চাকরির খাতিরে বিয়ের প্রায় দেড় মাসের মধ্যেই সুদান যেতে হয়েছিল সুরজিৎ দে-কে। —নিজস্ব চিত্র।
সংঘর্ষ বিরতির মধ্যেই চলত অবিরাম গোলাবর্ষণ। গুলির আওয়াজে সিঁটিয়ে থাকলেও বাড়ির লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল প্রায় অসাধ্য। কারণ, গোটা দেশের মতো তাঁদের হোটেলের ঘরেও চলত লোডশেডিং। ফলে মোবাইলের চার্জ দেওয়া যেত না। হোটেলে থাকলেও এক সময় দেখা দিয়েছিল খাবার, পানীয় জলের সমস্যাও। তবে ভারত সরকারের সহায়তায় জীবন বাজি রেখেই যুদ্ধবিধ্বস্ত সুদান থেকে উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগরে নিজের ঘরে ফিরেছেন সুরজিৎ দে।
চাকরির খাতিরে বিয়ের প্রায় দেড় মাসের মধ্যেই সুদান যেতে হয়েছিল সুরজিৎকে। তবে সেখানে পৌঁছনোর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। ১৫ এপ্রিল থেকে উত্তর আফ্রিকার ওই দেশে ‘সুদান আর্মড ফোর্সেস’ এবং ‘র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস’-এর মধ্যে গৃহযুদ্ধ বেধেছে। মঙ্গলবার থেকে সংঘর্ষ বিরতি শুরু হলেও গোলাগুলি, বোমাবর্ষণ থামেনি।
ভারত সরকারের সাহায্যে ঘরে ফেরার পথে সুদানের সশস্ত্র আধাসেনার নাকাচেকিংয়ের মুখে পড়েছিলেন সুরজিৎ এবং তাঁর সঙ্গীরা। উত্তর ২৪ পরগনা জেলার অশোকনগরের বাড়িতে বসে সেই দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা মনে করে সুরজিৎ শুনিয়েছেন কী ভাবে প্রাণ হাতে করে ঘরে ফিরেছেন। শনিবার তিনি বলেন, ‘‘হোটেল থেকে বেরিয়ে বাসে করে কিছু দূর যাওয়ার পর একটা চেকপয়েন্টে আমাদের নামানো হয়েছিল। সেখানে সকলের (আরএসফ বা সুদানের র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস) হাতে অস্ত্র ছিল। আক্ষরিক অর্থেই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ওদের আরবি ভাষা আমরা বুঝি না। ভয় ছিল, ওরা কিছু বললে বুঝতে পারব না। ভুল বোঝাবুঝিতে আমাদের উপরেই হয়তো গুলি চালিয়ে দিল!’’
অশোকনগর কল্যাণগড়ের বাসিন্দা সুরজিৎ পেশায় সফ্টঅয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। ১ মার্চ সুদানের রাজধানী খার্তুম পৌঁছন। এমটিএন টেলিকম সংস্থায় কাজ করতে সে দেশে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর মতো বহু ভারতীয় সুদানে আটকে পড়েন। সুরজিৎ যে হোটেলে ছিলেন, সেখানে প্রায়শই লোডশেডিং হত। গোড়ায় ১২ দিন এক-দেড় ঘণ্টা করে চালানো হত হোটেলের জেনারেটর। পরে জ্বালানির অভাবে তা-ও বন্ধ রাখা হয়েছিল। এক সময় মোবাইলেও চার্জ দেওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফলে বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না সুরজিৎরা। এক সময় খাবার এবং পানীয় জলের অভাবও দেখা দেয় হোটেলে। সুরজিৎ জানিয়েছেন, সুদানে কয়েক ঘণ্টার জন্য সংঘর্ষ বিরতি ঘোষণা করা হলেও তা মানা হচ্ছিল না। তার মধ্যেই চলত অবিরাম গুলিবর্ষণ। এই আবহে নিজেদের দূতাবাস বন্ধ করে দেয় আমেরিকা-সহ নানা দেশ। এর পরেই মরিয়া হয়ে ওঠেন সুরজিৎ এবং তাঁর সঙ্গীরা। সুদান ছেড়ে পালানোর পথ খুঁজতে থাকেন তাঁরা। নিরাপদে দেশে পৌঁছনোর পরামর্শের জন্য ভারতীয় দূতাবাসের দ্বারস্থ হন। সুরজিৎ জানিয়েছেন, তাদের পরামর্শেই ৪৯ জন মিলে বাস ভাড়া করেন তাঁরা। ভারতীয় মুদ্রায় ১০ লক্ষ টাকারও বেশি অর্থে বাস ভাড়া করেছিলেন। তাতে এক-এক জনের ৩০ হাজার টাকা করে ভাড়া দিতে হয়েছিল।
২৪ এপ্রিল বাসে করে জীবন বাজি রেখে পোর্ট সুদানের উদ্দেশ রওনা হন সুরজিৎ-সহ ৪৯ জন। ১২ ঘণ্টা ভয়াবহ সফরের পর পোর্ট সুদানে পৌঁছন তাঁরা। পথে মাঝেমধ্যেই তাঁদের বাসের তল্লাশি করেছেন আরএসএফের সশস্ত্র জওয়ানরা। সুরজিৎ জানিয়েছেন, আরবি ভাষা ছাড়া কিছুই বোঝেন না ওই জওয়ানেরা।ফলে যে কোনও মুহূর্তে দু’পক্ষের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি থেকে বচসা বাধলেই নিশ্চিত বুলেট চলতে পারত।
পোর্ট সুদান থেকে তাঁদের উড়ানের বন্দোবস্ত করেছিল ভারতীয় দূতাবাস। তার সাহায্যেই সৌদি আরবের জেড্ডায় পৌঁছন তাঁরা সকলে। এর পর ২৬ তারিখ দিল্লি এসে পৌঁছন সুরজিৎরা।
বৃহস্পতিবার দিল্লি থেকে দমদম বিমানবন্দরে পৌঁছন সুরজিৎ এবং তাঁর কয়েক জন সঙ্গী। সুদানের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়ে অশোকনগরের বাড়িতে ফিরেছেন সুরজিৎ। ঘরের ছেলে ঘরে ফেরার পর তাঁর পরিবারের সিদ্ধান্ত, ছেলেকে আর কখনও বিদেশে পাঠাবেন না।
মাত্র কয়েক মাস আগেই বিয়ে হয়েছিল সুরজিতের। তাঁর মা রীতা দে বলেন, ‘‘ও দেশে ছেলে যে পরিস্থিতির মধ্যে ছিল... খুবই টেনশনের মধ্যে কেটেছে এ ক’টা দিন। দিনরাত ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করতাম। বিয়ের এক মাস দশ-বারো দিনের মাথায় চাকরির জন্য সুদান গিয়েছিল ছেলে। ওখানে ছেলের মোবাইলের চার্জ থাকত না। ফলে কথাও হত না। তবে ঈশ্বরের কৃপায় ছেলেকে ফিরে পেয়েছি।’’ একমাত্র ছেলেকে যে এত তাড়াতাড়ি ফিরে পাবেন, তা এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না মায়ের। ছেলেকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় এই কয়েকটা দিন খেতে-ঘুমাতে পারেননি বাবা স্বপন দে। তবে ভারতীয় দূতাবাসের তৎপরতায় ছেলে যে নিরাপদে ঘরে ফিরতে পেরেছেন, তা মানছেন সুরজিতের মা-বাবা। সুরজিৎ বলেন, ‘‘যুদ্ধবিধ্বস্ত সুদানে এখনও প্রায় আড়াই হাজার ভারতীয় আটকে রয়েছেন। তাঁদেরও মুক্তি কামনা করি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy