে প্রণাম জানানোর পালা।
এই ভাবেই ভাষা ও ভাবের বাধা দূর করেন কীর্তনীয়া। নদীর মতো ছুঁয়ে ছুঁয়ে যান নানা পাড়।
“আজানুলম্বিত ভুজৌ, কনকাবদাতৌ সংকীর্তনৌকো পিতরৌ...” মন্দ্রসপ্তকে এই পদ যখন গাইছেন কীর্তনীয়া আসরে উপস্থিত কয়েক হাজার মানুষের শরীরী ভাষা ততক্ষণে বদলে গিয়েছে। মেরুদন্ড সোজা করে টানটান হয়ে বসে হাতজোড় করে যেন প্রার্থনা মগ্ন। গুরু প্রণামে গায়ক ‘অজ্ঞানতিমিরাঞ্জস্য জ্ঞানাঞ্জন শলাকয়া’ ধরতেই উপস্থিত সব শ্রোতা চোখ বুজে গলা মেলাতে শুরু করলেন। কীর্তনের আসর মুহূর্তে মধ্যে এক বিরাট উপাসনা কক্ষে পরিণত হল।
প্রণাম পর্ব মিটতেই উঠে দাঁড়ালেন গায়ক। দু’হাত জোড় করে সমবেত শ্রোতৃমণ্ডলীর উদ্দেশ্যে প্রণাম জানালেন। ইতিমধ্যে এগিয়ে ফুলের মালা নিয়ে মঞ্চে উপস্থিত হয়েছেন দু’জন। তাঁরা মালাচন্দনে বরণ করে নিলেন কীর্তনীয়াসহ সকলকে। গোটা আসর যেন উৎসুক আছে। কোন পালা গাওয়া হবে আজ, তা এ বার জানাবেন গায়ক। সুমন জানালেন আজ নৌকাবিলাস। গোটা আসর জুড়ে খুশির হিল্লোল ছড়িয়ে গেল।
বেজে উঠল খোল কর্তাল মন্দিরা হারমোনিয়াম। শুরু হল গৌরচন্দ্রিকা। “আরে মোর আরে মোর শ্রীগৌরাঙ্গ রায়, সুরধুনী তীরে যাইয়া, নবীন নাবিক হইয়া সহচর মেলিয়া খেলায়।” নবদ্বীপের গঙ্গার ঘাটে মহপ্রভু আজ নৌকার নাবিক হয়েছেন। তিনি বিনা মূল্যে সকলকে নদী পার করাবেন। এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই দলে দলে লোক ঘাটে ভিড় জমালেন। যাদের প্রয়োজন নেই, বিনে পয়সায় নদী পার হতে তারাও নৌকায় উঠে বসেছে। মাঝ নদীতে গিয়ে নৌকা ডুবু ডুবু। আরোহীরা প্রাণের ভয়ে কৃষ্ণনাম জপছে। “ডুবু ডুবু করে না বহয়ে বিষম বা, দেখে হাসে গোরা বনমালী।” মানুষের বিপদে তাঁকে হাসতে দেখে বিস্মিত চৈতন্যপার্ষদেরা। তাঁরা প্রশ্ন তোলে মানুষকে এই বিপদের মধ্যে তিনিই টেনে এনেছে।
অথচ তিনি হাসছেন?
টলমলে তরীতে তখন “ঘন ঘন হরিবোল, কেহ করে উতরোল।” উত্তরে নাবিক গোরা রায় বলেন ‘হাসবো না? এর আগে কত চেষ্টা করেছি, কত অনুনয় করেছি। কিন্তু এই মানুষগুলো একবারও হরিনাম মুখে আনেনি। আজ তারাই আকুল হয়ে কৃষ্ণ কৃষ্ণ করছে। আর কাউকে কিছু বলতে হচ্ছে না।’ কীর্তনীয়ার ব্যাখ্যা এ ভাবেই মহাপ্রভু মানুষের জীবনের সঙ্গে সংকীর্তনকে মিশিয়ে দিয়েছিলেন। বিষয়টি স্পষ্ট হতেও গোটা আসর যেন উচ্ছাসে ভেসে গেল। সুমন তখন দ্রুত লয়ে গাইছেন “দুকুলে নদিয়ার লোক দেখে, ভুবনমোহন নাইয়া দেখিয়া বিবশ হইয়া, যুবতী ভুলিল লাখে লাখে।” দোহারের দল সমবেত কন্ঠে ‘আখর’ দিলেন “আমরা এমন নাবিক দেখি নাই। জনমিয়ে নবদ্বীপে, যার নাম নিলেই পাড় হওয়া যায়। এমন নাবিক দেখি নাই।”
উলুধ্বনিতে কেঁপে উঠল আসর। জোড়া শ্রীখোলে তখন চোদ্দ মাত্রার দ্রুতির মাতন। কীর্তনের পরিভাষায় একে বলা হয় ‘জামালি’। এর সঙ্গেই শেষ হয় গৌরচন্দ্রিকা পর্ব। দু’হাত উপরে তুলে শ্রোতৃমণ্ডলী সজলনয়নে প্রণাম জানান গৌরাঙ্গদেবকে। তত ক্ষণে কোথা দিয়ে যে ঘণ্টাখানেক পার হয়ে গিয়েছে, তা টেরও পাননি শ্রোতারা।
এ বার শুরু হবে মূল নৌকাবিলাস লীলা। তার আগে ‘সুরমিল’ পর্ব। গৌরচন্দ্রিকা ও মূল কাহিনির মধ্যে সেতুবন্ধের কাজ করে এই সুরমিল। যে কোন একটি রাগের উপর নির্ভর তেওটা তালে অনেকটা ‘তারানার’ ঢঙে ‘রে’ ‘তে’ ‘তায়’ ‘নায়’ জাতীয় কিছু অর্থহীন শব্দ ব্যবহার করে গাওয়া হয়। সুমন ধরলেন রাগ শ্রী। তবে এই শ্রী রাগের সঙ্গে অবশ্য হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শ্রী রাগের মিল নেই। বরং রাগ ভীমপলশ্রীর সঙ্গে তার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তবে ইদানিং বেশির ভাগ কীর্তনিয়া এই পর্বে জমাটি হিন্দি ভজন পরিবেশন করেন।
বলদেব মন্দিরে এদিন সুমন যখন নৌকাবিলাসের প্রথম পদটি ধরলেন তখন ঘড়ির কাঁটা আটটার ঘর ছুঁয়েছে। হাজার তিনেক শ্রোতার ভিড়ে নাটমন্দিরে ছুঁচ ফেলার জায়গা নেই। ‘সখাগণ সঙ্গ ছড়ি যদুনন্দন, চলতহি নাগররাজ’-মায়ূর রাগে বাঁধা গানের মুখড়া ধরতেই মৃদঙ্গ বেজে উঠল তিওট তালে। এরপর এরপর নিটোল এক কাহিনি নির্ভর কীর্তন এগিয়ে চলে আপন গতিতে। চৈতন্যজীবনের সঙ্গে অদ্ভুত ভাবে মিলে যায় কৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলা। সে কথা শুনতে শুনতে আকুল হয়ে শ্রোতারা আকুল হয়ে কাঁদেন। ভালো কীর্তনের আসরে এ ছবি পরিচিত। গৌরলীলা অর্থাৎ চৈতন্যের সন্ন্যাস নেওয়ার আগের জীবনের কথা এবং চৈতন্যলীলা বা সন্ন্যাস নেওয়ার পরের জীবনের কথা শুনতে খুবই পছন্দ করেন ভক্তজন। কৃষ্ণের জীবনকথাও সমান আকর্ষণীয়। দোহা-তুক-ছুট-ঝুমুর-আখর এই পাঁচটি পর্বে সেই কাহিনিগুলিই গেয়ে শোনান কীর্তনীয়া। চণ্ডীদাস, জয়দেব, গোবিন্দদাস, বাসুদেব ঘোষের পদই এখনও বেশি গাওয়া হয়।
সুমন যখন ‘নৌকাবিলাসের’ শেষ পদ গাইছেন ঘড়ির কাঁটা পেরিয়ে গেছে নটার ঘর। শুরুর রাগ ‘মায়ূর’ তখন বদলে গেছে ‘সাহানা কানাড়ায়’। চৈতন্যভূমির এক নাটমন্দিরে অবিরল বয়ে চলেছে যমুনার জল। (চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy