(বাঁ দিকে) অশোক ভট্টাচার্য এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। —ফাইল চিত্র।
দার্জিলিঙের কমলালেবু থেকে বোরোলি মাছ। শিলিগুড়িতে এসে ধুতি-পাঞ্জাবি চুরি যাওয়া থেকে ট্রেনে ঠায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কলকাতায় ফেরা। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে অনেক গল্প শোনালেন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা শিলিগুড়ি পুরসভার প্রাক্তন মেয়র অশোক ভট্টাচার্য!
বৃহস্পতিবার সকালে পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে প্রয়াত হন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব। সেই খবর খানিক দেরিতেই পেয়েছিলেন তাঁরই মন্ত্রিসভার সদস্য অশোক। তিনি বলেন, ‘‘দলেরই এক জন আমায় সকালে ফোন করে জানতে চাইছিল, খবরটা ঠিক কি না। এর পর আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, খবরটা সত্যি।’’ বুদ্ধদেবের প্রয়াণের খবর পাওয়ার পর থেকে খানিক ভেঙেই পড়েছেন অশোক। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে পৌঁছে গিয়েছেন নিজের রাজনৈতিক জীবনের একেবারে শুরুর সময়ে। প্রাক্তন মন্ত্রী জানান, কলকাতায় ডিওয়াইএফআই-এর প্রতিষ্ঠালগ্নে প্রথমে সম্মেলনে বুদ্ধদেবের সঙ্গে তাঁর প্রথম আলাপ। তখন তিনি নিজে এসএফআই করতেন। তার পর থেকেই বুদ্ধদেবকে ‘বুদ্ধদা’ বলে সম্বোধন করতেন অশোক। তিনি বলেন, ‘‘বুদ্ধদার সঙ্গে অনেকটা সময় কাটিয়েছি। কত কাজ করেছি একসঙ্গে! আজকের এই দিনটার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। বার বার হাসপাতাল থেকে ইচ্ছেশক্তির জোরে ফিরে এসেছিলেন। গত বারও যে ভাবে উনি অসুস্থ হয়েছিলেন, ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। বুদ্ধদার চলে যাওয়াটা আমাদের কাছে একটা বড় শূন্যতা!’’
অশোক জানান, মন্ত্রী হওয়ার আগে শিলিগুড়ি এলে তাঁর বাড়িতেই উঠতেন বুদ্ধদেব। দার্জিলিং মেলেই যাতায়াত করতে পছন্দ করতেন। সঙ্গে রাখতেন একটা ছোট ব্যাগ। তাতেই জামাকাপড় থাকত। অশোক বলেন, ‘‘বুদ্ধদার একটা দারুণ অভ্যাস ছিল। যে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে আসতেন, সেটা আবার খুব সুন্দর করে ভাঁজ করে হ্যাঙারে ঝুলিয়ে রাখতেন। যাওয়ার সময় আবার সেটা পরতেন। এক দিন আমার বাড়িতে রাতে জানলা খোলা রেখে ঘুমিয়েছিলেন। চোর এসে ওঁর সেই ভাঁজ করা সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি আর একটা ঘড়ি চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। তার পর আমারই একটা পাঞ্জাবি পরে কলকাতায় ফিরেছিলেন বুদ্ধদা। এতটাই আত্মিক যোগাযোগ ছিল। যে ঘড়িটা চুরি গিয়েছিল, সেটা ওঁর খুব শখের ছিল। শুনেছিলাম, সেটা নাকি ওঁর জ্যাঠামশাই দিয়েছিলেন! ওই ঘড়িটা আমার বাড়ি থেকেই চুরি গিয়েছিল।’’ বুদ্ধদেবের সাদামাঠা জীবনযাপনের গল্প করতে করতে প্রাক্তন মন্ত্রী জানান, এ রকম অনেক সময়ে ঘটেছে যে, ট্রেনের রিজ়ার্ভেশনের টাকা ছিল না। তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শিলিগুড়ি থেকে কলকাতায় ফিরতেন বুদ্ধদেব।
১৯৭৭ সালে কাশীপুর থেকে জিতে প্রথম বার মন্ত্রী হয়েছিলেন বুদ্ধদেব। তখন থেকে অবশ্য উত্তরবঙ্গে গেলে শিলিগুড়ি সার্কিট হাউসেই উঠতেন। তবে অশোক জানান, সার্কিট হাউসে উঠলেও তাঁর বাড়ি থেকেই রান্না করা খাবার যেত বুদ্ধদেবের জন্য। তাঁর কথায়, ‘‘পছন্দের তালিকা বলতে সেই ভাবে আহামরি কিছু ছিল না। ওই সেই বোরোলি মাছ আর দার্জিলিঙের কমলালেবু। এই বছরখানেক আগেও যখন ওঁর বাড়িতে গেলাম, কমলালেবু নিয়ে গিয়েছিলাম।’’
অশোক রাজ্যের মন্ত্রী হয়েছিলেন ১৯৯১ সালে। সেই সময় রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরের মন্ত্রী বুদ্ধদেব। অশোক বলেন, ‘‘কোনও ফাইল ওঁর কাছে পাঠানো হলে যদি গিয়ে জিজ্ঞেস করতাম, এটা কী ভাবে করব, উনি বলতেন, ‘নিজের বুদ্ধিতে করো। আমার পরামর্শ কেন নিতে হবে।’ উনি বরাবর সাহস জুগিয়ে এসেছেন। এটাই ছিলেন বুদ্ধদা।’’
পাহাড়ের উত্তাল পরিস্থিতির কথাও উঠে এসেছে অশোকের স্মৃতিচারণে। তিনি বলেন, ‘‘এক বার দার্জিলিঙে আমরা সম্মেলন করব ঠিক করলাম। কিন্তু গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা জানাল, আমরা পাহাড়ে সম্মেলন করলে তারা আগুন জ্বালাবে। বুদ্ধদা সে কথা জানবার পর সিদ্ধান্ত নিলেন, সম্মেলন সমতলেই হবে। এতে অনেকেই ভেবেছিলেন, এটা আমাদের পরাজয়। কিন্তু বুদ্ধদা পরে বলেছিলেন, ‘আমি দার্জিলিঙে নতুন করে কোনও রক্তপাত চাই না। তাই সমতলে সম্মেলনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ আবার কামতাপুর আন্দোলনের সময় কেএলও যখন খুব সক্রিয়, উনি বললেন, ‘রাজবংশী বা কামতাপুর ভাষা নিয়ে আমাদের কোনও বিরোধ নেই। আমাদের বিরোধিতা কেএলও নিয়ে। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই।’ এগুলো আমরা দেখেছি, শিখেছি ওঁর কাছ থেকে।’’
কাঁদতে কাঁদতে অশোক বলেন, ‘‘সৎ থেকেও যে রাজনীতি করা যায়, তা বুদ্ধদাকে না দেখলে জানতাম না। জীবনের শুরু থেকে শেষ দিন পর্যন্ত সততার প্রতি অবিচল থেকেছেন। কখনও কোনও খারাপ শব্দ প্রয়োগ করেননি। আমার মনে আছে, এক বার বিধানসভায় হয়তো একটু রূঢ় ভাবেই কিছু একটা বলেছিলেন। কিন্তু তৎক্ষণাৎ আবার বলেছেন, ‘আমার এটা এ ভাবে বলা উচিত হয়নি।’ এমন মানুষ রাজনীতিতে বিরল।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy